বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চার হাজার বছরের প্রাচীন জনপদের কথা

উয়ারী-বটেশ্বর প্রাচীন জনপদখোঁড়ার কাজ দেখতে বেশ লাগে_কোথায় যেন কি ঠক করে লাগে! সবাই টান টান হয়ে যায়। কিছু বুঝি পাওয়া গেল! স্যার এসে মাঝেমধ্যে বলে যান ওভাবে গাঁইতি মেরো না, এখানে মাটি নরম, খুন্তি চালাও। আরেক দল খুঁড়ে পাওয়া মাটির চাড়া, পুঁতি, আংটা ধুয়ে-মুছে ছোট ছোট প্যাকেটে রাখছে, প্যাকেটের গায়ে নম্বর ঝুলিয়ে দিচ্ছে। ধারণা করা হয় বটেশ্বরে এক পরাক্রমশালী জনগোষ্ঠী বাস করত। তাঁরা গ্রিক বীর আলেকজান্ডারকেও ধরাশায়ী করেছে। তাঁদের বলা হয় গঙ্গড়িঢ়ি।

সীমান্ত দীপু:

সকালে পুব আকাশে কোত্থেকে যেন মেঘ এল। কপালে ভাঁজ পড়ল। কত দিন ধরে ভেবে রেখেছি নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর যাব, প্রাচীন ধূলিমাখা পথে নিজেকে আবিষ্কার করব অন্যভাবে। আর আজই কি না আকাশের মুখ ভার! উয়ারীর পথটা আমার বেশি চেনা নয়। তবে খননকাজের নেতৃত্বদানকারী ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর খনন-সঙ্গীরা আমার সহপাঠী, ইয়ার-দোস্ত। বেশ কয়েক বছর ধরেই তাঁরা বটেশ্বরে খননকাজ করছেন। অনেক দিনই যেতে চেয়েছি কিন্তু ব্যাটে-বলে লাগেনি। হিমু আর শম্পা খুঁড়েফুঁড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গল্প জুড়ত- তারা নাকি সারাক্ষণ কাজ করে, সারাক্ষণ আড্ডা দে। ভাবি গুল মারে। বলি, ‘চাপা কম।’ ওরা বলে, ‘ঠিক আছে দেখে যা।’ শম্পাদের সঙ্গেই যাওয়ার দিন ঠিক হয় এক শুক্রবার। সকাল সকাল উঠে পড়ি। সাফসুতরো হয়ে ৯টায় যাত্রা করি। ততক্ষণে আকাশ হাসতে শুরু করেছে। দু-দলে ভাগ হই আমরা দ্রুতই। একদল পিকআপ ভ্যানে_তাদের সঙ্গে কোদাল, ঝাড়ু, কম্পিউটার, টেন্টসহ আরো অনেক কিছু। আমরা বাকি পাঁচজন একটা মাইক্রোবাসে রওনা হলাম। ঘণ্টা দুই চলার পরই লাল মাটির নিশানায় বুঝে গেলাম নরসিংদীতে পেঁৗছে গেছি। নরসিংদীর মরজাল থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ পেরোলে উপমহাদেশের প্রাচীন দুটি গ্রাম। মরজাল থেকে প্রথমে যাব বটেশ্বর স্কুলে। এক বন্ধুকে নিয়ে আমি রিকশায় চড়ে বসলাম। বটেশ্বরের রাঙা পথ মাড়াই আর ভাবি আড়াই হাজার বছর আগেও এখানে জীবন ছিল।

ঘন জলপাই বন এবং কাঁঠাল ও লটকন গাছের ফাঁকে ফাঁকে রিকশা চলছে। রাস্তা ছোট কিন্তু শেষ হয় না_এ এক মজা বটে। অবশেষে বটেশ্বর বাজারে বন্ধুদের দেখা পেয়ে হাঁফ ছাড়লাম। পিকআপ ভ্যান থেকে গাঁইতি নিয়ে বন্ধুরা ছুটল পুরানের টানে। খোঁড়ার কাজ দেখতে বেশ লাগে_কোথায় যেন কি ঠক করে লাগে! সবাই টান টান হয়ে যায়। কিছু বুঝি পাওয়া গেল! স্যার এসে মাঝেমধ্যে বলে যান ওভাবে গাঁইতি মেরো না, এখানে মাটি নরম, খুন্তি চালাও। আরেক দল খুঁড়ে পাওয়া মাটির চাড়া, পুঁতি, আংটা ধুয়ে-মুছে ছোট ছোট প্যাকেটে রাখছে, প্যাকেটের গায়ে নম্বর ঝুলিয়ে দিচ্ছে। অন্য আরেক দল প্যাকেট ও নম্বর দেখে ভাগ ভাগ করে রাখছে। ধারণা করা হয় বটেশ্বরে এক পরাক্রমশালী জনগোষ্ঠী বাস করত। তাঁরা গ্রিক বীর আলেকজান্ডারকেও ধরাশায়ী করেছে। তাঁদের বলা হয় গঙ্গারিডি।

নরসিংদীর বেলাব থানা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত দুটি গ্রাম উয়ারী এবং বটেশ্বর। কয়রা নামে পরিচিত একটি শুষ্ক নদী খাত উয়ারী গ্রামের উত্তর দিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এখনো দৃশ্যমান। আড়িয়াল খাঁ নদীটি যেখানে মেঘনার সঙ্গে মিলেছে, সেখান থেকেও প্রত্নস্থানটির দূরত্ব খুবই কম। প্রত্নস্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে হওয়ায় বন্যার কবল থেকে মুক্তই ছিল বোধকরি। গঙ্গারিডির ইতিহাস জানার বাকি আছে এখনো। অনেকটাই যে মাটির নিচে! সেগুলো বের করতেই কাজ করছেন সুফি স্যার ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। দলটি প্রতিবারই নতুন নতুন প্রত্নসম্পদ খুঁড়ে বের করছে। এগুলোর অন্যতম অ্যাগেট, জেসপার, কোয়ার্টজ, অ্যামেথিস্ট ইত্যাদি পাথরের পুঁতি বা মন্ত্রপূত কবচ। এসব পাথর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাওয়া যায় না। বাইরের কোনো দেশ থেকে এসে থাকবে। তবে পাথর কেটে পুঁতিগুলো তৈরি করেছিল এখানকার কারিগররাই। উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রগুলো থেকে সে সময়ের খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সমপ্রতি মনে করা হচ্ছে, উয়ারী-বটেশ্বর গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি বর্ণিত বাণিজ্য-কেন্দ্র সৌনাগড়া।

শুধু দুর্গপ্রাচীর ও পরিখা ঘেরা দুর্গ-নগরীই নয়, চুন-সুরকির রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, প্রাপ্ত পোড়ামাটির মিসাইল_সব যেন উন্নত নগর পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার লক্ষণ। ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় এ নগরীর যোগাযোগ ছিল সমুদ্র আর নদীপথ ধরে ভারতবর্ষ, রোম আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। সুরক্ষিত তো হতে হবেই এ নগরটিকে। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দুর্গ প্রাচীর ও পরিখা।
উয়ারী-বটেশ্বরে গর্ত-বসতি পাওয়ায় পুরো উপমহাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে বলে শুনেছি। সেদিকে গিয়ে দেখলাম একটি গর্ত-গুহার মধ্যে মানুষের শোবার জায়গা। আর তার সঙ্গেই আছে রান্নাঘর। আজ থেকে চার হাজার বছর আগের মানুষরা এমন বসতি করত বলে সুফি স্যার জানালেন। ভারতের মহারাষ্ট্রের ইনামগাঁও প্রত্নস্থানেও অনুরূপ একটি গর্ত-বসতির সন্ধান পাওয়া যায়। যদি সত্যিই এটি গর্ত-বসতি হয়, তবে বাংলার প্রাচীন জনপদ হবে চার হাজারেরও বেশি পুরনো। সামপ্রতিক সময়ে প্রাপ্ত পিরামিডের উল্টো আকৃতিতে তৈরি একটি স্থাপনা সবার আগ্রহ তৈরি করেছে। ইটের এই কাঠামোটি কোন কাজে বা কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো, তা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে।

শেষ বিকেলে দেখতে গেলাম হাবিবুল্লা পাঠানের প্রত্ন জাদুঘরটি। চমকে গেলাম এর সংগ্রহ দেখে। উয়ারী-বটেশ্বর বিরাট প্রত্নভাণ্ডার, পাঠানের জাদুঘর তার খানিকটা ধরে রেখেছে এবং তাতেই মাত হয়ে গেলাম।

♦ পার্বত্য নিউজে বাংলাদেশ আদিবাসী বিষয়ক প্রবল বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রাচীন জনগোষ্ঠী কিম্বা প্রি কলোনিয়াল জনগোষ্ঠী বিতর্কের সমাধানে উয়ারী বটেশ্বর একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। সে বিবেচনায় কালের কণ্ঠের সৌজন্যে লেখাটি পার্বত্য নিউজে প্রকাশিত হলো- বিভাগীয় সম্পাদক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme/ar_framework/functions_custom.php on line 255
আরও পড়ুন