রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন প্রতিষ্ঠাই লক্ষ্য

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে। দেশ থেকে তাড়ানোর পর রোহিঙ্গাদের বসতভিটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি মানতে পারছে না সেনা প্রশাসন। প্রবেশে বাধা দিতে সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের দিকে ভারি অস্ত্র তাক করে রেখেছে। তারা ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে। একদিকে পতাকা বৈঠক করছে, অপরদিকে সীমান্তে সৈন্য বাড়াচ্ছে। স্বার্থ উদ্ধারের কৌশলের অংশ হিসেবে এসব করছে। শত উসকানি সত্ত্বেও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি বিশ্ব জনমত ধরে রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করেন কূটনীতিক, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এদের অনেকেই মনে করেন এক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ভূরাজনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে। এই স্বার্থ উদ্ধারে মিয়ানমারের পেছনে আছে অন্য কেউ

চুক্তি মেনে নিচ্ছে না সেনা প্রশাসন: ড. ওয়ালিউর রহমান

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না। তারা নানা অপকৌশলে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে চায়। পাশাপাশি বাকি রোহিঙ্গাদেরও দেশছাড়া করতে চায়। সেনা প্রশাসন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি মেনে নিচ্ছে না।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ওয়ালিউর রহমান এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান এসেছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি’কেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী তিনজন। এ অবস্থায় মিয়ানমারের এ ধরনের সৈন্য সমাবেশের দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, দেশটির সেনাপ্রধান ও সেনা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্ব জনমতের দৃঢ়তায় ভীতসন্ত্রস্ত। এ কারণে তারা সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে থাকতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের প্রশাসন যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো মেনে নিতে পারছে না মিয়ানমারের সেনা প্রশাসন। এ কারণেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থেকে দৃষ্টি সরাতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। তবে যে কারণেই সীমান্তের দেড়শ’ গজের মধ্যে মিয়ানমার সেনা সমাবেশ ঘটাক, তা খুবই দুঃখজনক। এটা দেশটির হঠকারী পদক্ষেপ। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখবে। এ অস্থায় বাংলাদেশকে দক্ষতা এবং ধৈর্যের সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।

সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি কৌশলের অংশ: ড. তারেক শামসুর রেহমান

সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি করা মিয়ানমারের কৌশল বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে না যায়, সে কারণে এ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে

দেশটি। একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিও অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে এর মাধ্যমে। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকা রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানো এবং শূন্যরেখায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে, সেজন্য মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য এসব করছে।

এসব করতে গিয়ে তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তের কাছাকাছি সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে মিয়ানমার কার্যত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, এটা নতুন নয়, এর আগেও মিয়ানমার একাধিকবার ছোটখাটো, তুচ্ছ ঘটনায় সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোসহ নানা ধরনের উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিবারই বাংলাদেশ যথেষ্ট ধৈর্য ও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। আশা করি, এবারও বাংলাদেশ কোনো উসকানিতে বিচলিত হবে না, বরং ধৈর্যের সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে।

ড. শামসুর রেহমান বলেন, তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতেই মিয়ানমার সরকার এ ধরনের কাজ করছে। তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। একধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি পরিস্থিতি ঘোলাটে করে মিয়ানমার সরকার নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মিয়ানমার ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে: মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা

স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মিয়ানমার উসকানি দিচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা। তিনি বলেন, আমি মনে করি, মিয়ানমার একটা উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য একটি ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে। বাড়তি সেনা

মোতায়েনের মাধ্যমে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে বাধ্য করছে। এর মূল কারণ, তারা রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশের পাল্টা আক্রমণ করে মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেয়া ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে ধৈর্যধারণই একমাত্র উপায়।

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের আসল লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়া। এজন্য তারা নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে। এ উসকানির ফলে বাংলাদেশ যদি পাল্টা জবাব দেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। উত্তেজনা সৃষ্টি হলে এদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবে না। অন্যদিকে রাখাইনে থাকা বাকি রোহিঙ্গারাও প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেবে। মিয়ানমারের আসল চাওয়া এটাই।

 

সূত্র: যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন