বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলিতে আরো ৪ বিজিবি সদস্য নিখোঁজ (ভিডিওসহ)

মর্টার, রকেট লঞ্চারের মতো ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী: নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে সীমান্তবাসী

মমম

মেহেদী হাসান পলাশ/ নুরুল আলম সাঈদ:

অপহৃত নায়েব সুবেদার মিজানের লাশ ফেরত নিতে আহ্বান জানিয়ে অপেক্ষমান বিজিবির কর্মকর্তা ও জওয়ানদের লক্ষ্য করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী,  কমান্ডো ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিবর্ষণ করে। এসময় বিজিবিও আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করে। ফলে উভয় পক্ষের পাল্টা গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনায় আরো চারজন বিজিবি সদস্য নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে নিখোঁজের ব্যাপারে বিজিবির কোন কর্মকর্তারা স্বীকার করেননি।

 

গতকাল ৩০ মে দুপুর ২.৩০ ঘটিকায় ৫২ পিলার এলাকায় কোন আলোচনা ছাড়াই এ ঘটনা ঘটে। এই খবর নিশ্চিত করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি। এদিকে গত বুধবার বিজিপির গুলিতে নিহত বিজিবি সদস্য নায়েক মিজানুর রহমানের মরদেহ মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ফেরত দেয়নি। উল্টো বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলি ছুড়েছে মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনী বিজিপি  ও তাদের সেনাবাহিনী  এবং স্পেশাল কমান্ডো বাহিনী। তবে এ ঘটনার পর থেকে সীমান্ত টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে: কর্নেল শফিকুর রহমান।

সীমান্তে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘঠনার কারনে পুরো সীমান্ত এলাকায় আতংক বিরাজ করছে। মিয়ানমার পক্ষ থেকে মর্টারসেল, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে গোলা নিক্ষেপ করার পর ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের ৪জন বিজিবি সদস্য নিখোঁজ রয়েছে । এরা হলেন, হাবিলদার মোতালেব, ল্যান্স নায়েক বাতেন, সিপাহী আমিনূল এবং জাহাঙ্গীর। বিজিবি’র ৬০ জনের টহলদলের সাথে ৫৬ জন ফেরত আসলেও বাকী ৪জন ফেরত আসেনি ।

সীমান্তে রণসজ্জা

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির দূর্গম পাহাড়ী জনপদ পাইনছড়ি ৫২নং পিলার এলাকায় বিজিবি নিয়মিত টহলদানকালে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বিনা উস্কানিতে বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে ৩ শতাধিক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করার ঘটনায় মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে রণসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে বলে নিভর্রযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। মিয়ানমার মংডু শহরের বলি বাজার, ফকিরা বাজার, ওয়ালিদং, তুমরু ও ঢেকিবনিয়া সীমান্ত এলাকায় ১নং ও ২ নং সেনাবাহিনীর সেক্টরে তারা অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় অঘোষিত কারফিউ চলছে। এমনকি বিজিবি সদস্যরা এ মুহুর্তে ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না।

জানা গেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিজিপি’র বাউন্ডুলা ক্যাম্প এলাকায় তাদের দেশের দুই শতিাধিক কমান্ডো বাহিনী মোতায়েন করেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমান সেনাবাহিনীর অবস্থান পাহাড়ের উপর এবং বিজিবি’র অবস্থান পাহাড়ের নীচে হওয়ায় কৌশলগতভাবে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, ঘটনাস্থলের আশেপাশে বসবাসরত মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীভূক্ত উপজাতি জনগোষ্ঠীর কারণে বিজিবি’র অবস্থান মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা জেনে যাচ্ছে।

এর আগে শুক্রবার সকালে মিয়ানমার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে তিন শতাধিক সেনা সদস্য মোতায়েন করলে বাংলাদেশও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ঘন্টা দুয়েক পর তারা সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগ্রেড মোতায়েন করেছে।

বুধবারে পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় বিজিপির গুলি বর্ষণে ওই ক্যাম্পের নায়েক মিজানুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে বলে সরকারী দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তার লাশ মংডু হাসপাতালে হস্তান্তর করেছে বলে জানা গেছে। তবে তারা স্থানীয় গণমাধ্যমে এ লাশের পরিচয় আরএসও সদস্য বলে প্রচার করছে।

বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) তার লাশ শুক্রবার সকালে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবির হাতে হস্তান্তর করার কথা জানিয়ে পত্র পাঠালেও এ রিপোর্ট লেখাকালীন সময় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিজিবির কর্মকর্তার লাশ ফেরত দেয়নি মিয়ানমার। এ উদ্ভুট পরিস্থিতিতে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। যার ফলে উভয় সীমান্ত এলাকা জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে।

বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সদ্য স্থাপিত পাইনছড়ি বিওপি ক্যাম্প থেকে গত বুধবার একদল বিজিবি নিয়মিত টহলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে দোছড়ি ও তেছড়ি খালের সংযোগস্থলে পৌছঁলে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মিয়ানমারের ওপার থেকে বিজিপি তাদের লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা দিক-বেদিক ছুটাছুটি করে পালিয়ে গেলেও দায়িত্বরত নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়।

ঘটনাস্থল থেকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ জাতিসংঘের কনভেনশন আইন অমান্য করে বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় অনুপ্রবেশ করে অস্ত্র ও গোলা বারুদসহ তাকে নিয়ে যায়। যে কারণে এখনো পর্যন্ত ওই বিজিবি কর্মকর্তা নিখোঁজ রয়েছে।  স্থানীয়রা জানান, যেহেতু ঘটনাস্থলে রক্তের আলামত দেখা গেছে তাই মনে করা হচ্ছে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালের শেষের দিকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী তৎকালীন নাসাকা বাহিনী অর্তকিতভাবে ঘুমধুমের রেজু ফাত্রাঝিরি বিজিবি ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে এক বিজিবি সদস্যকে নিহত করে অস্ত্র ও গোলা বারুদ লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনাকে পুঁজি করে মিয়ানমার থেকে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে।

ধারণা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের আবারো বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্য সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বার বার গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বর্তমানে ওই সময় চলে আসা বৈধ ও অবৈধ প্রায় ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। এছাড়াও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত সীমান্ত পেরিয়ে অহরহ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার সকালে সীমান্ত এলাকা সরজমিন ঘুরে বিজিবি ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বাইশপারি ৪১ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকায় মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের গুলি বর্ষনের ঘটনায় স্থানীয় জনমনে আতংক বিরাজ করছে। ঘুমধুম বিজিবির সুবেদার সাহাব উদ্দিন জানান, সীমান্তের উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে লোকজন আতংকগ্রস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। যে কারণে সীমান্তের উভয়পাড়ে মানব শুন্য হয়ে পড়েছে। রেজু আমতলী ক্যাম্পের সুবেদার মোঃ সোহরাব হোসেন জানান, বিজিপির গুলি বর্ষনের ঘটনার পর থেকে সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজিবি সদস্যদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কঠোর সর্তক রাখা হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল শুক্রবার পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নিহত বিজিবির নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানের লাশ ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও বিকাল পর্যন্ত ফেরত দেয়নি। কক্সবাজার ১৭ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, বুধবারে পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় গুলি বর্ষনের ঘটনার পর থেকে আমার নিয়ন্ত্রনাধীন ১৮ হতে ৪০ নং সীমান্ত পিলার পর্যন্ত সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং তাদেরকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, মিয়ানমার আগে থেকে সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত দু’দেশের মধ্যে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে একটি বৈঠক আগামী ৩ জুন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাফায়াৎ মুহাম্মদ সাঈদুল ইসলামের নিকট বিজিবির উপর গুলি বর্ষনের ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুক্রবারও পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার বিজিপি সদস্যরা আবারো দফায় দফায় গুলি বর্ষন অব্যাহত রেখেছে। যে কারণে বিজিবির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকায় যোগাযোগ করতে না পারায় বিস্তারতি জানানো সম্ভব হচ্ছে না। বিজিবি’র চট্টগ্রাম রিজিয়নের কমান্ডার ব্রি. জে. আহমদ হোসেন পার্বত্যনিউজকে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে টেলিফোনে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। কক্সবাজার বিজিবির সেক্টর কমান্ডর খোন্দকার ফরিদ হাসানের মুঠোফোনে বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

দৌছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ বলেন, পাইনছড়ি এলাকায় বিজিপি আবারো শুক্রবারে গুলিবর্ষণ করার ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় পূর্ব নির্ধারিত পতাকা বৈঠক হয়নি। ফলে লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়াও স্থগিত হয়ে যায়। উপরোন্ত সীমান্ত এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নিহত নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের সঙ্কটকে দায়ী করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। লোক মারফত যোগাযোগের ফলে দু’দেশের ভুল বুঝাবুঝিতে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে বলে শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেছেন। 

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এ ঘটনায় মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ মায়ো মিন্টথানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে কৈফিয়ত তলব করা হয়।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন