সদ্যসমাপ্ত দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন, কি পেল পার্বত্যাঞ্চলের বাঙ্গালী জনগণ?

Kawkhali News-pic

কাউখালী প্রতিনিধি:

সম্প্রতি শেষ হল দলীয় প্রতীকের স্থানীয় নির্বাচন। দেশে এবারই প্রথম বারের মত অনুষ্ঠিত হওয়া দলীয় প্রতীকের এ নির্বাচনে পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোর পাওয়া না পাওয়ার হিসাবটাও বদলে গেছে এবার। বলতে গেলে সমতলের তুলনায় পাহাড়ের নির্বাচনের পার্থক্যটাও যোজন যোজন দূর। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পেরে রাজনৈতিক দলগুলো তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও আড়ালে কতটুকু বৈষম্য হয়েছে তা গত নির্বাচনের ফলাফলেই অনুমেয়। নৌকা-ধানের শীষে নির্বাচন করতে গিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলই। ফলে অন্যান্য বারের তুলনায় পুরোপুরি নেতৃত্ব শুন্য হয়ে পড়েছে পাহাড়ের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠিরা। দলীয় সাইন বোর্ড অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম কাদের? নেতৃত্ব চলে গেল কাদের হাতে? কেমন হবে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠির ভবিষ্যৎ? সারাক্ষণ এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির মনে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের দু’টি আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও বিএনপি চরমভাবে ধরাশায়ী হয়েছে। যেসব ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে তাদের মধ্যে বাঙ্গালী চেয়ারম্যান নেই বললেই চলে।

দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের দরুণ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির অনৈক্য ও  উপজাতীয়দের কিছুটা ঐক্যের ফলে পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসরত বাঙ্গালীরা ভবিষ্যত নেতৃত্বশূণ্য হয়ে পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। জাতীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পেরে প্রার্থীরা নিজেদের গর্বিত মনে করলেও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে পূর্বের মত ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দলীয় প্রতীক নৌকা-ধানের শীষ। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্বেও পাহাড়ের বেশীরভাগ ইউনিয়ন পরিষদই হাতছাড়া হয়ে গেছে।

অতীত নির্বাচনে বাঙ্গালীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আওয়ামীলীগ-বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয় দেখা যেত। এবার ধানের শীষ-নৌকার জেদাজেদিতে কেউ কাউকে ইঞ্চি পরিমাণও ছাড় দিতে রাজি হয়নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে থেকে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন মূলত উপজাতীয় নেতারাই। তাদের ইচ্ছানুসারেই এ অঞ্চলে মূলত রাজনৈতিক সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

পাহাড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির চাবিকাঠি বরাবরের মতই “দাদা”দের হাতে। দাদাদের ধুতি সংস্কৃতির কাছে যেন অসহায় বাঙ্গালী নেতারা। সব কিছুতেই রয়েছে দাদাদের আধিপত্য। বাঙ্গালী মুসলমানদের বিয়ে-সাদী, সামাজিক বিচার আচার, পারিবারিক সুবিধা অসুবিধা সবকিছুতেই দাদাদের আর্শিবাদ নিতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমোদন থাকা সত্বেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতেও নাকি দাদাদের আর্শিবাদ না নিলে হয় না। এজন্য বড় বড় আলেমদেরও দাদাদের আর্শিবাদ নিতে তাদের পেছনে ছুটতে দেখা গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব এলাকায় বাঙ্গালী চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ সেখানে দাদারা দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করেছেন মারমা অথবা চাকমা সম্প্রদায় থেকে। অথচ যেসব এলাকায় বাঙ্গালী চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা নাই সেখানেই দলীয় প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে বাঙ্গালী। এসব আসনে পূর্বে দলীয় ব্যানারে উপজাতীয় প্রার্থীরা বাঙ্গালীদের দেয়া বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও এবার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাঙ্গালী প্রার্থী দেয়ায় তাদের ভাগ্যে ১০% উপজাতীয় ভোটও জোটেনি।

তাছাড়া এসব এলাকায় পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র ব্যানারে ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থী। অথচ যেসব এলাকায় বাঙ্গালী ভোট ব্যাংক রয়েছে এবং চেয়ারম্যান হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেয়া হয়েছে উপজাতীয়দের। মূলত সেসব স্থানে জেএসএস কিংবা ইউপিডিএফ’র কোন প্রার্থী দেয়া হয়নি। এতেই বুঝা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক আসল পরিচয়। আওয়ামীলীগের ব্যানারে কোন কোন বাঙ্গালী প্রার্থী বিদ্রোহ করার চেষ্টা করলেও দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের অজুহাতে তাদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রার্থীদের বড় বড় আশার বানী শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন দাদারা।

কিছু কিছু স্থানে বাঙ্গালী আওয়ামীলীগ সমর্থিত মেম্বার প্রার্থী ও দলীয় নেতা কর্মীরা বাঙ্গালী প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে গোপনে কাজ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের অজুহাত এনে তাদেরকে শোকজ করার ঘটনাও ঘটেছে। এক্ষেত্রে মূখ খোলার সাহসও পাচ্ছেনা তারা। কারণ দাদাদের ‘দাদাগিরী’র বিপক্ষে অবস্থান নিলে চাল, গম ও টেন্ডারের ভাগ কপালে জুটবেনা। তাহলে কি চেয়ার মোছার দায়িত্ব ছাড়া চেয়ারে বসার যোগ্যতা কি হারিয়ে ফেলেছে বাঙ্গালীরা?

পিছিয়ে পড়া পাহাড়ের জনগোষ্ঠির কথা মাথায় রেখেই ২০১৪ সালে সরকার রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালীদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটি স্থাপনের বিরুদ্ধে মাঠে নামে পাহাড়ের আঞ্চলিক শসস্ত্র সংগঠন জেএসএস ও ইউপিডিএফ। পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন আওয়ামীলীগ ও বিএনপির বড় বড় পদে আঁকড়ে থাকা উপজাতীয় নেতারা। এমনকি চেয়ারম্যান, মেম্বার, হেডম্যান, কার্বারী থেকে শুরু করে উপজাতীয় সব শ্রেণীর নেতারা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরুদ্ধে  গণস্বাক্ষর দিয়ে আলোচনায় আসেন তারা। সরকারের ভেতর থেকে রাষ্ট্রিয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গ করলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা এসব উপজাতীয় নেতাদের বাহিস্কার কিংবা বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস পায়নি দু’টি রাজনৈতিক দলই। তাহলে কি আওয়ামীলীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক রেশারেশীতে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙ্গালী রাজনীতির আদর্শিক পরাজয় হয়েছে? সাধারণ বাঙ্গালীরা এমনটা ভাবলে তেমন একটা ভূল হবেনা।

কেমন হবে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীদের সামনের দিনগুলো? সময় থাকতে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির কি শুভ বুদ্ধির উদয় হবে? নাকি ‘দাদা’দের সেই ‘দাদাগিরী’র কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেবে?

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন