Notice: Trying to get property 'post_excerpt' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 53

Notice: Trying to get property 'guid' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 55

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্রময় কৃষ্টি ঐতিহ্য

রামগড় প্রতনিধি:

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষ্টি ঐতিহ্য কালের বির্বতনে আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার স্রোতে পোশাক পরিচ্ছদ, উৎসব অনুষ্ঠান, লোকজ সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ ঐতিহ্যবাহি অনেক সামাজিক রীতি নীতি পাহাড়ি সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মধ্যে ছোট ছোট সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্রময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বহু আগেই হারিয়ে গেছে। এখন  চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এ তিনটি প্রধান উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মূল ঐতিহ্যবাহি জীবনধারাও আধুনিকতার স্রোতে অনেকটাই পাল্টে গেছে। নিজেদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি যেভাবে ক্রমশ: হারিয়ে যাচ্ছে তাতে এখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রবীন ও সচেতন মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। রামগড় উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মংশাপ্রু কার্বারী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাহাড়ি জনগোষ্ঠী মারমা সম্প্রদায়ের  নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা, খেলাধুলা, পোষাক পরিচ্ছদ, উৎসব অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধশালি ছিল মারমারা। কিন্তু এখন অনেক ঐতিহ্যই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। রুপার তৈরি নানা গহনায় সুসজ্জিত থাকতো মারমা রমনীরা। এখন আর মহিলাদের পায়ের সেই অলংকার কাখ্যাং চোখে পড়ে না। বুড়াবুড়িদের মাথায় দেখা যায় না ঐতিহ্যবাহি ঘংবং বা পাগড়ি।

এক সময় বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যুবক, যুবতিরা রাতভর দ খেলায় মাতোয়ারা থাকতো। জুমের ফসল ঘরে উঠার পর নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হত বৈচিত্রপূর্ন লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পাংখং। এ যাত্রাপালা অনুষ্ঠানে মারমা মহিলা পুরুষ সন্মিলিতভাবে বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজের ভালমন্দ দিক তুলে ধরা হতো। একইভাবে রামা ম:নং ওয়াসাইন্ডা, ককানু, মংচাইন্দা, থাম্রা প্রভৃতি পালা গান, লুংদি, ক্যাপা, রদু, মাখ্রাং ইত্যাদি লোকগীতির কথা এখন নতুন প্রজন্ম জানেও না। ধর্মীয় পৌরহিতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহি সইং নৃত্য কিংবা জাইত নৃত্য আগেরকারদিনের মত এখন দেখা যায়না।

মারমাদের নিজস্ব ভাষা ছাড়াও সামুসা বা বর্ণমালাও রয়েছে। কিন্তু এসব বর্ণমালার ব্যবহার না থাকায় এগুলোও এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। লুংহলা আফুইক নামে একটি সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুইসাউ মারমা বলেন, অন্যসব সংস্কৃতির মত মারমাদের বিয়ে এবং শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রীতি নীতিও আজ ক্রমশ: বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানাদি সম্পাদনকারি বৈদ্য সম্প্রদায় দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার কারণে আগেরমত এখন আর ঐতিহ্যবাহি রীতিগুলো পালন করা যাচ্ছে না। মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত ত্রিপুরা উপজাতি সম্প্রদায়েরও বর্ণিল কৃষ্টি, সংস্কৃতি কালের স্রোতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বি ত্রিপুরা নানা দেবদেবীর অসংখ্য পূজা পার্বণে মশগুল থাকতো একসময়। পাড়া কিংবা সমাজে এখন সেসব পূজাপার্বণ খুব কমই পালন হয়। নবান্নের উৎসবে এখন মাইলুমা ও খুলুমা দেবতার

রন্দক পূজা বা নকছুমতাই দেবীর আরাধনা হয়না। ত্রিপুরাদের আরেকটি ঐতিহ্যবাহি গরিয়া দেবতার পূজা আগের মত উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়না। চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে বৈশাখ মাসের সপ্তম দিবসব্যাপী অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালিত হত এ গরিয়া পূজা। এ উপলক্ষে ত্রিপুরা আবালবৃদ্ধবণিতা সকলে মিলে নাচগানে আমোদ উল্লাসে বিভোর হয়ে উঠতো। পরিবার পরিজনের মঙ্গলার্থে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত পরাকাইনাই পূজাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পূজাপার্বণের মত ঐতিহ্যবাহি খেলাধূলা, লোকজ সংস্কৃতি, পোষাক পরিচ্ছদ, অলংকার ইত্যাদিও হারিয়ে যাচ্ছে।

ত্রিপুরা রমনীরা এখন আগের মত কোমরতাঁতে নিজের ও পরিবার পরিজনের পরিধানের জন্য রিনা, রিসা, ধুতি প্রভৃতি বস্ত্র তৈরি করতে তেমন দেখা যায় না। পুর্ব পুষরা তাদের ঐতিহ্যবাহি হাটুঁ পর্যন্ত ধুতি কিংবা মাথায় পাগড়ি পড়ে না। তেমনি  রমনীদের গলায় অগণিত পুঁতির মালা, রাং মাতাং বা রুপার মুদ্রার মালা, রুপার হাঁসুলী, হাতে পেচাঁনো কুঁচি, পায়ে বিচিওয়ালা বেংকি, কানে সানাইয়ের কানফুল আর নাকে সুউচ্চ নাকফুল পড়তে দেখা যায় না। বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রিয় কমিটির সাবেক সভাপতি সুরেশ মোহন ত্রিপুরা বলেন,  ত্রিপুরা সমাজ অনেক ঐতিহ্যই হারিয়ে ফেলেছে।

এখন আর পাড়ায় পাড়ায় রাতব্যাপী ঐতিহ্যবাহি ঘিলা খেলা হয় না। অচাই(পুরোহিত) দিয়ে নিজস্ব রীতি নীতি পালন করে বিয়েও অনুষ্ঠিত হয় না। সবচেয়ে বড় উৎসব বৈসু পালনেও আগের অনেক ঐতিহ্য ছিটকে গেছে।  তিনি বলেন,  ত্রিপুরাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালাও আজ তেমন একটা চর্চা হয়না। ত্রিপুরা ভাষার ককবরক অভিধান বা বর্ণমালা ছাপানোর জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য  জেলা পরিষদ ২০০৬ সালে উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এক সময় হয়তো পাহাড়িদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ত্রিপুরা ও মারমাদের মত চাকমা সম্প্রদায়ের জীবনধারাও আধুনিকতার স্রোতে বহু পাল্টে গেছে। বিভিন্ন পূজাপার্বণের মধ্যে সন্তান কামনা, আর্থিক সমৃদ্ধি ও  বিপদ থেকে মুক্তির অহ-ইয়া পূজা, সন্তানের রোগমুক্তির জন্য নদীতে মুষ্টিভাত ছিটানো, মহামারি থেকে নিজ নিজ পাড়াকে মুক্ত রাখার থানমানা বা গাঙ্গ পূজা ইত্যাদি এখন আর পালন করতে দেখা যায় না। বিভিন্ন খেলাধুলার মধ্যে কানামাছির মত ফুল মাছ খারা, শামুকের খোল দিয়ে শামুক খারা, যুবকদের নাদেং খারা, এলা দলা খারা, ঘিলা খারা প্রভৃতি খেলাধুলা হারিয়ে গেছে। রুপা, তামা, লোহা ও পুঁতির তৈরি অলঙ্কারের মধ্যে হাঁসলী, চন্দ্র হার, বাজুবন্ধ, তাজ্জব, কোমরের বিছা, পায়ের খারু, পুঁতির জামছড়া, কানে সাতটি করে ঝুমকা পড়া এখন আর চাকমা রমনীদের পছন্দনীয় নয়।

একসময় চাকমা বিয়েতে উপঢৌকন হিসাবে ৪০ভরি ওজনের রুপার তৈরি হাঁসলী  দেয়ার রেওয়াজও  ছিল । ঐতিহ্যবাহি নানা লোকজ সংস্কৃতির মত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন, কাঠের তৈরি বেলা(বেহালা), বাঁশের তৈরি  খেংগরং,  ধুধুক, জান্দুরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি চাকমা বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকেই একে একে হারিয়ে যাচ্ছে  চাকমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এক সময় এসব ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি রুপকথার গল্পের মত শুনানো হবে আগামী প্রজন্মকে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন