আদিবাসীর স্বীকৃতি কেন রাষ্ট্র সইতে পারবে না
সাইদ আরমান ও মাজেদুল নয়ন
ঢাকা: আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের কাঁধে কি এমন অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তাবে যা সইতে পারবে না, তা বুঝতে পারি না। সরকার আদিবাসীদের যেন না দেখার ভান করছে। তারা যেন পাহাড়ে জুমচাষ দেখে না। বিস্ময়কর হলো, এতো বঞ্চনার মাঝেও আদিবাসীরা নিজস্ব ঐতিহ্য আর স্বকীয়তা ধরে রেখেছে। টিকে আছে। আশা ছেড়ে দেয়নি।
আদিবাসীদের হয়ে এভাবেই না পাওয়ার বেদনা ফুটিয় তুলছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে রাঙামাটিতে দীর্ঘক্ষণ একান্ত কথা বলেন ৫১তম এই চাকমা রাজা। যিনি মনেপ্রাণে প্রজাদের ভালোবাসেন। প্রজাদের খোঁজ নিতে ঘুরে বেড়ান পাহাড়ে পাহাড়ে।
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সাইদ আরমান ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়ন। সঙ্গে ছিলেন সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট শোয়েব মিথুন।
চাকমা রাজা বলেন, “আমাদের স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের কাঁধে এমন কি দায়িত্ব বর্তাবে? স্বীকৃতি না দিতে যেসব অজুহাত দেখানো হয়, তা কারণ হতে পারে না। বলা হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দেবে। কীভাবে এমন কথা বলা হয় বুঝি না। আমাকে রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করলে সেটি হবে সম্পৃক্ততাবাদ। আমি সেটি মনে করি। আমার নাম যদি সংবিধানে আসে তবে তো আমি রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে গেলাম। তাই নয় কি?”
অনেকটা দুঃখ আর প্রজাদের না বলা কথা নিজে বলতে গিয়ে ক্ষোভ নিয়েই বলেন, “বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে তো আরেকটি রাষ্ট্র ঘোষণা করতাম। আরেকটি সংবিধান চাইতাম। এই দেশে যুক্ত হলে আমি মনে প্রাণে বাঙালি হয়ে যাবো। আমার নামটা না থাকলেই বরং বিছিন্নতাবাদী হওয়ার সুযোগ থাকে।”
তিনি বলেন, “আদিবাসীরা তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখেনি। রেখেছে রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, জাতীয় আইনে যেটিই বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে আদিবাসী জাতি হিসেবেই আমরা পরিচিত। আমরা নতুন কিছু চাই না। এখন নতুন রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্ভুক্ত করুন। তবে প্রেক্ষাপট অনুসারে।”
নিজেদের আদিবাসী দাবি করার কারণ হিসেবে যুক্তিও তুলে ধরেন তিনি।
দেবাশীষ রায় বলেন, “যারা প্রথাগত আইনে চলছে, দলিল নেই, গোষ্ঠীগত বসবাস, তারাই আদিবাসী। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অধিকার ছাড়াও সমষ্ঠিগত অধিকার রক্ষা করে চলতে চাই। এরাই তো আদিবাসী। তবে আমাকে মেনে নিলেই কি সব ছেড়ে দিতে হবে? পাংখোয়ার কেউ কি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবে? হবে না। মেনে নিলে সরকারের উন্নয়ন নীতিতে শুধু মনে রাখতে হবে। এর থেকে বেশি দিতে হবে না। পদমর্যাদা মন্ত্রী হতে হবে না, শুধু দৃষ্টিভঙ্গীটা পাল্টাতে হবে।”
চাকমা সম্প্রদায়ের এই অভিভাবক বলেন, “এখানে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। আদিবাসীকে মেনে নিলে সমঅধিকার চর্চার সুযোগ হবে। আদিবাসীদের বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি প্রণয়ন করতে হবে। আমি জানি না, আরও শত বছর অপেক্ষা করতে হবে কি না।”
সাক্ষাৎকারে রাজা বলেন, “এতো ঝুঁকি আর প্রতিবন্ধকতা মেনে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রজাদের সন্তানেরা স্কুলে যাচ্ছে। যারা ক্ষুদ্র জনসংখ্যার জাতি তাদের একটু সমস্যা হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজন কম। তাদের সুযোগ কম, সামাজিক বন্ধন কম। তাদের জন্য আবাসিক সুবিধা করতে শহরে হোস্টেল থাকা দরকার। যাতে সেখানে থেকে পড়াশুনা করতে পারে। এরপরও সৎ সাহস রয়েছে। আদিবাসীদের জীবনটাও যেন একটা সংগ্রাম।”
“বিগত ১০ বছর ছাড়া সারা পৃথিবীতে যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, তাদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, আপনাদের সংবিধানে কয়টি শব্দ দিয়েছেন অথবা সংবিধান প্রণয়নের সময় রাষ্ট্র পরামর্শ করেছে কি না। উত্তর হবে, না।”
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন। উনি বলেছিলেন, চাকমা বাঙালি হতে পারে না। আমার জাতীয় পরিচয় বাঙালি হতে পারে না। সেটিই ঠিক। তখন সেটি মানা হলে আজ সমস্যা হতো না।”
রাজা বলেন, “আইনেও আছে আদিবাসী। ক্ষুদ্র, নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনেও ভেতরে বলা আছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলতে আদিবাসী বোঝাবে এটা আমরা লিখিনি। সাংসদরা দিয়েছেন। বর্তমান সরকারই করেছে।”
দেবাশীষ বলেন, “পাবর্ত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত অংশ অনেক রয়ে গেছে। এর বাস্তবায়িত অংশ ও পদ্ধতি কার্যকর করলে অনেক সুফল পাবো। সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাই না। হেডম্যানরা-কারবারিরা কীভাবে বিচার, আইনশৃংখলা পরিবেশ রক্ষা করবেন? কীভাবে প্রথাগত এসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে? আমরা প্রতীক্ষায় আছি, প্রধানমন্ত্রী এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে। তাদের সব ধরনের সহায়তা দেয়।”
তিনি বলেন, “একজন হেডম্যান ১ হাজার টাকা আর কারবারি ৫০০ টাকা ভাতা পায়। কীভাবে চলবে তারা? খাজনা যেটি পায় তাও খুবই নগণ্য। হেডম্যানরা না থাকলে মামলার চাপে ওসিরা থাকতে পারত না। তবে কেন সরকার তাদের সহায়তা দেবে না। দেখা যায়, একজন ৩ টাকার খাজনা পরিশোধ করে। অথচ তার পেছনে হেডম্যানের খরচ ২০ টাকা। অথচ এখানে সরকারের লোকজন রাখতেও তো খরচ করতে হতো।”
তিনি বলেন, “সরকার আদিবাসী না দেখার ভান করছে। সরকার পাহাড়ে জুম চাষ দেখে না। কেউ পছন্দ করে না। জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) বলেন, আদিম। আদিবাসী নাই বললে কি উড়ে যাবে? উড়ে যাবে না। প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে আছে। তবে দুর্বলভাবে আছে। রাষ্ট্রের সহায়তা দরকার।”
চাকমা রাজার মতে, পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে আরও শক্তিশালী করতে হবে। কেউ বলছেন, পূর্ণমন্ত্রী হলে ভালো হবে। কারণ প্রতিমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আঞ্চলিক পরিষদের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে। শক্তিশালী করতে হবে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে আদিবাসী ফোকাল পয়েন্ট থাকতে পারে। তবে মেইন স্টিমে আসবে। সেটি হলে হাস্যকর কিছু হবে না। সব মন্ত্রণালয়ের পাহাড়ের কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভেটিং পদ্ধতি হতে পারে। সেখান থেকে সেটি আঞ্চলিক পরিষদে আসবে। তারা মতামত দিয়ে পাঠাবে।”
“পাহাড়ি-বাঙালি পুলিশ এক সঙ্গে থাকলে স্বস্তি বোধ করেন স্থানীয়রা”- এ কথা জানিয়ে চাকমা সার্কেল চিফ বলেন, “এটি করলে সমস্যা কোথায়। প্রয়োজনে এক জাতির পুলিশ আরেক জাতির এলাকায় দেওয়া যেতে পারে। সব ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন। মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে কমিউনিটি পুলিশ চালু করা যেতে পারে।”
পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত বিষয়ে তিনি বলেন, “সাধারণ আদিবাসীরা এটি চায় না। আমি একবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, আমি নাকি দুই দলকে এক করে সংঘাতে লাগিয়ে দিচ্ছি। সেটি ঠিক নয়। আমি চাই না, আমার যুবকরা মারা যাক। আমি চেষ্টা করেছিলাম বছর তিনেক আগে। সংলাপও হয়। তবে বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যায়নি। ফসকে গেছে।”
বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর’র সৌজন্যে।
it’s totally bullshit!
Totally bullshit!