পুণঃপ্রকাশিত

প্রসঙ্গ জাতীয় শোক দিবসঃ ১৫ আগস্ট নাকি ১০ নভেম্বর?

fec-image

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন নাগরিককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস কবে? জবাবে সবাই বলবে ১৫ আগস্ট। শুধুমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অখণ্ড ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের কতিপয় উপজাতিরা (বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের বিশেষ গোষ্ঠী) ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবসের পরিবর্তে, ১০ নভেম্বরকে “শোক দিবস” হিসেবে পালন করে।

কারণ এইদিন তাদের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) নিহত হন। বাংলাদেশে আমাদের সকলের জাতির পিতা “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব” হলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র “জুম্মল্যান্ড” গঠনের স্বপ্ন দেখা উপজাতিদের জাতির পিতা হচ্ছেন এই মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা।  আপনি কি জানেন কে এই “মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা”?

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯, মৃত্যু: ১০ নভেম্বর, ১৯৮৩) ছিলেন একজন উপজাতি নেতা এবং রাজনীতিবিদ। ইতিহাসের ঘটনাবলী থেকে জানা যায়, এমএন লারমা পাহাড়ি ছাত্র সমিতির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত তরুণদের সংগঠিত করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সাবেক সংসদ সদস্য মি. রোয়াজা ছিলেন উক্ত সংগঠনের সভাপতি এবং এমএন লারমা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক নির্বাচনে এমএন লারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এমএন লারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একটি খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করেছিলেন। এমএন লারমা সংসদ সদস্য হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনাকালে পাহাড়ি ছাত্র সমিতিসহ কতিপয় তরুণের সাথে তার ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালে এমএন লারমা জনসংহতি সমিতির একটি সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করেন, পরে তা শান্তিবাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতার লোভ, স্বার্থপরতা, দলীয় মতাদর্শসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শান্তিবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এ সময় এমএন লারমা চীনাপন্থী ও প্রীতি কুমার চাকমা ভারতপন্থী নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে শান্তিবাহিনী সম্পূর্ণ রূপে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করে যার ফলে নিজেদের মধ্যে মারামারি আর হানাহানিতে শান্তিবাহিনীর শতাধিক সদস্য নিহত হয়।

এই ঘটনার জের ধরেই ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর আন্তঃদলীয় কোন্দল আর ক্ষমতার লোভের শিকার হিসেবে প্রতিপক্ষ প্রীতি গ্রুপের সশস্ত্র হামলায় নিহত হন এমএন লারমা। এ প্রসংগে ১৮ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, ‘তথাকথিত শান্তিবাহিনীর প্রধান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হইয়াছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়া গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাত্রে আমাদের রাংগামাটি সংবাদদাতা জানান, মি. লারমা গত ১০ নভেম্বর সীমান্তের অপর পারে ভারতে ইমারা গ্রামে বাগমারা নামক স্থানে শান্তিবাহিনীর কল্যাণপুর ক্যাম্পে প্রতিদ্বন্দ্বী শান্তিবাহিনীর প্রীতি গ্রুপের সদস্যদের হামলায় তিনি নিহত হইয়াছেন।’

বিভিন্ন তথ্য বিবরণী এবং ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শান্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন এলিনের নেতৃত্বে প্রীতি গ্রুপের আট-দশজনের একটি সুইসাইডাল স্কোয়াড এম এন লারমা গ্রুপের শিবিরে সশস্ত্র অভিযান চালায়। উক্ত হামলায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাথে তার বড় ভাইয়ের শ্যালক মনি চাকমা, খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক অপর্ণা চরম চাকমা, কল্যাণময় চাকমা ও স্বঘোষিত লেফটেনেন্ট রিপনসহ শান্তিবাহিনীর মোট আটজন সদস্য ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান।

এম এন লারমার মৃত্যুর পর জনসংহতি সমিতির পূর্ণ নেতৃত্ব চলে যায় তার আপন ভাই সন্তু লারমার হাতে। যিনি বর্তমানে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান। সন্তু লারমার পাশাপাশি বর্তমানে উল্লেখযোগ্য উপজাতি নেতার মধ্যে আছেন সাবেক শান্তিবাহিনী কমান্ডার ঊষাতন তালুকদার, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে একজন নির্বাচিত সাংসদ এবং জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য। এম এন লারমার মৃত্যুর ৩৫ বছর হয়ে গেলেও এ সকল নেতা কখনই তাদের অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমার হত্যার বিচার চায়নি।

অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোন উপজাতি ব্যক্তি খুন হলে অথবা ছোটখাট অনেক বিষয় নিয়ে তারা দেশে-বিদেশে সরকার, সেনাবাহিনী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের ঘাড়ে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে নানান ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালালেও নিজ জাতির পিতা বলে খ্যাত এত বড় একজন নেতার হত্যাকারী কারা, তিনি কেন মারা গিয়েছিলেন, হত্যাকারীরা এখন কোথায় কী অবস্থায় আছে এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা কখনই দাবি বা আন্দোলন করেনি। সন্তু লারমা, দেবাশীষ রায়, ঊষাতন তালুকদার, এরা কেউই এমএন লারমার হত্যার বিচার চায় না কেন? উপজাতিদের এই নীরবতা জনমনে প্রশ্ন এবং সন্দেহের উদ্রেক সৃষ্টি করে।

১০ নভেম্বর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর একাংশ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু তারা তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এই মৃত্যুর ইতিহাস চাপা রেখে শুধুমাত্র দিবসটিকে জুম্ম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। কারণ এই ঘটনার মধ্যে তাদের জাতিগত হিংস্রতা আর বিভেদের চিত্র প্রকাশ পায়। তাই এই ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তারা কৌশলে গোপন করে রাখে।

মূলতঃ ১০ নভেম্বরকে পুঁজি করে উপজাতি সংগঠনগুলো ব্যাপক চাঁদাবাজি করে নিজেদেরকে আর্থিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট করছে। ১০ নভেম্বর এখন আর জুম্ম জাতির শোক দিবস নয় বরং অবৈধ চাঁদা আদায়ের বাণিজ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে পাহাড়ের স্থানীয় লোকেরা মনে করে থাকেন।

United Jummaland (Affiliated by Republic of Jummaland) নামক একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানা যায় যে, গত বছর (২০১৭) ভারতের দিল্লীতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে “MARTYR DAY” শিরোনামে একটি শোক/স্মরণসভা পালিত হয়। ঐ স্মরণসভার প্রকাশিত ছবির ব্যানারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তথাকথিত “জুম্মল্যান্ড” গঠনের মানচিত্রও প্রকাশ করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে তথাকথিত জুম্মল্যান্ডের স্বঘোষিত পররাষ্ট্র মন্ত্রী করুনালংকার ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন।

ইতিপূর্বেও তথাকথিত স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের জন্য উপজাতিরা অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পতাকা, মানচিত্র, পরিচয়পত্র, মুদ্রা এবং রেডিও চ্যানেলের ছবি প্রকাশ করেছিলো। তাদের ধৃষ্টতা এত বেশী বেড়েছে যে চলতি বছরে ১০ নভেম্বরকে তারা জুম্ম জাতীয় শোক দিবসের পাশাপাশি ঐদিন জুম্মল্যান্ডের জাতীয় পতাকা (?) অর্ধনমিত রাখা এবং দিনটিতে জুম্ম জাতির জন্য সাধারণ ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করেছে!!!!

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের ডাকে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশের অখণ্ড ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভেঙ্গে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সাহস কিভাবে পায় উপজাতি জঙ্গি গোষ্ঠীরা? অথচ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই উপজাতি জনগোষ্ঠীরই একটা বড় অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলো।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তার ভাই সন্তু লারমা প্রসঙ্গে ড. হুমায়ুন আজাদ বলেন, যারা নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে দাবী করেন, তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছিলেন (হুমায়ুন আজাদ- ১৯৯৭ ;২১/২২)। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেনি।

উল্লেখ্য যে, বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের পিতা ত্রিদিব রায় ছিলেন একজন চিহ্নিত রাজাকার। সেই রাজাকার পুত্র দেবাশীষ রায় চলতি বছরের মার্চ মাসে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুতে বিভিন্ন বিদেশীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ বিরোধী সেমিনার আয়োজন করেছিলো।

প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয় আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে উপজাতি নেতাদের ভূমিকা কি ছিল এবং কেন তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের মৃত্যু দিবসকে “জাতীয় শোক দিবস” পালনের পরিবর্তে ১০ নভেম্বরকে পালন করে “চাকমা জাতির জাতীয় শোক দিবস” হিসেবে! হায়রে এতো দেখছি একই দেশের মধ্যে আরেক দেশ!

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন