মিঠুন চাকমার মৃত্যু এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাজনীতির স্বরূপ

ইউসুফ হায়দার:

গত ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে প্রসীত বিকাশ চাকমার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সংগঠক মিঠুন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, ৩ জানুয়ারি কোর্টে হাজিরা শেষে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নিজ বাড়িতে গেলে একদল সশস্ত্রসন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।পথিমধ্যে স্লুইচগেইট এলাকায় নিয়ে সন্ত্রাসীরা তার পেটে ও মাথায় গুলি করে ফেলে রেখে যায়।সেখান থেকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২০০১ সালে ইউনাইটেড পিপলসডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক যুবফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মিঠুন চাকমা। সর্বশেষ ইউপিডিএফের মূল সংগঠনের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।

ইউপিডিএফ এবং বামপন্থীদের অভিযোগ:
মিঠুন চাকমা নিহত হওয়ার পর থেকেই তার সংগঠন ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু নেতাকর্মী মিলে সদ্য গঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের কর্মীরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে তাদের মদদ যুগিয়েছে সেনাবাহিনী। অপরদিকে, ইউপিডিএফের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত কিছু বামপন্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কর্মসূচি দিয়ে মিঠুন চাকমার হত্যার পেছনে কলকাঠি নাড়ার জন্য সরাসরি আঙ্গুল তোলা হয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দিকে। এই নিয়ে বিডিনিউজ২৪.কমের করা একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘মিঠুন চাকমা হত্যাকাণ্ড সেনা মদদে, অভিযোগ বামপন্থিদের’। ৫ জানুয়ারি শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল আয়োজিত এক বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দুর্বৃত্ত দিয়ে মিঠুন চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করেছে।প্রতিবাদী কথা বললেই আপনিও আক্রান্ত হবেন।’

সেখানে উপস্থিত বাম নেতারা যে যার মতো করে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, খাগড়াছড়িতে এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ইউপিডিএফ বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, অবরোধের মতো নানা কর্মসূচি পালন করছে। এই নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যগুলোতেও চলছে তুমুল আলোচনা। এমনকি এ ব্যাপারে সরব হয়ে উঠেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনও।

ঘটনা যাইহোক, যাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ সেই ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, মিঠুন চাকমার মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়, বরং ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ কলহের জেরেই তাকে হত্যা করেছে তারই দলের কর্মীরা।

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের বক্তব্য:
ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের নেতা মিঠুন চাকমা নিহত হওয়ার ব্যাপারে ইউপিডিএফ (প্রসীতপন্থীর) নেতা/কর্মী এবং সমর্থকরা সম্পূর্ন আবেগী ভাষায় বস্তুনিষ্ঠ, তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই তাদের মনগড়া মন্তব্য, বক্তব্য, ফেইসবুকসহবিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার করে নতুন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির উপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তাদের এই দায় চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমাদের জরুরী বক্তব্য এই, আপনারা জানেন গত ১৫ নভেম্বর-২০১৭ তারিখে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে যারা আত্মপ্রকাশ করে ছিলাম, আমরা সবাই ইউপিডিএফ প্রসীত দলে সম্পৃক্ত ছিলাম। মতাদর্শ মিল না হওয়ার কারণে জুম্ম জাতীয় স্বার্থে এবং সচেতন জুম্ম জনগনের পরামর্শে ও অনুপ্রেরণায় নতুন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টি আত্মপ্রকাশ করা হয়েছে।

কাজেই এই মহান পার্টি হানাহানি, মারামারি, প্রতিহিংসার রাজনীতি বিশ্বাস করে না বিধায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের নেতা মিঠুন চাকমা নিহত হওয়ার ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য না করে আমাদের পার্টি ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলাম। পর্যবেক্ষণে থেকে যেটা পাওয়া গেল মিঠুন চাকমা ইউপিডিএফ প্রসীত দলের অন্তঃকলহে নিহত হয়েছেন। এতে নতুন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টি কোন মতে জড়িত নয়। কারণ, আমরা যতটুকু জানি মিঠুন চাকমা একজন কট্টরবাদী, উদীয়মান নেতা ছিলেন।

ইউপিডিএফ প্রসীত দলের কোন নেতাকে সমালোচনা থেকে বাদ দেন না এবং কি দলের সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসাকেও না। তিনি খুবই স্পষ্টবাদী এবং বাস্তববাদী নেতা হিসেবে কর্মীদের কাছে পরিচিত ছিলেন। আমাদের পার্টি ৩ নভেম্বর-২০১৭ তারিখে পার্বত্যবাসীর উদ্দেশে প্রসীত পন্থীর ইউপিডিএফ এর ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়ম বিষয়ে যে খোলা চিঠি লিখেছিলাম, সেই খোলা চিঠির ৯ পৃষ্ঠায় ২নং লাইনে মিঠুন চাকমার যোগ্যতার কথা কিঞ্চিত উল্লেখ করেছিলাম।

নিহত মিঠুন চাকমাসহ প্রসীত পন্থীর অনেক নেতা কর্মীর মামলা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ যোগ্য মামলা রয়েছে মিঠুন চাকমা, প্রদীপন খীসা ও সচিব চাকমাদের এবং সচিব চাকমারা কয়েকবার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে ধরাও পড়েন। দীর্ঘ কয়েক বছর জেল খাটার পর সচিব চাকমারা জামিনে বেরিয়ে আসলেও মামলায় নিয়মিত হাজিরা না দেওয়ার কারণে সচিব চাকমারা আবার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী হয়ে যান। তারা কোন মামলায় হাজিরা দেন না।

কিন্তু ২০১৩ সালে মিঠুন চাকমাকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ থেকে ইউপিডিএফ এর উন্নীত করে, ডাইরেক্ট বাঘাইছড়ি সাজাই এলাকায় পোষ্ট পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। এতে পঞ্চম শ্রেণীর পাশ কাঞ্চন চাকমা (জুয়েল) মানতে না পেরে পরিচালক মিঠুন চাকমার উপর নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। যার কারণে মিঠুন চাকমা ইউপিডিএফ -র কাজ করবেন না ঘোষণা দিয়ে তার নিজ বাড়িতে চলে আসেন। তাকে আবার ছলে-বলে, কৌশলে ইউপিডিএফ -এ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সচিব চাকমারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

তাতে ব্যর্থ হয়ে খুবই সুকৌশলে মিঠুন চাকমাকে সচিব চাকমারা সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন। সেনা বাহিনী মিঠুন চাকমাকে ধরে জেল হাজতে দিলেও তিনি খুবই অল্প সময়ের মধ্যে জেল থেকে সাড়া পেয়ে থাকেন। এতে আবার সচিব চাকমাদের সন্দেহ হয়, মিঠুন চাকমা নিশ্চয় অতি গোপনে সরকারের কাছে চুক্তি করে জেল থেকে বেরিয়ে আসলেন কিনা?

আমরা যখন ২০১৭ সালে ১৫ নভেম্বর তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির ঘোষণা করলাম প্রসীত পন্থী ইউপিডিএফ তাৎক্ষণিক ভাবে খাগড়াছড়ির স্বর্নিভর এলাকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করেছিলেন এবং ১৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে সড়ক অবরোধ করলেন। এরপর ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির বিরুদ্ধে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, যুব ফোরামকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য সচিব চাকমা, মিঠুন চাকমাকে ফোন করে বলেছিলেন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির বিরুদ্ধে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, যুব ফোরামকে সংগঠিত করে খাগড়াছড়ি ধর্মপুর এলাকায় এসে বক্তব্য দিয়ে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু সে দিন সচিব চাকমার কথায় মিঠনু চাকমা অপরাগতা প্রকাশ করেছিলেন এবং নতুন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির পক্ষে যায় এমন দু-একটি কথাও সচিব চাকমাকে মিঠুন চাকমা বলেছিলেন। এতে সচিব চাকমা মিঠুন চাকমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর থেকে মিঠুন চাকমাকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর পক্ষে মনে করেই মিঠুন চাকমাকে হত্যার সুযোগ খোঁজেন সচিব চাকমা।

কারণ, সচিব চাকমা একজন ক্ষমাহীন, আদর্শহীন ও প্রতিশোধপরায়ণ নেতা হিসেবে সকল কর্মীদের কাছে পরিচিত। আমাদের ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টির কার্যক্রমের মেয়াদ এখনো দুই মাসের অধিক হতে চলেছে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন শক্তি অর্জন হয়নি যে, দিন-দুপুরে এভাবে মিঠুন চাকমাকে হত্যা করা যাবে। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টিকে অংকুরে বিনষ্ট করার জন্য ইউপিডিএফ প্রসীত পন্থীর নেতারা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমন কি, নিজের দলের নেতা কর্মীদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না।

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টি মিঠুন চাকমার নিহত হওয়ার ঘটনায় কোনোমতে জড়িত নয় এবং মিঠুন চাকমার হত্যাকারী যেই হোক না কেন, তাকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে শাস্তি প্রদান করা হোক ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্টি দাবি জানাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাজনীতির শিকার হয়েছে অনেক নেতাকর্মী:
ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতির সত্য-মিথ্যা আমাদের জানা নেই। তাই সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করছি না। তবে এটা সত্য যে, দলের প্রয়োজনে ইউপিডিএফ ইতিপূর্বে তাদেরই অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। তারপর সেই দায় কোনো কোনোভাবে সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করেছে। তাদের সেই অপকৌশলের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সুমনচাকমা, স্টালিনচাকমা, পরাক্রম চাকমা, দম্বা চাকমা, দিবাকর চাকমা, সংগ্রাম চাকমা, কিশোর মোহন চাকমা, দুর্জয় চাকমা, বরুণ চাকমা, জ্যোতি বিকাশ চাকমা, দেব বিকাশ চাকমা, স্টেন চাকমা, জেনেল চাকমা, সাজেকে বীর চাকমা, তুহিন চাকমা, তনদ্রুং চাকমা ও রাহুল চাকমাসহ আরও অনেককেই। যারা কিনা এক সময় ইউপিডিএফেরই একনিষ্ঠ কর্মী বা নেতা ছিলেন। তখন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ছিল না বলে এসব নেতাকর্মীদের হত্যার পর কোনটা হয়তো একেবারেই চেপে যাওয়া হতো আবার কোনটার দায় চাপানো হতো জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের বিরুদ্ধে কিংবা বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর দিকে আঙ্গুল তোলা হতো।

একইভাবে খাগড়াছড়িতে প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় নিরীহ ছাত্রী ইতি চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপির নেতারা মিলে। পরে এই হত্যার দায় বাঙালীদের উপর চাপিয়ে হত্যাকারীরাই খাগড়াছড়ি শহরে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করে। কিন্তু পুলিশী তদন্তে দেখা যায় এই হত্যার সাথে জড়িত ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপির নেতারা। এমনকি তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করলে সকলে পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। কাজেই নিজেরা হত্যা করে অন্যের উপর দোষ চাপানো ইউপিডিএফের বহুল আচরিত স্টাইল। সে জন্যই কিনা জানিনা সামাজিক গণমাধ্যমের দেয়া পাহাড়ীদের পোস্ট থেকে জানা গেছে, মিঠুন চাকমার লাশ তার জন্য তৈরি দলীয় মঞ্চে পাঠাতে তার স্ত্রী ও পরিবার অস্বীকার করেছে। বরং তারা পারিবারিকভাবে দাফনকে শ্রেয়তর মনে করেছে।

মিঠুন চাকমার হত্যার বিষয়ে সেনাবাহিনীর কোনো অনুসন্ধান বা বক্তব্য আছে কিনা জানি না। তবে দৈনিক নয়াদিগন্তের অনলাইন ভার্সনে ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “ইউপিডিএফের অন্তর্কোন্দলে খুন হয়েছেন মিঠুন চাকমা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যে তথ্য-উপাত্ত পৌঁছেছে তাতে এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।সরাসরি কারা খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেব্যাপারেও এখনো কোনো তথ্য নেই ঘটনার তদন্ত কারীদের হাতে।এদিকে মিঠুন হত্যায় ইউপিডিএফের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দুষে আসছে।এদিকে ঘটনার তিন দিন পরেও থানায় কোনো মামলা হয়নি।খাগড়াছড়ির এসপি আলী আহম্মদ খান বলেছেন, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মিঠুনের স্বজনেরা মামলা করছেন না।”

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায় অপরাজনীতির স্বরূপ:
ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও ঘটনার ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে বলা যায়; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা হলো ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ব পর্যন্ত একটি মাত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের উপস্থিতিই ছিল, মূল সংগঠন ছিল জেএসএস, আর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম ছিল শান্তিবাহিনী। তবে জেএসএসের সকল সদস্যই শান্তিবাহিনীর কর্মাকাণ্ডের সাথে যুক্তছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যাহোক, সেই একটি মাত্র সংগঠন থাকার সময় তারা যে শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ কিংবা বাঙালিদের হত্যা করেছে তা কিন্তু নয়। অনেক পাহাড়িকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকে অনেক হেডম্যান-কার্বারিকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, সামান্য ভুল বুঝাবুঝির কারণে নিজ দলের অনেক নেতাকর্মীকেও হত্যা করা হয়েছে।

চুক্তির পর জেএসএস-কে সরকার এবং সেনাবাহিনীর এজেন্ট আখ্যা দিয়ে একটি গ্রুপ আলাদা হয়ে গঠন করে ইউপিডিএফ। ১৯৯৮ সালে নব্য গঠিত ইউপিডিএফ বিভিন্ন সময় বিবৃতি এবং লিফলেট ছাপিয়ে জেএসএসের নানা অপকর্ম ফাঁস করেছিলো। যা তারা এখনো করে। জেএসএসের পক্ষ থেকে তখন অবশ্য এই ইউপিডিএফকে সেনাবাহিনীর গড়া নব্য সন্ত্রাসবাহিনী আখ্যা দিয়ে তাদের নিঃশেষ করার মিশন শুরু করা হয়। ফলে শুরু হয়ে যায় উভয় গ্রুপের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।পাহাড়ের সকল মানুষই জানে সন্তুষ-গন্ডুষ বাহিনীর মধ্যকার সেই ভয়াবহ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা। তাদের মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষের ফলে উভয় পক্ষের কয়েক শত নেতাকর্মী (সন্ত্রাসী) নিহত হয়েছে। জেএসএস ভেঙ্গে জেএসএস (এম এন লারমা) নামে নতুন একটি গ্রুপ তৈরি হওয়ার পর সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। সম্প্রতি ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে এসে আরেকটি নতুন দল তৈরি হয়েছে, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। আর এর পর থেকেই পাহাড়ে নতুন করে গুম-খুনের মাত্রা বেড়ে গেছে। মিঠুন চাকমার মৃত্যুওটা হলো ঠিক সেই অস্থির সময়টাতেই।

যত দোষ সেনাবাহিনীর:
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকটি গ্রুপই অন্যদেরকে সেনাবাহিনীর দোসর, এজেন্ট বা এই জাতীয় অন্যান্য বিশেষণ দিয়ে দোষারোপ করে থাকে। এটা যদি সত্যই হয়, তাহলে তো এদের সবাই সেনাবাহিনীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা না করে, বরং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে কেউ সরাসরি আবার কেউ আড়ালে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার নীল নকশা নিয়েই আন্দোলন করছে কেন? তাছাড়া সম্প্রতি পাক্ষিক পার্বত্যনিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “নবগঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর আহ্বায়ক তপন কান্তি চাকমা বর্মা এবং সদস্য সচিব জলেয়া চাকমা তরুর করা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসীত-রবির নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নিরন চাকমা পার্বত্যনিউজকে মোবাইল ফোনে জানান, এসব আসলে সবই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ।ইউপিডিএফ শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক একটি দল ছিল, এখনও তাই আছে।……..নিজেদের কর্মী হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউপিডিএফ কখনো হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, হত্যাকারী তো তারাই, নব্য মুখোশ বাহিনীর প্রধান তপন কান্তি চাকমা বর্মার বিরুদ্ধেই তো হত্যার অভিযোগ আছে। সে নিজেই তো ক্যাপ্টেন গাজী হত্যা মামলার আসামি। সে কীভাবে অন্যদের হত্যাকারী দাবি করতে পারে?”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যাপ্টেন গাজী হত্যার মামলার আসামিকে সেনাবাহিনী প্রশ্রয় দেবে কোন যুক্তিতে?

সকলের গুরু এবং পৃষ্ঠপোষক তথাকথিত বামপন্থীরা:
তথাকথিত বামপন্থীদের একটা আঙ্গুল সবসময়ই সেনাবাহিনীর দিকে তোলা থাকে। এটা শুধু পার্বত্য এলাকার ঘটনাগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং, দেশের যে কোনো স্থানের কোন নেতিবাচক ঘটনার সাথে সেনাবাহিনীর নাম জড়িয়ে দিতে পারলেই তারা যেন তৃপ্তি পান। এটা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনি ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লার ক্ষেত্রেও। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে রাজনীতি প্রবেশ করিয়ে দেশের দখল নিতে চেয়েছিলেন এই বামপন্থীরা। কিন্তু তাদের সেই নীল নকশা রুখে দিয়েছিল দেশপ্রেমি সেনাবাহিনী। সেই ব্যর্থতার সাথে সাথেই ধ্বংস হয়ে গেছে বামপন্থীদের মূল শক্তিটা। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে জনগণেরও। তাই সে প্রতিশোধ নিতেই তারা অব্যাহতভাবেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।

এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সৃষ্টির পেছনে একদিকে সেনাবাহিনীকে দায়ী করে, অন্যদিকে তারাই আবার এসব সন্ত্রাসীগ্রুপের বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অতিথি হয়ে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। দ্বিচারী বামপন্থীদের আসলে বিশ্বাস করার কিছু নেই। বরং বলা যায়, পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের জন্য এদের অপরাজনীতিই অনেকাংশে দায়ী। নিজেরা মোড়ল হওয়ার লোভে এক একটি বাম দলের নেতারা পাহাড়ের এক একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে চাঙ্গা রাখে। আর এর শিকার হচ্ছে মিঠুন চাকমাদের মতো মেধাবী তরুণরা।

কিন্তু সেটা কীভাবে? একসময় পাহাড়ে জেএসএস বা শান্তিবাহিনী ছিল না। তবে বাম দল ছিল। রাঙ্গামাটিতে জেএসএস গঠিত হওয়ার আগেই গঠিত হয়েছিল রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি। সেই কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র তৎপরতা। গঠিত হয়েছিল জেএসএস এবং শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনীর উচ্চপদস্থরাই কেবল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেত। সেই কমিউনিস্ট পার্টির মূল শ্লোগানই ছিল মাও সেতুং-এর একটি বাক্য, ‘ক্ষমতা আসে বন্দুকের নল থেকেই’। সেই যে তাদের বন্দুকপ্রীতি শুরু হলো, তা আর শেষ হলো না। জাতীয় পর্যায়ের কিছু ভ্রষ্ট বামের উসকানিতে সেই বন্দুকপ্রীতি কেবল দিনে দিনে বেড়েছেই। কিন্তু বন্দুক যে শত্রু-মিত্র চিনে না, এটা আর তারা কোনদিন বুঝতে পারল না। যার ফল হিসেবে পাহাড়ে, হাজার হাজার বাঙালির পাশাপাশি মরতে হলো শত শত পাহাড়ি সহজ সরল তরুণ-তরুণীকেও, এখনো মরতে হচ্ছে। আজকের মিঠুন চাকমাও সেই ধারাবাহিকতারই শিকার।

সন্ত্রাস ও অপরাজনীতির শিকার মিঠুন চাকমারা:
মিঠুন চাকমা একজন মেধাবী ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। এমনকি সেখানে শিক্ষকতারও সুযোগ পেয়েছিলেন বলে অনেকেই আজ হাহাকার করছেন তার অকাল মৃত্যুতে। অতি আবেগে কেউ কেউ হবিগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত বিএনপি নেতার সন্তানদের আহাজারিকে মিঠুন চাকমার সন্তাদের আহাজারি বলে বুক চাপড়াচ্ছেন। দোষারোপ করছেন সেনাবাহিনীকে, কিন্তু নিজেদের দায়টা এরা কোন দিনই উপলব্ধি করতে পারেন না, এক্ষেত্রেও পারছেন না। মিঠুন চাকমার বিভিন্ন সময়ে লেখাগুলো পড়ে দেখুন, তাতে মনে হবে তিনি যতটা না ইউপিডিএফ কর্মী ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন কমিউনিস্ট। ধারণা করি, কমিউনিস্ট গুরুরাই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে ইউপিডিএফ নেতা হতে প্ররোচিত করেছিলেন। আর সে প্ররোচণাতেই তিনি পাহাড়ে এসে সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র তৎপরতায় যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন পোস্টের চাঁদাবাজির দায়িত্বও পালন করেছেন। ফলে ক্রমান্বয়ে উঠে এসেছেন সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে। তারপর যে কারণেই হোক, তাকে জীবন দিতে হয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতেই।

সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন সে যেখানেই হোকনা কেন, এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের পরিণতি আসলে এমনই হয়, স্বাভাবিক মৃত‌্যুর সুযোগ এদের অল্প সংখ্যকের ভাগ্যেই জোটে। বেশির ভাগেরই জীবন যায় অপঘাতে। হয় নিজ দলের হাতে, না হয় প্রতিপক্ষের হাতে। যেমন রক্ষা পাননি শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা নিজেও। তাকেও জীবন দিতে হয়েছিল নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতেই। ধারণা করি, সন্তু লারমা চুক্তি করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে না এলে এতদিন তিনিও বেঁচে থাকতে পারতেন না। সরকারি নিরাপত্ত্বার মধ্যে না থাকলে জেএসএস (এম এন লারমা) গ্রুপটি প্রতিষ্ঠার মতো কোন এক ঘটনায় হয়তো হারিয়ে যেতে পারতেন এতদিনে। অপরদিকে ইউপিডিএফের প্রতিষ্ঠাতা প্রসীত বিকাশ খীসা সবসময়ই পালিয়ে না থাকলে হয়তো তার পরিণতিও একই হতে পারত এতদিনে।

আসলে এসব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠির নেতাকর্মীদের পরণতি সব দেশে, সব কালে এমনই হয়। এটাই বুঝতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপদগামী সকল সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের। তারা যত দ্রুত এটা বুঝতে পারবে ততই কল্যাণ। আশা করি, তারা সেটা বুঝতে চেষ্টা করবে এবং সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। মিঠুন চাকমার মতো মেধাবী তরুণরা ভুল রাজনীতির শিকার না হয়ে উন্নত জীবনের পথ বেছে নেবে। জাতীয় রাজনীতির হাত ধরে মন্ত্রী, এমপি হবে। কিম্বা নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার মতো নাম করা ব্যুরোক্রাট হবে, প্রশান্ত ত্রিপুরার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

যাইহোক, তারপরও আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিঠুন চাকমার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে এবং আমরা সঠিক কারণটা একদিন জানতে পারব। অন্যদিকে নিরাপত্তাবাহিনীর প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, ভ্রষ্ট বামদের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল সন্ত্রাসী আর চাঁদাজদের সমূলে উৎপাটন করতে যা যা করা দরকার তার সবটুকুই করুন। যদিও এসব সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজরা আমাদের বামপন্থীদের কাছে আদরনীয়, কিন্তু এটাই সত্য যে পাহাড়ে সকল অশান্তির মূল এরাই। তাই এদের নির্মূল করতে পারলেই কেবল পার্বত্যবাসী শান্তির দেখা পাবে। পাহাড়ি-বাঙালি সকলে মিলে-মিশে গড়ে তুলতে পারবে শান্তির স্বর্গ।

লেখক: পার্বত্য বিষয়ক গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন