মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে ঝুলে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

fec-image

বাংলাদেশ-মিয়ানমার একাধিক বার কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না বলে একাধিক রোহিঙ্গা নেতাদের অভিমত।

উপরন্ত মিয়ানমার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করে আসছে। বাংলাদেশ পার্সপোট এন্ড ইমিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লক্ষাধিক।

২৫ আগষ্ট রাখাইনে ৩১টি সেনা ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলার অজুহাত তুলে সেখানকার সেনা, বিজিপি, নাটালা ও উগ্রপন্থি রাখাইন জনগোষ্টি নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও, পুড়াও ও লুটপাটের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গারা এদেশে পালিয়ে আসে। সরকারের আন্তরিক মহানূভবতায় এসব রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে।

এসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সরকার আর্ন্তজাতিক বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সহযোগিতা কামনা করলে বেশি সংখ্যক রাষ্ট্রপ্রধান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর ২০১৭ ইং তারিখে মিয়ানমারের নেপিডোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে ২৩ জানুয়ারী মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম শুরু করার জন্য উভয়পক্ষ একমত পোষন করেন।

২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকা সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রলালয়ের সভা কক্ষে অনুষ্টিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যবাসনের ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ১৬৭৩ পরিবারের ৮০৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. চ সোয়ের হাতে তুলে দেন। এসময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তের শূণ্যরেখায় অবস্থানকারী সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে নেওয়ার ব্যাপারে জোর দিলে মিয়ানমার বিষয়টি পরবর্তীতে আলোচনা সাপেক্ষে জানানো হবে বলে আশ্বস্থ করেন।

২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ায় ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক করেন। বৈঠকে বিভিন্ন আলোচনা শেষে পরবর্তী ২ সপ্তাহের মধ্যে শূণ্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলে উভয় দেশে প্রতিনিধিদল সীমান্তের শূণ্যরেখা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ নাগরিকত্ব সহ ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন।

ওই বছরের ১ মার্চ হঠাৎ করে সকাল থেকে সীমান্তের সৈন্য সমাবেশ, বাংকার খনন, ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমার সৈন্যরা সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করে। এসময় সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যরা পতাকা বৈঠকের আহবান জানান।

২ মার্চ শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ঘুমধুম সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যান্তরে পতাকা বৈঠক অনুষ্টিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে ৭ সদস্যের নেতৃত্ব দেন কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্ণেল মনঞ্জুরুল হাসান খান। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সীমান্তের অস্থিতিশীল পরিবেশের কথা বললে মিয়ানমার তা পুরোপুরি অস্বীকার করে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ তাদের নিয়মিত টহলের অংশ বিশেষ বলে ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সর্বশেষ উভয়পক্ষ ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ দু’দেশের সীমান্তরক্ষী পর্যায়ের যৌথ টহলের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এবং ওই বৈঠকে শূণ্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের আবারো ফিরে নেওয়ার আশ^স্থ করলেও এ পর্যন্তও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন।

কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্প কমিটির সেক্রেটারী মোহাম্মদ নুর জানান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া সফর ও নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের সাথে মত বিনিময় করার পর রোহিঙ্গাদের মাঝে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানারের আর্ন্তরিকতার অভাবে তা ঝুলে আছে। রোহিঙ্গারা বলছে এ মুহুর্তে মিয়ানমারের ফিরে গেলে তাদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার ও আশংখা রয়েছে।

শূণ্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, শূণ্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গারা গ্যাড়াকলে পড়েছে। এদিকেও আসতে পারছেনা, সেদিকেও যেতে পারছেনা। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সেনারা মানছেনা। শূণ্যরেখার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার একাধিকবার কথা দিলেও মিয়ানমার বিভিন্ন কুটকৌশলের কারনে ফেরা সম্ভব হবেনা তাদের।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এত সংখ্যক রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন এখানে রাখা সম্ভব নয়। তাই এদেরকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে চীন সরকারকে প্রতি আহবান জানালে, চীন সরকার মিয়ানমারকে রাজী করানো হবে বলে প্রধানমন্ত্রীকে আশ^াস্থ করেন।

তিনি এসময় আরো বলেন, ইতিপূর্বে একাধিকবার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দিনক্ষণ ঠিক হলেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবের কারনে এখনো পর্যন্ত আলোর মূখ দেখেনি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। তবে দু’দেশের (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) বিরাজমান সু-সম্পর্কের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উখিয়া, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন