শান্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ

Untitled-110

(চার)
১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির ইতছড়ির জঙ্গলে গড়ে ওঠে শান্তিবাহিনী। যা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা। এই সশস্ত্র শাখার নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় চাকমার ডাক নাম সন্তু লারমা। তার নাম অনুসারেই নামকরণ করা হয় শান্তিবাহিনী। মানবেন্দ্র লারমার আপন ভাই হলেন সন্তু লারমা। এই দুই ভাই-ই শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
মানবেন্দ্র লারমা ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল দাবি আদায়ে সরকারের আশীর্বাদ লাভ করা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তার হিসাব-নিকাশ বদলে যায়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেন। তবে ফলাফল আশাপ্রদ ছিল না। শান্তি বাহিনীর প্রথম সশস্ত্র আক্রমণের কথা শোনা যায় ১৯৭৬ সালের জুন মাসে।
সে সময় বিলাইছড়ি আর্মড পুলিশ ক্যাম্প ও বেতছড়িতে শান্তিবাহিনী দ্বারা একদল পুলিশ আক্রান্ত হয়। একই বছর শান্তিবাহিনীর সামরিক গেরিলা অভিযান শুরু হয়। এরপর পরই সন্তু লারমা ও চবরি মারমা ধরা পড়েন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে। ২০ সেপ্টেম্বর জিয়া সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয় যার সভাপতি এলাকার সামরিক বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) কে করা হয়। তবে চাকমা রাজমাতা বিনীতা রায়কে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়।

১৯৭৬-১৯৮০ সালে শান্তিবাহিনী ও সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে অনেক লড়াই সংগঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে এক লক্ষেরও বেশি দরিদ্র বাঙ্গালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়। এ ধারা ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই জিয়া সরকার ট্রাইবাল কনভেনশন গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থী উপেন্দ্রলাল চাকমা ও স্বতন্ত্র  প্রার্থী অংশু  প্রু  চৌধুরী  জয়লাভ করেন।  ১৯৮০ সালে সংসদে পার্বত্য এলাকাকে উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ঘোষণার বিল বাতিল হয়ে যায়। একই সালে একটি উপজাতীয় প্রতিনিধি দল জিয়ার সাথে দেখা করেন। একই বছরের ২৫ মার্চ বাঙ্গালি পাহাড়ী দাঙ্গায় বহু হতাহত হয়। শান্তিবাহিনীর বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণে অনেক বাঙ্গালির মৃত্যু হয়। ১৯৮১ সালে শান্তি বাহিনীর সাথে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য জিয়া সন্তু লারমা ও চবরি মারমাকে ছেড়ে দেন।

১৯৮১ সালে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের পাহাড়ে জমি ও টাকা দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। ডিসেম্বর মাসে সরকারি উদ্যোগে তাদের ফেরত আনা হয়।
 ১৯৮২ সালের ৯ জানুয়ারি ট্রাইবাল কনভেনশন বান্দরবনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসনের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসলে নতুন সরকারের সাথে বাক-বিতন্ডা করার লক্ষ্য নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে জনসংহতি সমিতির ৯ দিনব্যাপী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্টি মার্কসবাদী ও জাতীয়তাবাদী এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

১৯৮৩ সালের ১৪ জুন থেকে শান্তিবাহিনীর অভ্যন্তরে যুদ্ধ শুরু হয়। একই বছরের ১০ অক্টোবর এরশাদ সরকার শান্তি বাহিনীর সদস্যদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ১০ নভেম্বর প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন এম এন লারমা। এর মধ্যে শান্তি বাহিনীর ভেতর শুরু হয় উপদলীয় কোন্দল। গড়ে ওঠে প্রীতি বাহিনী। প্রীতি বাহিনীর নেতা হলেন প্রীতি লাল চাকমা। ১৯৮৩ সালের জুনে লারমা বাহিনীর হাতে নিহত হয় প্রীতি বাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষক অমৃতলাল চাকমা। এর প্রতিশোধ হিসেবে ঐ বছরের ১০ নভেম্বরে প্রীতি বাহিনী হত্যা করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে। তার কয়েকজন সঙ্গীও ঐ আক্রমণে নিহত হয়।

মানবেন্দ্র লারমা বিরোধী প্রীতি গ্রুপের হাতে নিহত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে আপন অনুজ সন্তু লারমার কাছে তিনি কিছু গোপন রাজনৈতিক চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি সন্তু লারমাকে প্রিয় আদরের চাকমা নাম ‘তুং’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। আর ‘প্রবাহন’ নামটি ব্যবহার করেন নিজে। এক সময়ের রাঙ্গামাটিতে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রবক্তা, মাংসেতুং চিন্তাধারায় প্রভাবিত ‘জুম্ম ল্যান্ড’-এর স্বপ্নদ্রষ্টা গেরিলা নেতা এমএন লারমার গভীর প্রজ্ঞা, পাহাড়ি জনগণের মুক্তির আকুতি, জনসংহতির ভেতরে টানা-পোড়েন ইত্যাদি ফুটে উঠেছে এসব চিঠিতে। কয়েকটি চিঠি ছোট। কয়েকটি আবার তিন/চার পৃষ্ঠার, কি তারও বড়। বেশ কয়েকটি চিঠিতেই সাল, তারিখ বা স্থানের কোন উল্লেখ নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান কোন পথে? তার ধরণইবা কি হবে? শান্তিপূর্ণ, না অশান্তিপূর্ণ, সশস্ত্র বা নিরস্ত্র পন্থায় আসবে কাঙ্ক্ষিত সমাধান? লারমা গ্রুপ বিরোধী সক্রিয় প্রীতি গ্রুপের সঙ্গে কি সমঝোতায় আসা যায় না? এসব বিষয়ে ২৩ মে ১৯৮৩-তে এমএন লারমা, তার ছোট ভাই সহযোদ্ধা সন্তু লারমাকে লিখেছিলেন-

“প্রিয় তুং,
আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ……..তুমি, আমি ও গিরি (প্রীতি) আলোচনা করেছি অনেক। শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান, না অশান্তিপূর্ণভাবে সমাধান- এই দুই পথ থেকে কোন পথ বেছে নেয়া হবে। অনেক কথাই হয়েছিল। তবে যে কথা সবচেয়ে বেশি ছিল- অশান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হলে পূর্ণ সফলতা অবশ্যই প্রয়োজন। এখন তোমরা গিয়ে কি আলোচনা করে ঠিক করেছ, জানি না। অশান্তিপূর্ণ সমাধানের আগে শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটা প্রচেষ্টা নেয়া যায় কিনা, তা তোমরা চিন্তা করেছ কিনা জানি না। তাই এটা চিন্তা করলেও ভাল হবে। যাক, কতো কথা লিখতে হয়। মন বলছে, মনে বার বার আঘাত হানছে, আমাদের আন্দোলনে ভাটা পড়েছে, ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। আর তাছাড়া জৈমিনির (প্রীতি গ্রুপ) আশায় থেকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই কিছু একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, কিছু সময়ের জন্য- শান্তি যদি পাওয়া যেত, তাহলে ভাল হত।
আর বিশেষ কিছু লিখলাম না। ইতি- প্রবাহন
বিঃদ্রঃ তুমি আর আমি লক্ষ্য। তাই ধীর কৌশলে অবস্থার সাথে এগিয়ে চলাই আমাদের উচিত হবে।”

একদিকে বিরোধী প্রীতি-গ্রুপ মাঝে মাঝেই চোরা-গুপ্তা হামলা চালাচ্ছে শান্তি বাহিনীর লারমা গ্রুপের অস্থায়ী হাইড-আউটগুলোতে; অন্যদিকে হাজার হাজার সেনাবাহিনীও তৎপর। এ পরিস্থিতিতে মাওবাদী এমএন লারমা চেয়েছেন ‘বিপরীত দ্বন্দ্বের ঐক্য।’ তিনি চেয়েছেন ‘সমালোচনা-ঐক্য-সমালোচনা’- এই সূত্রে প্রীতি-গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতা। এ নিয়ে যোগাযোগও চলছিল দু’পক্ষের।

এসব বিষয়ে পরবর্তী চিঠিতে তিনি লিখেছেন-
“প্রিয় তুং,
…….. সমস্যা সমাধান সম্পর্কে যে কথা হলো, যাহা সেও (প্রীতি) নিজে বললো, তাহা হচ্ছে- ক. প্রথমে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধী প্রচার বন্ধ করা, যাতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, খ. কার্যকর পরিষদের বৈঠক করানো, গ. সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বৈঠক এবং ঘ. সর্বশেষে- কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। এসব আমিও বলেছি এবং সেও বলেছে।
এছাড়া তাকে বলেছি- “বিশেষ সেক্টরের শ্রী পলাশকে (প্রীতি গ্রুপের নেতা) কেন্দ্রের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থায় তুমি আনতে পারবে কিনা?” উত্তরে সে বলেছে “পারবো অথবা পারবো না”- এরকম প্রতিশ্র“তি দেওয়া কঠিন। কারণ শ্রী পলাশ তো একা নয়। তাকে কেন্দ্র করে আরো রয়েছে। তবে আমি চেষ্টা করবো।”…..

১৯৮৩ সালের মে’র শেষ সপ্তাহে প্রীতি-গ্রুপ ও লারমা-গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা বৈঠকের বিষয়ে অগ্রগতি হয়। এমএন লারমা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সন্তু লারমাকে প্রথমে পাঠাবেন প্রীতি-গ্রুপ প্রধান, তৎকালীন বিভক্ত শান্তি বাহিনীর একাংশের কমান্ডার প্রীতি কুমার চাকমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে। এ প্রসঙ্গে সন্তু লারমাকে পরামর্শ দিয়ে ৩১ মে ১৯৮৩ সালে তিনি লেখেন-
“প্রিয় তুং,
 আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বিশেষ এই- শ্রীগিরি (প্রীতি) সেখানে আসছে। তার সঙ্গে তুমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। উত্তেজিতভাবে অথবা কোন বিষয়ে কথা বলতে বলতে উত্তেজিতভাবে উত্তর দিও না। কৌশলগতভাবে এবং কূটনীতির কৌশল প্রয়োগ করে অবশ্যই কথা বলবে……..শ্রীগিরির সাথে সেখানের অন্য সঙ্গীরা যাতে স্বাভাবিক ব্যবহার করে, তার ব্যবস্থা করবে। অস্বাভাবিক ব্যবহার করে লাভ হবে না……..এই আমার অনুরোধ থাকলো। অর্থাৎ সে যাতে অনুভব না করে যে তাকে কোন কিছু করা হবে…….তোমাকে গতবার একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম……..তুমি তার সঙ্গে সাবধানে ও সতর্কতার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে- যাতে সে নিজেকে স্বাভাবিক ব্যবস্থায় সেখানে ধরে রাখতে পারে………একটা কথা মনে রাখবে- আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। জৈমিনি (প্রীতি-গ্রুপ) সরে যাবার জন্যই একাজ করতে পারে- অথবা বাংলাদেশ সরকার পার্টির অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে এসব করছে। তবে কোনটি সঠিক বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এটা বাস্তব সত্যি যে, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি।
তাই কথা বেফাঁসে শ্রীগিরির নিকট বলা উচিত হবে না। বিশেষ করে জৈমিনি সম্পর্কে। জৈমিনি Paid agent যে হয়নি, এটা সন্দেহের বাইরে নয়।
জৈমিনি Wait and see বললে পার্টির (জনসংহতি সমিতি) ভাঙন না হোক বাহ্যিকভাবে, আসলে যে কাজই হবে। সুতরাং পার্টি যাতে না ভাঙে তজ্জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য ত্যাগ স্বীকার আমার ও তোমার করতে হবে। যদি পার্টির দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়, আমরা সরে যাবো- এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই হোক আমাদের……….ইতি- প্রবাহন “

জনসংহতি, তথা এর সামরিক বিভাগ শান্তি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঠেকাতে এমএন লারমা সচেষ্ট ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এরশাদ সরকারের সঙ্গেও শান্তি-সংলাপ বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তারিখবিহীন এর পরের চিঠিতে ‘প্রিয় তুং’ কে তিনি লিখেন-

“………বারবার একই কথা হচ্ছে- তুমিও অধৈর্য ও অসহিষ্ণু হয়ো না। এই জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হবে। পার্টির স্থিতিশীলতা আসার পর ঠিক করতে হবে- আন্দোলন চলবে না আন্দোলন স্থগিত হবে। আন্দোলন চললে অর্থ ও খাদ্য, আশ্রয় ও অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলো পূরণ হবে কিনা- সবই যাচাই করতে হবে। তাই আন্দোলন স্থগিত হবে বলে যখন-তখন তো তা করা যাবে না। যাতে বাংলাদেশ সরকার সহানুভূতি সহকারে গ্রহণ করে তজ্জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েই তবে আন্দোলন স্থগিত করা সম্ভব হবে। অর্থ ও খাদ্য আমাদের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটা প্রত্যেক কর্মীকেও অনুভব করতে হবে। শুধু আবেগপ্রবণ হয়ে বিবেক সায় দেয় না বলে কঠোর হওয়া যাবে না, বাস্তবতাকেই মানতে হবে। অর্থ ও খাদ্য সংকট এড়াতে পারলে টিকে থাকা সম্ভব এটা বুঝি।
তাই সার সংক্ষেপ হচ্ছে- বর্তমান সমস্যা সমাধানে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আন্দোলন চলবে না থামবে। কারণ জৈমিনির আশায় থাকা যাবে না। অর্থ সাহায্য নেই, পশ্চাদভূমির সাহায্য নেই, জৈমিনি এলাকায় যুদ্ধ করতে পারবো না, আমাদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ, কোনও কাজ স্বাধীনভাবে করা যাবে না, তাদের (জৈমিনি বা প্রীতি-গ্রুপকে) জানিয়েই করতে হবে। তাছাড়া তারা agent, যতই দিন আসবে, ততই পার্টিতে অনুপ্রবেশ করবে এবং ভেজাল সৃষ্টি করবে। তাছাড়া জৈমিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা প্রকাশ্যভাবে তুলে ধরবে না, গোপনেই সাহায্য করবে। যখন-তখন সাহায্য প্রত্যাহার করবে। ……..কংগ্রেস ক্ষমতায় এনে সাহায্য প্রত্যাহার না করলেও Wait and see নামে তা প্রত্যাহার করে নিলো- এটা কি Psychological সাংঘাতিক আঘাত নয়, সুতরাং জৈমিনির ভরসায় আন্দোলন টিকিয়ে রাখার মানসিকতা থাকা উচিত হবে না, তোমার ধারণা কি জানি না। তবে আমার অভিমত হচ্ছে এই……… “

এরপরের চিঠিতে এমএন লারমা প্রকাশ করেন জনসংহতির আদর্শিক অবস্থানের কথা। একই চিঠিতে ফুটে উঠেছে গেরিলা জীবনের করুণ কাহিনী-
 “……….একটা কথা হচ্ছে- আমরা সংগ্রাম করছি আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখার জন্য। আমাদের জাতি তো আর ধ্বংস হচ্ছে না। ধ্বংস হচ্ছে রাজনৈতিক অস্তিত্ব। এই দোষ কার? এটা কি আমাদের? কখনই না? এ জন্য ১৯৪৭ সালই দায়ী। ১৯৪৭ সালই আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। তাই এসব বিচার করে আমাদের ঠিক করে নিতে হবে পার্টির বর্তমান সমস্যা সমাধানের পর ভাবাবেগ নয়, বাস্তবতার নিরিখেই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের মধ্যে একদল বাড়িতে ফিরতে পারবে এবং খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু আরেক দল, অর্থাৎ আমাদের মতো যারা, তাদের অবস্থা কি হবে, ভেবে দেখা উচিত হবে। চাকরি করার সময় চলে গিয়েছে, কাজ-কর্ম করে খাওয়ার বয়স চলে গিয়েছে- আমাদের কি হবে, তা বিচার করতে হবে। তাই বাস্তবতার নিরিখেই সিদ্ধান্তে যেতে হবে পার্টির বর্তমান সমস্যা সমাধানের পর। জৈমিনির আশ্বাস নিয়েও থাকা যাবে না, যদি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- এই মৌলিক উপাদানের গ্যারান্টি কারো কাছ থেকে না পাওয়া যায়। আমরা Terrorist নই। আমরা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থাৎ জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে সংগ্রামী। আমরা কারো Terrorist হবো না, হতেও চাই না।…….. “

চিঠি সর্বশেষ: এমএন লারমা লিখেছেন-

“প্রিয় তুং,………বিকেলের দিকে শ্রীগিরির সঙ্গে যা কথা হলো এবং শ্রীগিরি যা বলবো সবই মি: বিজয়ের সঙ্গে আলোচনার কথা। মিঃ বিজয় আমাকে বলেছিলেন- তিনি তাদের (গিরি বা প্রীতি-গ্রুপ) সাথে কথা বলবেন কিনা সমস্যা সম্পর্কে। আমি তাকে বলেছিলাম- সমস্যা সমাধানে সাহায্য কেউ যদি করে থাকেন, তাহলে সবাই তাকে প্রশংসা করবে। তাই মনে হয় মি. বিজয় কথা বলেছেন এবং এজন্য শ্রীগিরির কথার সুর নরম, আপোসমূলক এবং ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে। তাই এজন্য তোমরা যারা সেখানে রয়েছো, সমস্যা সম্পর্কে কথা বলবে, কিন্তু এখন তুমিও দায়ী, তোমাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে-ইত্যাদি কথা যেন বলা না হয়। সমস্যা সম্পর্কে কথা বলতে হবে, তার বক্তব্য কি বলার সুযোগ দিতে হবে।
গতকাল রাতে বিবিসি’র খবর শুনলাম। জনসংহতি সমিতির ঘোষণাপত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীগিরি তাহা শুনে বলে উঠেছে- ঐ ঘোষণাপত্রখানা ছাপানো যায় কিনা। তাকে কেউ জবাব দেয়নি। সুতরাং সে বিষয়ে হয়তো সে খোঁজ নিতে পারে। ঘোষণাপত্রের কোন সংখ্যা সে হয়তো পায়নি। তাকে পড়তে না দেওয়াই ভালো। আর ঐ ছাপানো ইংরেজি Leaflet তাকে পড়তে দেওয়াটাই উচিত হবে না।
অনেক কথা বলার থাকে, লিখার থাকে। সর্বশেষ এই- শ্রীগিরিকে যেন ঘরে রয়েছে, এরকম পরিবেশে রাখার চেষ্টা করা হয়। যাতে সে মনে না করে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে Charge করে এমন যেন কেউ কথা না বলে। বিশেষ সেক্টরের (শান্তি বাহিনীর) সমস্যার সমাধান হলেই তবে খোলাখুলি কথা বলা হবে।

সর্বশেষে আর একটি কথা এই- যদি কাজের অসুবিধা হয়, তাহলে ঐ কর্মসূচি পরিবর্তন করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথটা অনুসরণ করতে হবে। তাই কোনটাই দেরী করা উচিত হবে না।
আর বিশেষ কি। আমরা ভালো। ইতি- প্রবাহন “ [সূত্রঃ বিপ্লব রহমান, প্রবাহ, দৈনিক মুক্তকন্ঠ ১৩ নভেম্বর ১৯৯৭]মানবেন্দ্র লারমার মৃত্যুর পর জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলে আসেন সন্তু লারমা। মানবেন্দ্র লারমাকে হত্যার পর প্রীতি চাকমা ভারতের আগরতলায় চলে যান। যার বাহিনীর অনেকেই পরবর্তীতে আত্মসমর্পণ করে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment
আরও পড়ুন