গুইমারাতে ধর্মীয় উপাসনালয়ের নামে সরকারী খাস ভূমি দখল: নিরাপত্তা বাহিনীর নামে অপপ্রচার
দিদারুল আলম, গুইমারা, খাগড়াছড়ি:
খাগড়াছড়ির গুইমারার কুকিছড়ায় ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরি করার নামে সরকারী খাস ভূমি জবর দখল করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের নিকট থেকে জানা যায়, গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের কুকিছড়ায় পরিত্যাক্ত সেনাক্যাম্পের সরকারী খাসভূমিতে ধর্মীয় উপসনালয় তৈরীর নামে ভূমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে একশ্রেণীর উপজাতীয় ভূমিদস্যুরা।
এ ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি নিয়মিত টহল দল স্থানীয় কার্বারীসহ জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণকারী উপজাতীয়দের কাছে খাস ভূমিতে তড়িঘড়ি করে ঘর নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে, তারা সেনাবাহিনীর কাছে উক্ত ভূমি তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন বলে দাবি করেন, তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তাবাহিনী যথাযথ কর্তৃপক্ষ কিংবা ভূমির মালিকের অনুমতি নিয়ে ঘর নির্মাণ করার অনুরোধ করেন।
কিন্তু তা না করে উপজাতীয় ভূমি দস্যুরা তাদের পরিচালিত ওয়েব সাইট ও সামাজিক গণমাধ্যমে ‘সেনাবাহিনী ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙে দেয়া নির্দেশ দিয়েছে’ মর্মে প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উষ্কানী ছড়িয়ে মানুষের সমর্থন আদায় ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে।
খবর পেয়ে কুকিছড়ায় সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, উক্ত স্থানে পুর্বে সেনাক্যাম্প ছিলো । শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর শান্তিচুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে ঐ সেনা ক্যাম্পটি প্রত্যাহার করা হয়। এরপর থেকে দীর্ঘদীন স্থানটি পরিত্যাক্ত ছিলো। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনী এসে টহল দিয়ে যেতো। কিন্তু হঠাৎ করে ৩/৪ দিন আগে স্থানীয় কিছু লোক কোন কুচক্রি মহলের ইশারায় এই ভূমি দখল করে ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণের নিমিত্তে একটি কাঠের ঘরের অবকাঠামো দাড় করায়।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে যে, নির্মাণাধীন উপাসনালয়টির প্রায় ৩০০ গজ রেডিয়াসের ভেতর আরো ২ টি উপাসনালয় রয়েছে। তাছাড়া দূর্গম পাহাড়ী এলাকাটি এত ঘনবসতি নয় যে সেখানে আরো উপাসনালয় নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। ফলে সেখানে কেন বা কী কারণে উপজাতীয়রা আরেকটি উপাসনালয় নির্মাণের নামে সরকারী ভূমি দখল করতে চাইছে এ নিয়ে গুইমারার বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলছে ।
স্থানীয় সমাজের সচেতনদের দাবি পাহাড়ের আঞ্চলিক একটি সশস্ত্র সংগঠন নিজেরা আড়ালে থেকে সাধারণ উপজাতীদের দিয়ে সরকারী এ খাস ভূমিটি দখল করাচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য কালা মার্মা জানান, নির্মিতব্য উপাসনালয়টির ভূমিটি মূলত সরকারী খাস। এখানে একটি পরিবার বসবাস করতো। দেবতাদের ভয়ে ঐ পরিবারটি ভয় পেত। তাই আমরা ঐখানে বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করেছি এর ফলে এখানে আর কোন দেবতার ভয়ের কারণ নাই।
একই স্থানে দুটি মন্দির স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজন আছে বলেইতো তৈরি করা হয়েছে। প্রশাসনিক অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসনকে আমরা অবগত করিনি। তবে প্রশাসন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে কাজ করতে বলেছে। আমরা মন্দিরের কাজ শেষ করেছি।
যেখানে কুকিছড়ায় আরো দুটি উপাসনালয় রয়েছে সেখানে শুধু মাত্র একটি পরিবারের জন্য একটি উপাসনালয়ের নামে এ ভূমিটি দখলের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট কিয়াংয়ের সংখ্যা ১৫৭৬ টি। এদের মধ্যে শান্তিচুক্তির আগে ছিলো ১১১৪টি এবং শান্তিচুক্তির পরে হয়েছে ৪৬২টি। এর মধ্যে ১০০৭ টি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে, ৪৯০ টি সরকারী খাস জমিতে, ৭৩ টি বন বিভাগের জমিতে অবস্থিত এবং ৬ টি নিরাপত্তা বাহিনীর পরিত্যাক্ত সেনাক্যাম্প দখল করে স্থাপন করা।
নিরাপত্তা বাহিনীর পরিত্যাক্ত সেনাক্যাম্প দখল করে নির্মাণ করা কিয়াংগুলো হলো: কুতুবছড়ি বৌদ্ধ বিহার লক্ষীছড়ি; জনবল বুদ্ধ বিহার নানিয়ারচর; জুড়াছড়ি পাড়া, নানিয়ারচর; নাভাঙ্গা পাড়া বৌদ্ধ বিহার রাঙামাটি এবং শিরের আগা, চাইল্যাতলা, রাজনগর।
এর বাইরেও বাঙালীদের কবুলিয়ত দেয়া ও পরে গুচ্ছগ্রামে চলে যাওয়ার পর পরিত্যাক্ত বেশ কিছু জমিতেও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করে দখল হয়েছে। দিঘীনালার সোনামিয়া টিলা তার অন্যতম উদাহরণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী যখন কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেছে তখন ওই এলাকার জনবসতি, নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও কৌশলগত অবস্থান বিবেচনা করেই করেছে। কিন্তু শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই স্থানগুলো ধর্মীয় স্থাপনার নামে দখল করেছে স্থানীয় উপজাতীয় কুচক্রি মহল। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে তারা তাদের আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজী, যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ধর্মীয় স্থাপনার নামে সাম্প্রদায়িক্ উষ্কানী ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদান, অস্ত্র ও তথ্য পাচার ও আদান প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। ধর্মীয় লেবাসধারী অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন সময় অস্ত্র, মাদক ও নারী পাচার করতে গিয়ে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে।
কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় উপাসনালয়ের নামে যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ শুধু ভূমি দখলই নয়, এর পেছনে রয়েছে সুদুর প্রসারী নীলনকশা বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। তারা এ বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় হাফছড়ি ইউপি’র চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী বলেন, কুকিছড়ায় একটি বুদ্ধ মন্দির স্থাপন করার জন্য আমার কাছে সহযোগিতা চেয়েছে আমি সহযোগিতা করেছি। তবে কোন স্থানে আমি জানতাম না। পরে জানতে পারলাম সরকারী খাস ভূমি দখল করে স্থানীয়রা একটি বিহার নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। এবিষয় নিয়ে ইউএনও স্যারসহ সেখানে গিয়ে কাজ বন্ধ করার জন্য বলেছি।
গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অ.দা) বিভিষণ কান্তি দাস জানান, কুকিছড়ায় সরকারী একটি খাস ভূমিতে অবৈধভাবে উপজাতীয়রা বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করছে খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা বিহার নির্মাণে স্থগিতাদেশ দিয়েছি। মূলত ঐ ভুমিটি সরকারী খাস ভূমি, এছাড়া আপাতত বিহার নির্মাণের কাজ বন্ধ রয়েছে।
যেখানে বিহার নির্মাণ করা হয়েছে সেটা কোনদিন সরকারি খাজ জমি ছিলোনা, বরন্স যেখানে সেনা ক্যাম্প তোলা হয়েছে সেটা ছিল অবৈধ ভাবে পাহারীদের জায়গা দখল করে স্থাপন করা হয়েছে এবং হইতেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি হওয়ার পর কয়টা ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে সেটা পাহরীদের ভালো করে জানা আছে আর যে গুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো নিলেও কোন সমস্যা নেই সরকারের কোন এত প্রয়োজন নাই সেগুলো নেওয়া হয়েছে মাত্র। কিন্ত সেই সেনাবাহিনী গুলো পার্বত্য চট্তগ্রামের আরো অন্য ক্যাম্পে বদলি করা হয়, এই হলো বাংলাদেশ সরকারের কার্য্যকলাপ।