“উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তিবাহিনী কর্তৃক হত্যার সংবাদ বাতাসে বাতাসে সমগ্র উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় চেয়ারম্যানকে হত্যার সংবাদ শুনে জীবনের মায়া ত্যাগ করে শতশত বাঙ্গালী উপজেলা সদরে উপস্থিত হতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও ভীতি ছড়াতে পার্শ্ববর্তী বাঙ্গালী পাড়ায় শান্তি বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণে অন্তত ৪০জন নিরীহ বাঙ্গালী পুরুষ, নারী, শিশু নিহত হয়। এদের মধ্যে অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”
আজ লংগদু হত্যাকাণ্ডের ৩০ বর্ষপূর্তি

আজো বিচার হয়নি জনপ্রিয় রশিদ চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডের

fec-image

বাঙ্গালীদের একটি ঐক্যবদ্ধ দল আশ্রয় চাইতে গিয়ে উপজাতীয় নেতা এবং হেডম্যান অনীল বিহারী চাকমা কর্তৃক নিরাশ এবং কটুক্তির স্বীকার হন। এক পর্যায়ে নিরূপায় বাঙ্গালী জীবন বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত। সংঘাতে অন্তত ৩৬ জন উপজাতি এবং ৪০ জন বাঙ্গালী নিহত হয়। সহজেই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু কখনোই হারিয়ে যায় না সত্য ঘটনা, সত্য ইতিহাস। সাময়িকভাবে মিথ্যে জয়ী হতে পারে, তবে তার স্থায়িত্ব খুব স্বল্প সময়ের জন্য। আপনি গুগলে অনুসন্ধান করুন “লংগদু গণহত্যা” লিখে, দেখবেন পেয়ে যাবেন আংশিক সত্যের ভীড়ে একরাশ মিথ্যের সজ্জিত ঝুড়ি। শুধু লংগদু গণহত্যা নয়, পাহাড়ে যে কোন গণহত্যা লিখে অনুসন্ধান করলে যে সমস্ত পুরনো লেখা পাবেন তার অধিকাংশই মিথ্যাচার।

পাহাড়ে গণহত্যা নিয়ে রচিত লেখাগুলোতে যে পরিমাণ উপজাতি হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার হিসেব করলে লক্ষাধিক হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এতো পরিমাণ উপজাতি যদি হত্যা হতো তবে পাহাড় এতোদিনে উপজাতি নিঃচিহ্ন হয়ে যেতো। বর্তমানে উপজাতির সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ থাকতো না। যাইহোক, আজ সেই বিষয়ে লিখছি না। চেষ্টা করবো অন্য কোন লেখায় এই বিষয়ে যৌক্তিক উপস্থাপনা আপনাদের উপহার দিতে। আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি ১৯৮৯ সালের ৪ মে সংগঠিত লংগদু গণহত্যা সম্পর্কে।

এই গণহত্যা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে খুঁজে পেলাম নির্মম এক বাস্তব ইতিহাস। হয়তো পাহাড়ে আজ যার বয়স অন্তত ৩০ বছর তিনিও এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবগত নন। অনুসন্ধানে খুঁজে পেলাম, গেলো বছর লংগদু উপজেলায় মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যার মতোই উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের নীল নকশা। সমগ্র দেশবাসী এমনকি আমাদের পার্বত্য নতুন প্রজন্ম যেটা সম্পর্কে আজও অবগত নন।

১৯৮৯ সালের ৪ মে রোজ বৃহস্পতিবারের ঘটনা। চলছিলো রমজান মাস। লংগদু উপজেলার প্রথম নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আব্দুর রশিদ সরকার সফরে মাইনী বাজার গিয়েছিলেন। আছরের নামায শেষে আনুমানিক ৪.৩০ মিনিটের সময় মাইনী বাজার হতে লংগদু সদরে ফিরছিলেন তিনি। ফিরতি পথে মুসলিম ব্লকের কিছু লোক তাকে তাদের সাথে ইফতারের নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু; চেয়ারম্যান সাহেব রাজি হলেন না। তিনি বললেন যে সে বাসায় গিয়ে পরিবারের সাথে ইফতার করবেন।

এদিকে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। যখন তিনি লংগদু কাঠালতলী অতিক্রম করে বর্তমান বনবিহার গেইটের কাছে উপস্থিত হলেন তখনই তার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের পিস্তলের গুলি আব্দুর রশিদ সরকারের দেহ ভেদ করে চলে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি, সাথে সাথে দেহ হতে প্রাণ পাখি উড়ে যায়। হারিয়ে যায় লংগদু উপজেলা তথা ভবিষ্যত পার্বত্য বাঙ্গালীর একজন দক্ষ অভিবাবক।

উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তিবাহিনী কর্তৃক হত্যার সংবাদ বাতাসে বাতাসে সমগ্র উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় চেয়ারম্যানকে হত্যার সংবাদ শুনে জীবনের মায়া ত্যাগ করে শতশত বাঙ্গালী উপজেলা সদরে উপস্থিত হতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও ভীতি ছড়াতে পার্শ্ববর্তী বাঙ্গালী পাড়ায় শান্তি বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণে অন্তত ৪০জন নিরীহ বাঙ্গালী পুরুষ, নারী, শিশু নিহত হয়। এদের মধ্যে অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

শান্তি বাহিনী কর্তৃক বাঙ্গালী পাড়ায় হামলা চলাকালে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যানকে দেখতে আসা বাঙ্গালীরা উপায়ন্তু না পেয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লংগদু সদরে উপজেলার প্রভাবশালী উপজাতীয় নেতা, সাবেক লংগদু ইউপি চেয়ারম্যান এবং লংগদু মৌজার হেডম্যান অনীল বিহারী চাকমার বাসভবনে যান। কিন্তু প্রভাবশালী এই উপজাতীয় নেতা কোনরূপ সান্তনা না দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। তখন নিরুপায় ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী সশস্ত্র শান্তি বাহিনীদের প্রতিরোধ করতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে এবং উপজাতি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। যদিও তথ্য প্রমাণ নেই তবুও শোনা যায়, বাঙ্গালীদের অগ্নিসংযোগে অন্তত ৩৬ জন উপজাতির প্রাণহানী ঘটে। সংক্ষিপ্তভাবে এই হলো সেদিনের সৃষ্ট লংগদু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

লংগদু উপজেলা মানচিত্র

খেয়াল করুন — আমরা মিডিয়ায় মাধ্যমে অনুসন্ধানপূর্বক যদি ১৯৮৯ সালের ৪ মে লংগদু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি তবে জানতে পারি ঘটনার শেষ ভাগ, প্রথম এবং মধ্যভাগ নয়। প্রকৃতপক্ষে ঘটনার শেষ ভাগ কেন তৈরী হলো আমরা তার অনুসন্ধান না করে একচেটিয়াভাবে এই ঘটনার দায় উপজেলার নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর চাপিয়ে থাকি। এটা কি ঠিক?

অবশ্য দোষ আমাদের নয়, দোষ হলো আমাদের মিডিয়ার। তাছাড়া, ইতোপূর্বে কেউ এই ঘটনার সত্যতা এবং বাস্তব রহস্য জাতির সামনে তুলে ধরেনি। তাই আমরা এখনো ঐ মিডিয়ায় থাকা শেষ ভাগটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য। কিন্তু ঐ যে প্রথমে বলেছি কালের বিবর্তনে লংগদু উপজেলা হতে রশিদ সরকার হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু তার ইতিহাস হারায়নি। উপজেলার বয়োজোষ্ঠ্য ব্যক্তিরা এখনো এই ব্যক্তিকে স্মৃতিচারণ করেন, অশ্রুসিক্ত হয় তাদের স্বজন হারানোর আহাজারিতে।

এখন প্রশ্ন হলোঃ কেন শান্তিবাহিনী সেদিন উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে হত্যা করেছিলো? এবং এর পরে আবার উপজেলায় কেন সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিলো? আসুন এখন সেই বিষয়টা সম্পর্কে জানি।

লংগদু উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান জবাব আব্দুর রশিদ সরকার উপজেলার আটারকছড়া ইউপির বাসিন্দা ছিলেন। তিনি তার অমায়িক ব্যবহার এবং সমসাময়িক দূর্দশাগ্রস্ত জনগনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাধারণ জনতার একেবারে অন্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাছাড়া তখন পার্বত্য বাঙ্গালী হতে এমন শিক্ষিত, বিচক্ষণ ব্যক্তি রাঙ্গামাটি জেলা তথা পাহাড়ে খুব দূর্লভ ছিলো। জনগনের ভালোবাসায় সিক্ত আব্দুর রশিদ সরকার আটারকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান হতে জনগনের ভোটে উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে হয়ে গেলে লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

এখানেও তিনি সফল। নেতৃত্বের গুণাবলী, দক্ষতা, অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে তার জনগনের ভালোবাসার স্রোত ভেসে ভেসে উপজেলা হতে জেলা, জেলা হতে তিন পার্বত্য জেলায় পৌঁছাতে লাগলো। রশিদ সরকার হয়ে উঠছিলেন রাঙ্গামাটি তথা সমগ্র পাহাড়ে পূনর্বাসিত বাঙ্গালীদের অভিবাবক। এই জনপ্রিয়তায় যেন হয়ে গেলো তার জন্য কাল!

শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র নেতারা এবং পার্বত্য কতিপয় কুচক্রী মহল চিন্তা করলেন যে এই রশিদ সরকার যদি বেঁচে থাকে তবে পার্বত্য বাঙ্গালীদের কোনভাবেই দমিয়ে রাখা যাবে না। রশিদ সরকারের নেতৃত্বে এই বাঙ্গালীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন একদিন পাহাড়ে রাজত্ব করবে। তৈরী হবে পাহাড়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশ। তাই তারা পার্বত্য বাঙ্গালীদের নেতৃত্ব শূন্য করে দমিয়ে রাখতে রশিদ সরকারে হত্যা করেছিলো। সম্ভবত এই জন্যই আজ অবধি পাহাড়ে পার্বত্য বাঙ্গালীরা একজন রশিদ সরকারের অভাবে সঠিক ঐক্য, নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি।

এবার আসি পরের প্রশ্নে— পার্বত্য বাঙ্গালী নেতৃত্ব ধ্বংস করতে রশিদ সরকারকে হত্যা করা হলো। হত্যা শেষে শান্তিবাহিনীর নেতা এবং পার্বত্য কুচক্রী মহল চিন্তা করলো এই হত্যার ঘটনা কিভাবে অন্যদিকে প্রবাহিত করা যায়? কেননা, প্রকাশ্যে দিবালকে রাস্তায় যেভাবে রশিদ সরকারকে হত্যা করা হয়েছে তার দায় হতে মুক্তি, ভিন্ন ইস্যু তৈরী ছাড়া সম্ভব নয়। ঠিক এই চিন্তা হতে সন্ত্রাসীরা উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যার দায় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাজালো নতুন পরিকল্পনা। বাঙ্গালীদের উত্তেজিত করতে শান্তিবাহিনী শুরু করলো তাৎক্ষণিক বাঙ্গালী পাড়ায় আক্রমণ, হত্যা করা হলো বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙ্গালী।

এদিকে বাঙ্গালীদের একটি ঐক্যবদ্ধ দল আশ্রয় চাইতে গিয়ে উপজাতীয় নেতা এবং হেডম্যান অনীল বিহারী চাকমা কর্তৃক নিরাশ এবং কটুক্তির স্বীকার হন। এক পর্যায়ে নিরূপায় বাঙ্গালী জীবন বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত। সংঘাতে অন্তত ৩৬ জন উপজাতি এবং ৪০ জন বাঙ্গালী নিহত হয়। সহজেই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট।

সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়ে শান্তিবাহিনী সেদিন পার্বত্য বাঙ্গালী নেতা হত্যার দায় হতে মুক্তি পায়। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক মানবাধিকার সংগঠনের তদন্ত, মিডিয়ায় প্রতিবেদন ঘটনার শেষ ভাগটি উপস্থাপন করে লংগদু হত্যাকাণ্ডে উপজেলার বাঙ্গালীদের খুনী হিসেবে প্রমাণ করেন। উপজাতিদের ঘর পোড়ার দায়ে শতশত বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে জুড়ে দেওয়া হয় মামলা। মামলার যাঁতাকলে পৃষ্ট হয়ে সেদিন বাঙ্গালী হত্যার বিচার ম্লান হয়ে যায়। ঘর পোড়ানোর দায়ে বাঙ্গালীদের জেলে পাঠানো হলেও উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদ সরকার হত্যার দায়ে এখন পর্যন্ত খুনীদের বিচার হয়নি, হয়নি সঠিক তদন্ত।


এ ধরণের আরো লেখা:

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য গণহত্যা, বাঙালী হত্যাকাণ্ড, লংগদু
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন