পাহাড়ে ‘ইংরেজি’ স্কুল প্রসঙ্গে

Ferdous-Quoreshi20120710125920
 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় শিশুদের জন্য একটি অন-লাইন ‘ইংরেজি’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বান্দরবান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ডরুঝিরিপাড়া নামে দুর্গম এলাকার শিশুদের জন্য এমন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ। আমাদের তিন পার্বত্য জেলায় কিছু এলাকা এখনো উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আসেনি। গত কয়েক দশকে সেখানে রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজে অনেক অগ্রগতি হলেও সেখানকার কিছু এলাকা দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি থেকে এখনো কার্যত বিচ্ছিন্ন। এ পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে এই তিন জেলার সব মানুষকে দেশের মূল জনস্রোতে একাত্ম করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

ইংরেজি স্কুল কেন?

এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি একটি প্রশ্ন মনে জাগে। ইন্টারনেটে শিশু শিক্ষা প্রদানের কাজটি দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলায় না হয়ে ‘ইংরেজি ভার্সনে’ করা হচ্ছে কেন? ইন্টারনেটের মাধ্যমে কি বাংলায় শিক্ষা প্রদানে কোনো সমস্যা আছে? পাহাড়ি শিশুরা অতি দ্রুত ইংরেজিতে কথা বলা শিখবে। ভালো কথা। এই ইংরেজিতে তারা কার সঙ্গে কথা বলবে? তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে? গ্রামের অন্যদের সঙ্গে? আশপাশের এলাকার মানুষের সঙ্গে? বান্দরবান জেলা শহরের লোকজনের সঙ্গে? সারা বাংলাদেশে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বিনামূল্যে বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে। অতি অল্পসংখ্যক বিত্তশালী ব্যক্তি তাদের সন্তান-সন্ততিদের ইংরেজি স্কুলে পড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। তারা এই দেশে উপার্জিত অর্থে বিত্তশালী হওয়ার পর এখন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে পৃথক ও উচ্চবর্ণের অভিজাত প্রজাতির মানুষ বানাতে চান। কিন্তু আমাদের পাহাড়ের ছেলেমেয়েদের বাংলা না শিখিয়ে প্রথমেই ইংরেজি শেখানোর উদ্যোগের কোনো অর্থ বুঝতে পারি না। এমন যদি হয় যে, এ উদ্যোগ তাদের এদেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি থেকে পৃথকীকরণ করার কোনো প্রক্রিয়ার অংশ, তাহলে বলার কিছু নেই। সে প্রক্রিয়া পার্বত্য এলাকায় নানাভাবেই চলছে। সেক্ষেত্রে এই মহতী উদ্যোগ অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

ইন্টারনেটে কি বাংলায় পড়ানো যায় না?

ইন্টারনেটে বাংলা ভাষায় শিশুদের শিক্ষা প্রদান করার কোনো কারিগরি সমস্যা নেই। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের নতুন করে কিছুই করতে হবে না। কেবল তাদের ইচ্ছাটা জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের পাহাড়ি এলাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার সুসম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক আদান-প্রদান বাড়ানো রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাহাড়ের ছেলেমেয়েদের বাংলায় লেখাপড়া না শিখিয়ে সেখানে ‘ইংরেজি স্কুল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কোনোভাবেই যুক্তিসিদ্ধ নয়। পাহাড়ি শিশুরা যদি তাদের মাতৃভাষায় লেখাপড়া করতে পারত তাহলে ভিন্ন কথা ছিল। যেসব শিশুর মাতৃভাষায় লিখন-পঠনের ব্যবস্থা নেই, তাদের প্রাথমিক শিক্ষা দেশের রাষ্ট্রভাষায় হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাহলে তারা দেশের ভেতরে যে কোনো কাজে যুক্ত হতে পারবে। বাংলা ঠিকভাবে রপ্ত না করলে তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যাবে। তারা তো উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদের মতো সুবিধাভোগী নয়। তাদের দেশের আর দশটা সাধারণ মানুষের সঙ্গেই কাজ করতে হবে।

শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়াই বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু আমাদের দেশের পাহাড়ি এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর কারও ভাষারই লিখিত রূপ প্রচলিত নেই। কোনো বইপত্রও নেই। এমতাবস্থায় তাদেরকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য নতুন করে বইপুস্তক তৈরির চেষ্টা চলছে। এ কাজটি কার্যকরভাবে করতে গেলে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিতে হবে। সব জনগোষ্ঠীই নিজস্ব ভাষায় লিখতে-পড়তে পারলে অবশ্যই আনন্দ এবং গৌরববোধ করবে। কিন্তু পুরনো দিনের কোনো পুঁথি ঘেঁটে বিলুপ্ত কোনো বর্ণমালার পাঠোদ্ধার করে দু’চারটি বইপুস্তক তৈরি করলেই যে তার কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হবে, তা মনে করা যথাযথ নয়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা ভাষা ২৬ কোটি মানুষের ভাষা এবং একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও তাকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দু’চার হাজার বা দু’চার লাখ মানুষের ভাষাকে নতুনভাবে বর্ণমালা সাজিয়ে লিখিত রূপ তৈরি করে কার্যকর ব্যবহারে আনা কতটা সম্ভব, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দেশের রাষ্ট্রভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করার ব্যবস্থা থাকা অত্যাবশ্যক। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার পর হাইস্কুল পর্যায়ে বা কর্মজীবনে দেশের রাষ্ট্রভাষাতেই সবাইকে লেখাপড়া বা কাজকর্ম করতে হবে। দেশের আর দশটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ছেলেমেয়েরা ইংরেজিও শিখবে। কিন্তু দেশের কোনো এলাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে পাশ কাটিয়ে শিশুদের শুধু ইংরেজিতে শিক্ষাদান কোনোভাবেই অনুমোদন করা যায় না। তা হবে আমাদের শিক্ষানীতির পরিপন্থী এবং রাষ্ট্রীয় স্বকীয়তা ও সংহতির জন্য হুমকি।

আমাদের দেশে কেবল যে পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষাই আলাদা তা নয়। প্রায় সব জেলার মানুষই তার নিজ নিজ আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় কথা বলেন। এসব কথ্য ভাষার কোনো কোনোটি অন্য জেলার মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। প্রায় ভিন্ন ভাষার মতো। এসব ভাষার জন্য যদি ভিন্ন বর্ণমালা উদ্ভাবন করা হয় এবং আলাদা বইপত্র লেখা হয়, তাহলে আমরা মাশাআল্লাহ্ কমপক্ষে ত্রিশ-চলি্লশটি ভাষার দেশ হতে পারি! কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ নিজেদের মধ্যে তাদের স্থানীয় ভাষায় কথা বললেও অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তায় বা কাজকর্মে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করে। পৃথিবীর সব দেশেই এই পরিস্থিতি কম-বেশি বিদ্যমান। (ভাষাবিদরা একে নাম দিয়েছেন_ ‘diglossia’। একই ব্যক্তির একই সঙ্গে দুই ভাষায় কথা বলা।) আমাদের পাহাড়ি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ভাষার বিষয়টিতে এই বাস্তবতা মনে রেখেই এগুতে হবে।

পাহাড় বনাম সমতল

আমাদের পাহাড়ের মানুষ ও সমতলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির দূরত্ব গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত. ঐতিহাসিক বাস্তবতায় সমতলের মানুষ ও মূলধারার মানুষ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছে। এ জন্য পাহাড়ের মানুষকে সমতলের মানুষের অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকার হতে হয়। সমতলের মানুষ বরাবর নিজেদের উন্নত প্রজাতি মনে করে এসেছে। তাদের চোখে পাহাড়ের মানুষ সভ্যতার মানদণ্ডে নিম্ন পর্যায়ের। বাংলা সাহিত্যের নামিদামি সাহিত্যিকদের উপন্যাসে-ছোটগল্পে পাহাড়ি মানুষের উপস্থিতি সেভাবেই আছে। অবজ্ঞা, উপহাস, পরিহাস, বড়জোর কিছু করুণা। আমাদের পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ১৯০০ সালে। ঔপনিবেশিক শাসকরা এতদঞ্চলে তাদের চিরস্থায়ী অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে উপমহাদেশের সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং বিভিন্ন উপজাতীয় ও বনবাসী অঞ্চলে সমতলের মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। এর মূলে ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা। যা ১৮৮৭ সালের দিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। সমতলের মানুষ ইসলাম, হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের মতো সংগঠিত ধর্মমতের অনুসারী হওয়ায় তাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা অনেক কঠিন। সে তুলনায় পাহাড়ে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষগুলোকে তাদের পশ্চাৎপদতার সুযোগে অনেক সহজে বশীভূত করে ধর্মান্তরিত করা যায়। সে জন্যই এ অঞ্চলগুলোকে সমতল থেকে এভাবে আইন করে আলাদা করা হয়।

এই পৃথকীকরণের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, সমতলের লোকেরা এসব এলাকার সরল-সোজা মানুষকে ঠকিয়ে নানাভাবে শোষণ করবে। অতএব তাদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মহানুভব ব্রিটিশ শাসকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই পৃথকীকরণের পর এসব এলাকায় যদি উন্নয়নের গতিধারা বেগবান হতো তাহলে তাকে মানব জাতির ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনের গণমুখী অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা যেত। কিন্তু এই অঞ্চলগুলোকে মানবসভ্যতা থেকে কার্যত আড়াল করে রাখায় সুদীর্ঘকাল পরেও সেখানে কিছু চার্চ প্রতিষ্ঠা এবং চার্চ পরিচালিত ধর্মান্তর কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কোনো তৎপরতা পরিচালিত হয়নি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃষ্টান্ত থেকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করা যেতে পারে।

ব্রিটিশ সরকারের এই ভেদনীতির আওতায় ১৯০০ সালে ‘হিল ট্রাক্ট ম্যানুয়েল’ প্রবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘Partially Excluded Area’ বা আংশিক বহির্ভূত এলাকা ঘোষণার পর সেখানে সমতলের মানুষের যাতায়াত একেবারেই সীমিত হয়ে যায়। ৫০ বছর সেভাবে থাকার পর ১৯৫০ সালে এসে দেখা যায় সেখানে একটিমাত্র হাইস্কুল। তাও মূলত রাজ-কর্মচারী এবং কতক ধনী পাহাড়ি পরিবারের সন্তানদের জন্য। তখন পর্যন্ত এই বিশাল এলাকায় আর একটিও সাধারণ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি। পুরো সময় ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য বিভিন্ন ধর্মযাজক সমগ্র এলাকার বনবাদাড় চষে বেড়িয়ে যেখানে পেরেছে চার্চ বানিয়েছে। মূলত বাইবেল পড়ানো এবং খ্রিস্টের বাণী শোনানোর মধ্যেই পাহাড়িদের ‘বিদ্যাচর্চা’ সীমিত থেকেছে।

পাহাড়ে বাঙালির অবস্থান

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বাঙালিরা বড় সংখ্যায় যেতে শুরু করেছে অতি সম্প্রতি। প্রেসিডেন্ট জিয়া ‘শান্তি বাহিনী’র সশস্ত্র হামলা মোকাবিলায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। দেশের সার্বভৌমত্ব প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় এই এলাকাটির ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ভূমিতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অটুট রাখা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না, তেমনি যুদ্ধ কিংবা আঞ্চলিক বিদ্রোহ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী স্থানীয় জনসমর্থন ছাড়া এক পা চলতে পারে না। এটাই যুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ। পাহাড়ি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার পর সেখানে যে পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল তার মোকাবিলায় জিয়া দ্বিমুখী কর্মসূচি হাতে নেন। প্রথমত. তিনি পাহাড়িদের মনে আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকেন। চাকমা সম্প্রদায়ের ‘রাজমাতা’কে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়ে সেখানে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন। নিজে ঘন ঘন পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে পাহাড়িদের সমস্যা সরেজমিন দেখার ও বোঝার চেষ্টা করতে থাকেন। সরকারিভাবে বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে নিজে সেখানে দুর্গম পাহাড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে রাতযাপন করে পাহাড়িদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন। এ সময়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার উপলব্ধি এই যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া পাহাড়ি জনগণের প্রতি সুবিচারের প্রশ্নে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। তার অকাল মৃত্যু না ঘটলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমরা আজ যে সমস্যায় আছি তার একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মীমাংসা বের হয়ে আসত।

তিনি সমতলের মানুষকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি হাতে নেন। সেটা অপরিহার্য ছিল। ওই কাজটি করা না হলে বহিঃশক্তি আমাদের দেশের এ অঞ্চলটিকে নিয়ে এতদিনে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠত। যার মোকাবিলা করা বাংলাদেশ সরকারের সাধ্যের বাইরে চলে যেত। লক্ষ্য করার বিষয়- ব্রিটিশ সরকার চলে গেছে কিন্তু পাহাড়ি এলাকা নিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের সেই বিভাজন তৎপরতা অপরিবর্তিত থেকে গেছে। কেবল ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকাটি চলে গেছে অন্য কিছু বিদেশি রাষ্ট্র ও এনজিও সংস্থার হাতে। যারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাহাড় ও সমতলের মানুষের মধ্যে সেই পুরনো বিভেদনীতি নবরূপে কার্যকর রেখেছে। এখনো পাহাড়ের বহু স্থানে চলছে প্রকাশ্য দ্বৈত শাসন।

নিজ দেশের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা

পাহাড়ে বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার জন্য এবং সেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মানুষকে অবাঞ্ছিত করে তোলার জন্য দেশে-বিদেশে নিরন্তর বহুমুখী তৎপরতা চলছে। পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী সমতলের মানুষকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। একই দেশের মানুষ দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বহিরাগত হবে কেন? রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির মানুষ কি ঢাকায় বহিরাগত? এই বহিরাগতরা সেখানে নিত্যদিন কেবল অপকর্মই করে চলেছে, তারা গুণ্ডা-বদমাস, নারী নির্যাতনকারী দুর্বৃত্ত এরকম আপত্তিকর প্রচারণা চলছে দুনিয়াজুড়ে। গত ৪০ বছরে সেখানে যত খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি হয়েছে তার সবকটিকে একত্রিত করে তাতে আচ্ছামতো রং চড়িয়ে একটা ভয়াবহ চিত্র দাঁড় করানো হয়। জনৈক মুহুরী বাবুর রক্তাক্ত মাথার একটি বীভৎস ছবি প্রায়শ তুলে ধরা হয় পাহাড়ে বাঙালির বীভৎসতার দৃষ্টান্ত হিসেবে। বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট এবং পত্রিকা এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এ ধরনের ঢালাও প্রচারণা নিশ্চিতরূপেই অনৈতিক। স্পষ্টত এসবের পেছনে অনেক লম্বা হাত কাজ করছে।

আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে পার্বত্য জেলাগুলোর চেয়ে সমতলের অবস্থা কি ভিন্ন? আমাদের সমতলের জেলাগুলোতে বছরে কত মানুষ সহিংসতায়, সন্ত্রাসে, ডাকাতি-রাহাজানিতে প্রাণ হারাচ্ছে তার তালিকা তৈরি করলে দেখা যাবে, মাথাপিছু হতাহতের সংখ্যা পাহাড়ের চেয়ে সমতলে কয়েকগুণ বেশি। সমতলে দুষ্কৃতকারীদের নৃশংসতায় নিহত-আহতদের রক্তাক্ত বীভৎস ছবি একত্রিত করা হলে যে ভয়ঙ্কর চিত্র পাওয়া যাবে তা দেখলে অনেকেই মূচ্র্ছা যাবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবাদ এভাবে অতিরঞ্জিত করে প্রচারের কাজে লিপ্ত সংস্থাগুলো রাজধানীতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সভা-সেমিনার হয়ে থাকে। তাতে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরা যোগ দিয়ে থাকেন। নিজ দেশের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করার চেয়ে বড় দেশদ্রোহিতা আর কিছুই হতে পারে না।

শেষ কথা

যে কোনো পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য কাজ করা অবশ্যই মহৎ কর্ম। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা সব দেশে সব জনগোষ্ঠীতে সমানতালে এগোয়নি। অসম উন্নয়ন ধারায় কিছু জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। তাদের প্রাগ্রসর মানব সমাজের কাতারে শামিল করতে হলে কিছু বিশেষ সুাবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। তবে সেই কাজটি করতে গিয়ে যদি এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈরী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, তা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে। সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকেও আরও বেশি প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেবে। পাহাড়ের শিশুদের বাংলায় শিক্ষা না দিয়ে ইংরেজি শেখানোর উদ্যোগ যেন তেমন অবস্থার সৃষ্টি না করে।

লেখক : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।

[email protected]

আরও খবর এবং প্রবন্ধ

রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে ২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি

পার্বত্যাঞ্চলে সাধারণ মানুষের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ করার পাঁয়তারা

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও বর্ণমালা প্রসঙ্গ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পাহাড়ে ‘ইংরেজি’ স্কুল প্রসঙ্গে”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন