রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে ছিলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা!

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে ‘মুসলিম নিধন’-এর পক্ষে কাজ করেছেন সেখানকার জাতিসংঘ কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়েন।

রেনাটা রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা করা, শরণার্থী অধিকার নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কথা বলা, রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যেতে বাধা দেয়া, এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টার ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়েছেন যেসব কর্মকর্তা, তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা রোহিঙ্গা সংকটে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা নিয়ে তার সহকর্মীরাও প্রশ্ন তুলেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতর বিবিসির এই রিপোর্টে উঠে আসা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

রেনাটা লক ডেসালিয়েন এর সাবেক কয়েকজন জাতিসংঘ কর্মকর্তা এবং ত্রাণ কর্মী বলেছেন, তিনি জাতিসংঘের অফিসে এমনকি রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো কথা বলতে পর্যন্ত বারণ করেছিলেন।

শরণার্থীদের অধিকারের বিষয় মিয়ানমার সরকারের কাছে উত্থাপনেও তিনি বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মিয়ানমারে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার সূত্রগুলো এই অভিযোগ করেছে।

জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তা আরও অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তা মানবাধিকার কর্মীদের রোহিঙ্গাঅধ্যূষিত এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন।

গত মাসে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে শুরু করে, তখন থেকে এই সংকট মোকাবেলায় সামনের কাতারে আছে জাতিসংঘ। শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েছে এবং মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে।

কিন্তু এই সংকটের পূর্ববর্তী চার বছর ধরে মিয়ানমারে জাতিসংঘের কার্যক্রমের প্রধান রেনাটা লক ডেসালিয়েন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে ভূমিকা পালন করেন, তা নিয়ে অনেক অভিযোগ তুলেছেন তারই সাবেক সহকর্মী এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, রেনাটা লক ডেসালিয়েন এর আগে বাংলাদেশেও জাতিসংঘের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

কানাডার নাগরিক রেনাটা লক ডেসালিয়েনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা, এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টার ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়েছেন যেসব কর্মকর্তা, তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করা।

মিয়ানমারে কাজ করেছেন এমন একজন ত্রাণ কর্মকর্তা ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি জানিয়েছেন, ‘মিয়ানমারে একদল বিদেশি এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা এবং রাখাইন বিষয়ে কথা বলছিল। আমি সেখানে ছিলাম। সেখানে একজন বার্মিজ বলল, রোহিঙ্গারা যদি কুকুরের মতো হয় ওদের সবাইকে মেরে ফেলা উচিত। কোনো সমাজে যখন একটি গোষ্ঠীকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং সেটি যখন সমাজে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়, আমার কাছে এটাই জাতিগত নির্মূল শুরুর একটা আলামত।’

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি জানান, তাকে সবসময় নির্দেশনা দেয়া হতো বৈঠকগুলো যেন এমন সময়ে আয়োজন করা হয় যখন ইউএনওসিএইচএ’র প্রতিনিধি শহরে থাকবেন না। তাকে গণ্ডগোল সৃষ্টিকারী বলে চিহ্নিত করা হয় এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের আশংকা নিয়ে বারবার সতর্ক করায় তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

মিজ ভ্যানডেনাবিলি যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, জাতিসংঘ তার কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে মিয়ানমার সফরে যাওয়া জাতিসংঘ কর্মকর্তাদেরও বারণ করা হতো।

টমাস কুইনটানা এখন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকর্তা। এর আগে তিনি ছয় বছর মিয়ানমার বিষয়ে ওই একই দায়িত্বে ছিলেন। আর্জেন্টিনা থেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।

ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে একবার তার দেখা হয় রেনাটা লক ডেসালিয়েনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, তিনি (রেনাটা) আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপনার উত্তর রাখাইনে যাওয়া উচিত হবে না – দয়া করে ওখানে যাবেন না। আমি তখন জানতে চাইলাম, কেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না। তার অবস্থানটা ছিল এ নিয়ে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় তিনি যেতে চান না।

‘এটা মাত্র একটা ঘটনা। কিন্তু এ থেকে বোঝা যায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারে অবস্থানরত জাতিসংঘ দলের কৌশলটা কী ছিল।’ -যোগ করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকর্তা টমাস কুইনটানা।

তবে রেনাটা লক ডেসালিয়েনের পরামর্শ উপেক্ষা করে মিস্টার কুইনটানা উত্তর রাখাইনে যান এবং এক্ষেত্রে তিনি মিয়ানমারের জাতিসংঘ মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি।

২০১৫ সালে জাতিসংঘ নিজেই মিয়ানমারে তাদের দফতরের কাজ নিয়ে আভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার পর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতরের কাজের কঠোর সমালোচনা আছে।

জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস দায়িত্ব নেয়ার পর তার জন্য তৈরি করা এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘ একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রেনাটা লক ডেসালিয়েন এখনও মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। তার জায়গায় নতুন যে কর্মকর্তার নাম পাঠানো হয়েছিল, মিয়ানমার সরকার তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে মিজ ডেসালিয়েন এখনও তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

রেনাটা লক ডেসালিয়েন এসব বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আর মিয়ানমারে জাতিসংঘের দফতরের একজন মুখপাত্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলার বিষয়ে রেনাটা লক ডেসালিয়েন কোন বাধা দিয়েছেন।

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি মনে করেন, অন্তত তিনি যেসব আগাম সতর্কবাণীর কথা বলেছিলেন, তা আমলে নিলে হয়তো সবাই আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে পারত- কী ঘটতে চলেছে।

একটি সূত্র বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে যেভাবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ কাজ করেছে, তার জন্য একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন