“যে সন্তু লারমা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করলো সেই সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে আজও চাঁদা দিতে হয়।”

সত্যের সন্ধানে, আলোর পথে; আর দিশা হারাতে চাইনা

fec-image

 

[পিন্দু রঞ্জন চাকমা আমার বাবা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন উনি। বাবা তাঁর শৈশব-কৈশরের অনেক গল্প আমাদেরকে শোনান। আমার বাবা ছিলেন তৎকালীন শান্তিবাহিনীর একজন সদস্য। বাবার সেই সময়কার কিছু স্মৃতিচারণ এবং বুকের ভীতর পুষে রাখা ক্ষোভ, অভিমান আর বর্তমান প্রত্যাশা নিয়ে বাবার বলা কথাগুলোকে আমি লেখায় রুপ দিয়েছি। শুভেচ্ছান্তে… অমিত রঞ্জন চাকমা]

আমার আজও মনে পড়ে ২ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালের সেই দিনের কথা। জলপাই রঙের একটা পোশাক পরে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে বসে ছিলাম। হাতে ছিলো একটা অস্ত্র। সরকারের কাছে জমা দিবো সেটা। আনন্দ মুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে। আমি নিজেও আনন্দিত ছিলাম। কারণ বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে ঐ গেরিলা জীবন আমার আর ভাল লাগছিলো না। শুধু ভাবতাম, কবে বন্ধ হবে এই গরিলা জীবন। নিজ মাতৃভূমিতে বসে নিজ দেশের ভাই-বোনদেরকে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মত খারাপ কাজ করতে এবং রক্তের হোলিখেলা দেখতে মোটেও ভালো লাগছিল না আর।

গেরিলা জীবনে কত যে দুর্বিসহ দিন রাত কাটিয়েছি, তা বলার মত না। রাতে ঘুমাতে পারতাম না, পরিবারকে ছেড়ে জঙ্গলে বসেবসে আর্তনাদ করতাম। আর প্রতি মুহূর্তে ভয়ে থাকতাম, কখন যে সেনাবাহিনীর টহল এসে পড়ে, কখন যে তাদের কাছে ধরা পড়ে যায়। তবুও বুকে আশা বেঁধে রাখতাম কারণ আমরা জানতাম প্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আমাদের জন্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছে। প্রিয় নেতা যেন সংগ্রামে জয়ী হয় তার জন্য প্রতিটা মুহুর্তে আশির্বাদ করতাম।কিন্তু আজ বুঝতে পারি অধিকার আদায়ের নামে যে সংগ্রামে আমাদেরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলো নেতারা তা ছিলো আসলে মায়াজাল। বাংলাদেশ তো আমাকে সব সুযোগ সুবিধা আর রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক অধিকার দিয়েছে। তাহলে কিসের অধিকারের জন্য আমি লড়াই করছিলাম? কার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম?

আমি শান্তিবাহিনীর একজন প্রকৃত কর্মী ছিলাম। অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে জীবনযাপন করেছি। তেমনি একটা দিন ছিলো ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সাল। ওই দিনে বাড়ির উঠানে বসে আছি। হঠাৎ দেখি বিজু দা (আমরা এক সঙ্গে কাজ করতাম) ছেঁড়া একটা কাপড় পরে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “প্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে মেরে ফেলেছে ওরা”। সংবাদ শুনে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না কখন যে জ্ঞান হারা হয়ে পড়েছিলাম আমি নিজেও জানি না।

যাই হোক, পরে পাহাড়ের বাতাসে একটা কথা ভাসতে লাগল- প্রিয় নেতা মানবেন্দ্র লারমার ভাই সন্তু লারমা তাকে হত্যা করেছে। ক্ষমতার জন্য নিজের ভাইকে হত্যা করেছে সন্তু লারমা। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, অধিকার আদায়ের নামে যে সংগ্রাম আমাদেরকে দিয়ে করাচ্ছে আমাদের নেতারা তা আসলেই মিথ্যার বেড়াজাল। আসলে নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি আর ভোগবিলাসী জীবন যাপন করার জন্যই আমাদেরকে ভুল বুঝিয়ে সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছিলো। এখনো আমাদের পাহাড়ি যুবকদের ভুল বুঝাচ্ছে নেতারা।

যাই হোক, নিজের ভাইকে খুন করে সন্তু লারমা দলের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু প্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অন্ধভক্ত ও অনুসারীরা সন্তু লারমার দায়িত্ব নেওয়াকে মেনে নিতে পারল না। প্রিয় নেতাকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ভিতরে ভিতরে অনেকেই ক্ষোভ পুষে রেখেছে।

নিরাপত্তার কারণে আমি আমার সম্পূর্ণ পরিচয় দিচ্ছি না। তাহলে আজ রাতেই আমাকে লাশ হতে হবে। যে লোক ক্ষমতার জন্য নিজের ভাইকে খুন করতে পারে তার পক্ষে আমার মত একজন সাধারণ জুম্মকে খুন করা কোন ব্যাপারই না। তবুও সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিচ্ছি। শান্তিবাহিনীতে থাকাকালীন আমাকে সবাই পিন্দু নামে চিনতো। খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় আমার বসবাস।

যাই হোক, আমার লেখা শুরু করেছিলাম খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দেবার স্মৃতিচারণ করে। সেখানে আবার ফিরে যাই। সেদিন অস্ত্র জমা দিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। ভেবেছিলাম পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হবে। শান্তিতে থাকতে পারবো আমরা। কিন্তু আজও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।

যেই লোক শান্তিচুক্তি করেছিলো সে সন্তু লারমা এখনো পাহাড়ে রক্তপাত ঘটাচ্ছে। আজও পাহাড়ের বাতাসে লাশের গন্ধ।  স্বাধীন দেশে বসবাস করেও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছিনা। যে সন্তু লারমা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করলো সেই সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে আজও চাঁদা দিতে হয়। অনেক কষ্টে জুম চাষ করি, কিন্তু ফসল ফলানোর আগেই চাঁদা চেয়ে হাতে চিঠি দিয়ে যায় সন্তু লারমার লোকেরা। দু’মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য নিজের কলার ছড়ি বাজারে নিয়ে যাই বিক্রি করার জন্য কিন্তু সেটাতেও চাঁদা দিতে হয়। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় এমন কোন জিনিসপত্র নেই যেটা ক্রয়-বিক্রয় করতে চাঁদা দিতে হয় না। শান্তিচুক্তির হওয়ার পরেও রাস্তায় স্বাধীনভাবে চলতে পারিনা, ভয় হয় কখন জানি ইউপিডিএফ আর জেএসএস’র হাতে ব্রাশফায়ারের শিকার হতে হয়। এমন ভয়ের পরিবেশের জন্য কি শান্তিচুক্তি করা হয়েছিলো?

নিজের ভাইকে খুন করে দলের নেতা হলেন। এরপর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি আজ প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে এসির ঠান্ডা বাতাসে অত্যন্ত আরাম আয়েশে জীবনযাপন করছেন। মাঝখান থেকে আমি পিন্দু পিন্দুই রয়ে গেলাম। আমার মত হাজারো পিন্দু রয়ে গেছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে। সন্তু লারমা তাদের কোন খোঁজও নেয় না। আজ আমাদের জুম্মদের মাঝে এটা পরিষ্কার যে সন্তু লারমা আমাদের কল্যাণের জন্য শান্তিচুক্তি করেনি। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য এই শান্তিচুক্তি করেছিলো সে।

শান্তিচুক্তির সুফল দেশের সরকার আমাদের দিচ্ছে কিন্তু সন্তু লারমার পোষা সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে সেই সুফল ভোগ করতে দিচ্ছে না। নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছে, তার কথামত না চললে খুন করছে, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে।

বর্তমানে জুম্মজাতির কাছে সন্তু লারমা ও তার দল জনসংহতি সমিতি একটি ঘৃণার পাত্র। জুম্মদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সন্তু বাবু নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াচ্ছে, নিজের জীবনকে করছে আয়েশি আর উন্নত। নিজ সন্তান আর আত্নীয়-স্বজনদেরকে বিদেশে লেখাপড়া করাচ্ছে আর আমাদের জুম্ম যুব সমাজের হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্র। এভাবে দিন দিন আমাদের জুম্মজাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সন্তু বাবু। আজ হাজারো মায়ের বুক খালি, শুধু সন্তু বাবুর স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে। অস্ত্র হাতে কোন জাতি কখনো উন্নত হতে পারেনি এটা জেনেও সন্তু বাবু পাহাড়ি যুবকদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য করছে।

আমরা জুম্মজাতি এখন বাক স্বাধীনতা চাই। নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর পুর্ব পুরুষদের অনুস্মরণ করে পৃথিবীকে জানাতে চাই যে জুম্মজাতি শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে পাহাড়ের সকল মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। সন্তু বাবুর অস্ত্রবাজি আর জ্বালাও পোড়াও নীতির পথ পরিহার করে আমরা সুস্থ্য জীবন যাপন করতে চাই। আমরা আর লাশের মিছিল দেখতে চাই না।

জুম্ম ভাইদেরকে বলছি,- তোমাদের ঘুম কী আদৌ শেষ হবে না? আর কত দেখবে লাশের মিছিল? তোমাদেরকে আর একবার আন্দোলন করতে হবে। হ্যাঁ আর একবার। সেই আন্দোলন হলো সুপথে আসার আন্দোলন। এর জন্য সন্তু বাবুর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করতে হবে; তবেই আমরা পাব মুক্তি।

—————————————————————————————

মুক্তমত এ প্রকাশিত লেখার বক্তব্য বিষয়বস্তু ও তথ্য একান্তই লেখকের। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতিমালা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন