Notice: Trying to get property 'post_excerpt' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 53

Notice: Trying to get property 'guid' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 55

স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে গুলশাখালীর সাত শহীদের কথা


সৈয়দ ইবনে রহমত:
স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে গুলশাখালীর সাত শহীদের কথা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নাম, ঠিকানা। হারাবেই না বা কেন? কত মৃত্যুর ঘটনাই তো আছে, কোনটা রেখে কোনটার কথাই বা মনে রাখবে মানুষ। তাছাড়া সেই ১৯৯১ সালের ঘটনা! সেটা এমনই একটা সময়, যখন প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন জায়গা থেকে নতুন নতুন মৃত্যুর খবর শোনা যেত। শান্তিবাহিনীর গুলিতে মারা গেছে কিংবা ধরে নিয়ে গেছে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই- এমন ঘটনার তো অন্ত নেই। যার ভাই, পিতা, সন্তান কিংবা স্বামী মারা গেছে তার মনের গভীরেই বিষমাখা তীরের গেঁথে আছে সেই শোক। অন্যরা কয়েকদিন হায়-হুতাশ করে আবার মনোযোগ দিয়েছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান এমনই এক পরিস্থিতিতে গুলশাখালীতে সাত জন নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল শান্তিবাহিনীর গুলিতে।

রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলাধীন গুলশাখালী ইউনিয়ন। মঙ্গলবার, ১৯৯১ সালের ২৩ জুলাইয়ের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আর দশটা এলাকার মতো এখানকার বেশিরভাগ মানুষেরই আয়-রোজগারের অন্য কোনো উপায় ছিল না। কাপ্তাই লেক থেকে মাছ ধরা আর পাহাড় থেকে বাঁশ-কাঠ কেটে বিক্রি করাই জীবন ধারণের উপায়। লেকে সব সময় যেমন মাছ ধরা সম্ভব হতো না, তেমনি সবার পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না। তাই অধিকাংশের আয়-রোজগারের একমাত্র উৎস ছিল পাহাড় থেকে বাঁশ-কাঠ কেটে বিক্রি করা। যদিও পাহাড়ে গিয়ে শত শত মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে শান্তিবাহিনীর হাতে, তারপরও বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় না থাকায় পাহাড়ে যেতে হতো বাধ্য হয়েই।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুই থেকে আড়াইশ’ মানুষ গুলশাখালী থেকে বাঁশ-কাঠ কাটতে পাহাড়ে যায়। বেলা তখন ১১-১২টার মতো হবে। বেশিরভাগেরই বাঁশ কাটা শেষ, কেউ কেউ বোঝা বেঁধে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউবা বাঁশের আঁটি বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউবা ছড়ার পানিতে তৃষ্ণা মিটাচ্ছে- এমনই সময় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁজরা হয়ে গেছে কারো বুক, পেটসহ সারা দেহ। কারো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মাথা কিংবা শরীরের কোন অংশ। কেউবা আহত হয়ে কাৎরাচ্ছে, বাকীরা জীবন নিয়ে দিশাহারা হয়ে দৌড়াচ্ছে, যে যেদিকে পারছে।

গুলির শব্দ লোকালয় থেকেই শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু পাহাড়ে সত্যিকারে কী ঘটছে তা জানার তাৎক্ষণিক কোনো উপায় ছিল না। তারপরও যাদের স্বজনরা পাহাড়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে দেখা দেয় উৎকণ্ঠা। অনেকেই অস্থির হয়ে ছুটাছুটি শুরু করে, কারো কাছ থেকে খবর পাওয়া যাবে সে আশায়। কেউ কেউ পাগলের মতো ছুটতে থাকে পাহাড়ের দিকে। কেউ কেউ তাদের থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু কে শোনে কার কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড় থেকে খবর আসতে থাকে শান্তিবাহিনী হামলা করেছে, অনেকের গায়ে গুলি লেগেছে। কেউ মারা গেছে কিনা সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হয় আরো কিছুক্ষণ।

পাহাড় থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা লোকজনদের সাথে নিয়ে বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্যরা পাহাড়ে প্রবেশ করেন। এরপর এক এক করে নিয়ে আসা হয় ছয়জনের লাশ, আরো দুইজনকে পাওয়া যায় গুলিবদ্ধি মুমূর্ষু অবস্থায়। তাদের দ্রুত লংগদু থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অবস্থাই এতটাই খারাপ যে, চিকিৎসা দিতে অপারগ হওয়ায় হাসপাতালের গেট থেকেই তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই মৃত্যু হয় একজনের, আরেকজনকে পরে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম সমন্বিত সামরিক হাসপাতালে, সেখানকার চিকিৎসায় বেঁচে যান তিনি। ৩৫ দিন ভর্তি থেকে মোটামুটিভাবে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে।

সেদিন পাহাড় থেকে যারা লাশ হয়ে ফিরেছিলেন-
১. মো. সেলিম শাহনেওয়াজ (১৩), পিতা রহমত আলী, গ্রাম মধ্য মুর্শিদাবাদ, গুলশাখালী।
২. মো. কুদ্দছ সরকার (৬৫), পিতা সরাফত আলী, গ্রাম পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, গুলশাখালী।
৩. মো. জৈনুদ্দিন (১৬), পিতা মো. ইউনুছ আলী (ইউনুছ কারবারী), গ্রাম মধ্য মুর্শিদাবাদ, গুলশাখালী।
৪. মো. ইসমাইল মিয়া (৫৪), পিতা ইমান আলী, গ্রাম যুবলক্ষীপাড়া, গুলশাখালী।
৫. মো. আলফাজ আলী(২৩), পিতা আহমদ আলী, গ্রাম শেখপাড়া (করাতী জব্বারের টিলা), গাঁথাছড়া, মাইনীমুখ।
৬. মো. গালিব হোসেন(২৮), পিতা জলিল মৌলভী, গ্রাম মিস্তুরি টিলা (এতিমখানা এলাকা), গাঁথাছড়া, মাইনীমুখ।
৭. মো. রিয়াজ উদ্দিন টিয়া (৫৫), পিতা মো. আলম শেখ, গ্রাম পূর্ব মুর্শিদাবাদ, গুলশাখালী।

এদের মধ্যে রিয়াজ উদ্দিন টিয়াকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে লংগদু হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েই মারা যান তিনি। তার সাথে আহত ছিলেন আরেকজন, যিনি শেষপর্যন্ত বেঁচে যান; তিনি হলেন মো. আক্কাছ আলী (ফজলুর বাপ), পিতা ইমান আলী, গ্রাম যুবলক্ষীপাড়া, গুলশাখালী। ঘটনার সময় উনার বয়স ছিল ৪৮, বর্তমানে (২০১৮) ৭৫ বছর। নিহত ইসমাইল মিয়া ছিলেন আহত আক্কাছ আলীর বড় ভাই। দুই ভাইকে একই সাথে শান্তিবাহিনী গুলি করেছিল, বড় ভাই মারা গেলেও ৬টি গুলির আঘাত নিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আক্কাছ আলী। অপরদিকে গাঁথাছড়ার নিহত দুইজন ছিলেন পরস্পর আত্মীয়। গালিব হোসেনের ছোট বোনজামাই ছিলেন আলফাজ আলী। আলফাজ আলী বিয়ে করার পর তখন একমাসও হয়নি, হাতের মেহেদী হাতেই ছিল তার।

ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল ১০ মহররম, পবিত্র আশুরার দিন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মন ছিল শোকাতুর। তার মধ্যে এই হতাহতদের স্বজনদের কান্নার রোল, ভারী করে তুলেছিল পরিবেশ। সেই কষ্ট আর শোকে মুহ্যমান মানুষ কোন রকমে গোসল করিয়ে কবরস্থ করেছিল তাদের স্বজনদের। গুলশাখালীর নিহত পাঁচজনকে আহসানপুর কবরস্থানে পাশাপাশি কবর দেয়া হয়। আর গাঁথাছড়ার দুইজনকে কবর দেয়া হয় গাঁথাছড়া মসজিদের পাশেই। নিহত গালিব হোসেনের বাবা জলিল মৌলভী (বর্তমানে মরহুম) ছিলেন সে মসজিদের মুয়াজ্জিন। পুত্র আর মেয়ের জামাইকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো মসজিদের পাশে কবর দেন।

সেদিন যারা পাহাড়ে গিয়ে শান্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন গুলশাখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেলিম শাহনেওয়াজ (৭ম শ্রেণি); সেলিমের সহপাঠী এবং প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম (৭ম শ্রেণি), পিতা আব্দুল মালেক কারী, গ্রাম মধ্য মুর্শিদাবাদ। অপরজন ছিলেন সেলিমের দোস্ত আব্দুস সালাম (৬ষ্ঠ শ্রেণি), পিতা হান্নান মুন্সী, গ্রাম পূর্ব মুর্শিদাবাদ। পাহাড় থেকে সেদিন দুজন জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারলেও সেলিম এসেছিল লাশ হয়ে। ফিরে আসা দুজনের মধ্যে আব্দুস সালাম বর্তমানে বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ-এর খাগড়াছড়ি জেলা গুইমারা শাখার ফিল্ড অর্গানাইজার।

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেলিম বয়সে আমার বড় ছিল। কিন্তু আমরা দুইজন ছিলাম দোস্ত। পারিবারিকভাবেই এ সম্পর্ক হয়েছিল। ঘটনার আগের দিন মহররমের বন্ধ দিয়েছিল স্কুল। তাই সেলিম জানিয়েছিল, বন্ধের দিন পাহাড়ে যাবে বাঁশ কাটতে। কারণ দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে, তাই স্কুলের মাসিক বেতন এবং পরীক্ষার ফিস দিতে হবে। বাঁশ বিক্রি করে সেই টাকা যোগাড় করবে। তখন আমিও রাজি হয়ে যাই, পরের দিন তার সাথে পাহাড়ে যেতে। পরদিন সকাল ৮টার দিকে সেলিম এবং সাইফুল এসে হাজির। তিনজন মিলে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পূর্ব মুর্শিদাবাদের মতিউর রহমান (বর্তমানে মরহুম) এবং উনার বড় ছেলে ইসমাইল হোসেনের সাথে দেখা। তারাও যাচ্ছেন পাহাড়ে। পরে আরো তিনজন যুক্ত হয়েছিল আমাদের সাথে। আট জনের দল নিয়েই আমরা পাহাড়ে প্রবেশ করি। তেমাথা বিডিআর ক্যাম্প (শান্তিচুক্তির পর প্রত্যাহার করা হয়েছে) থেকে এক থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বদিকে পাহাড়ে গিয়ে দেখি আরো অনেকেই গেছেন। সেখানেই বাঁশ কাটা শুরু করি, সেলিম বাঁশ কাটছিল আর আমি সেগুলো টেনে টেনে বের করি। কাটার পর সেলিম ১৫টি বাঁশের আঁটি বাঁধে আর আমার জন্য বাঁধে ১০টি বাঁশ। সাইফুলের বাঁশও বাঁধা হয়ে গেছে। আঁটি মাথায় তুলতে যাচ্ছি এসময়ই শুরু হলো ব্রাশ ফায়ার। আমি লাফ দিয়ে পড়লাম ছড়ার মধ্যে। কার গায়ে গুলি লেগেছে, কে কোন দিকে ছুটে গেছে কিছুই জানি না। আমি ছুটলাম ছড়া দিয়েই। সুস্থ সেলিমকে নিয়ে পাহাড়ে গেলেও পরে তার লাশ আনতে হলো আমাদের।

তাদের আরেক সঙ্গী সাইফুল ইসলাম, বর্তমানে বাড়িতে থাকেন, কৃষি কাজ করেন। তিনি জানান, গুলির শব্দ শুরু হওয়ার পর আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। লোকালয়ের দিকে না এসে দৌড়াতে শুরু করি উল্টো দিকে। কিছু দূর গিয়েই দেখতে পাই কুদ্দুছ সরকার, আক্কাছ আলী, ইসমাইল মিয়াসহ আরো কয়েকজনকে। ছড়া দিয়ে সবাই দৌড়াচ্ছেন। একটু পরেই শান্তিবাহিনী আমাদের দেখে আবার গুলি শুরু করে। আমার সামনেই পড়ে যায় দুইজন। আমি দৌড় দিতে গিয়ে পাথরে স্লিপ করে পড়ে যাই্। পড়েই দেখি রক্ত মিশে ছড়ার পানি লাল হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না, তাই সেই রক্ত মেশানো পানিই খেয়েছি বাঁচার জন্য। তারপর দৌড়ে ফিরে আসি যেখানে সেলিমসহ আমরা ছিলাম। আসার সময় কারো পায়ে যেন আমার পা আটকে গিয়েছিল, তখন বুঝতে পারিনি, পরে অবশ্য বুঝেছিলাম সেটাই ছিল বন্ধু সেলিমের পা। পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসার পর বিডিআরের সদস্যরা আমিসহ আরো অনেককে নিয়ে আবার গিয়েছেল হতাহতদের খুঁজে আনার জন্য। তখন গিয়ে দেখতে পাই, আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই ছড়ার মধ্যে পড়ে আছে সেলিমের মৃতদেহ। তার কপাল উড়ে গিয়েছিল, চেনার কোন উপায় ছিল না।

নিহত সেলিমের বাবা রহমত আলী মারা গেছেন সাত বছর আগে, পুত্র শোকে কাতর মা হাজেরা খাতুন (৬০) এখনো বেঁচে আছেন। সেলিম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা পাহাড়ে যাবে, এটা তো বলে যায় নাই্। সকালে খাওয়ার পর বলল, রহমতপুর জুলহাসদের বাড়িতে যাবে। তাই জানতাম না, দুপুরের দিকে খবর পাইলাম, সব শেষ। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। বড় পুতকেই হারাইলাম, পাগলের মতো ছিলাম তিন মাস। আমি এখনো বাঁইচা আছি, কিন্তু পুত তো নাই।

গাঁথাছড়ার যে দুইজন নিহত হয়েছিল তাদের সাথে আরো্ একজন ছিলেন; আলফাজ আলীর চাচাত ভাই হাসান আলী (বর্তমানে ৬০), পিতা আলী আহমদ, তিনি এখন বসবাস করেন পশ্চিম জালালাবাদ (১১ নম্বর), গুলশাখালী ঠিকানায়। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা পাহাড়ে গিয়েছিলাম গাঁথাছড়ার তিনজন। আমি অবশ্য তখন বসবাস করতাম গুলশাখীর রহমতপুর এপি ক্যাম্পের (শান্তিচুক্তির পর প্রত্যাহার করা হয়েছে) পাশে, বাকী দু’জন গাঁথাছড়া থেকেই এসেছিল। পাহাড়ে একসাথেই ছিলাম তিনজন। শান্তিবাহিনী গুলি করলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই অামি, নিহত হয় আমার ভাই আলফাজ এবং তার স্ত্রীর বড় ভাই গালিব হোসেন। পরে বিডিআরের সাথে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে এনেছি, লাশের আবস্থা দেখার মতো ছিল না, গুলির আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন ছয়টি গুলি লাগার পরেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আক্কাছ আলী বলেন, প্রতিদিনই পাহাড়ে যেতাম। সেদিন কিছু বুঝে উঠার আগেই শান্তিবাহিনী গুলি শুরু করল। আমরা ছিলাম ছড়ার মধ্যে। দুই পাশের পাহাড় থেকেই আমাদের ওপর গুলি করছিল। গুলি লাগার পর আমি জ্ঞানহারা হয়ে গেছিলাম, আর কিছু মনে নেই। পরে যখন বিডিআর গিয়ে আমাদের উদ্ধার করে আনলো তখন জ্ঞান ফিরেছে। বড় ভাই ইসমাইল তো সেখানেই মারা গেলেন। আমাকে এবং টিয়াকে নেয়া হলো লংগদু হাসপাতালে কিন্তু হাসপাতালের গেইট থেকেই আমাদের ফেরত দেয়া হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই টিয়া মারা গেলেন। আমাকে বিডিআরের দুইজন নিয়ে গেলেন, চট্টগ্রামে। সেখানে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হলো। ডাক্তাররা অপারেশন করে আমার উরু থেকে তিনটি গুলি বের করলেন। পুরুষাঙ্গে দুটি এবং বাম হাতের কুনইয়ের ওপর একটি গুলি লেগেছিল, সেগুলো অবশ্য আগেই বের হয়ে গেছিল। ৩৫ দিন সেখানে ভর্তি থাকার পর বাড়িতে ফিরে আসি। সেই থেকেই এক হাতে আর এক পায়ে শক্তি পাই না। তারপরও বাঁচার জন্য কষ্ট করেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। এখন বুড়ো হয়েগেছি, নড়াচড়া কষ্ট, তারপরও তো কোন উপায় নেই।

ঘটনার সময় গুলশাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুর রহিম। সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, গুলশাখালীসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষই শান্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকেই, অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে শান্তিবাহিনী। কিন্তু এই হতাহতদের জন্য কিছুই করার ছিল না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে উল্টো দোষারোপ করা হতো হতাহতদেরই। তারা কেন পাহাড়ে গেল, সেই অপরাধেই তাদের ধমকানো হতো; সহায়তা করা তো দূরের কথা। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, সেদিন যারা নিহত হয়েছিল তাদের জন্য বাকীতে এনে কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। প্রশাসন তাদের পাহাড়ে যেতে নিষেদ করত এটা ঠিক আছে, কিন্তু তাদের তো কিছু খেয়ে বাঁচতে হবে, সে ব্যবস্থার ব্যাপারে প্রশাসন ছিল নিরব। আমি মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত যারাই হতাহতের শিকার হয়েছে প্রত্যেকের নামের তালিকা করে তাদের পরিবার-পরিজনদের পুনর্বাসন করা জরুরি। বিলম্বে হলেও এটা করা দরকার, কারণ পরিবারের কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে অনেকেই এখনো অসহায় অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। তাই পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে যারাই হতাহতের শিকার হয়েছে তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

গুলশাখালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু নাছির জানান, গুলশাখালীর অনেকেই বিভিন্ন সময় শান্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে; এর মধ্যে আছে রাজনগর হত্যাকাণ্ড, সেলিমদের হত্যাকাণ্ড, পাকুয়াখালীর হত্যাকাণ্ড। আরো অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এর মধ্যে রাজনগরে যারা হত্যার শিকার হয়েছিল, তাদের জন্য রাজনগর কবরস্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের চিন্তায় আছে, অন্য যারা হত্যার শিকার হয়েছে তাদের তালিকা করে কোন একটি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার। যাতে মানুষ তাদের স্মরণ করতে পারে। সকলে সহায়তা করলে আশা করি সেটি দ্রুতই করা সম্ভব হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন