আদিবাসী শব্দের ব্যবহার সংবিধান পরিপন্থি

fec-image

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীগুলোর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের দেশে এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায়/ গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়েছে। উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি নেই।

সংবিধানই যেখানে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে তাই এ নিয়ে কারো মধ্যে দ্বিধা থাকার কথা ছিল না। গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর তথ্য অধিদপ্তর হতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধান উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মহলবিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে কখনোই কোনো আদিবাসীর বসবাস ছিল না। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী বা ‘এবোরিজিন্যালস’রা হচ্ছে— কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the soil।

প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উত্পত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা ওই অঞ্চলের অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা আদিবাসী নয়। বরঞ্চ বাঙালিরাই তাদের আগে সেখানে গিয়ে বসতি গড়েছেন।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে অত্যন্ত সঙ্গতকারণে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। চুক্তির ‘ক’ ধারার ‘১’ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে—‘উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন’। চুক্তির ‘খ’ ধারার ‘১’ উপধারায় বলা হয়েছে—‘পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহূত উপজাতি শব্দটি বলবত্ থাকিবে’। পার্বত্য শান্তি চুক্তির আগে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকাকালে জনসংহতি সমিতির কোনো নেতার মুখে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার শোনা যায়নি। চুক্তি পরবর্তী দশ বছরেও এ নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ নিজেরাও কখনো আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেন না। এক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে তারা কখনো উপজাতি আবার কখনো ‘জুম্ম জাতি’ উল্লেখ করেন।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার রাঙ্গামাটিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করেছিলাম, তখন সন্তু লারমা (জনসংহতি সমিতির সভাপতি) বলেছিলেন এই দেশে কোনো আদিবাসী নেই, এখানে আমরা সবাই উপজাতি। জুম্ম জনগণের আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে’।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের সময়ে আমি সন্তু লারমাকে বলেছিলাম এ সময়ে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলি, তখনও সন্তু লারমা রাজি হননি। সন্তু লারমা বলেছিলেন আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় সরকারিভাবেই লিখেছেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, কিছু জনগোষ্ঠী আছে উপজাতি।

মূলত এদেশে বিশেষ ভাবাদর্শ প্রচারে নিয়োজিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা, বিবৃতিতে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি শোনা যায়। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত গুটিকয়েক সংবাদমাধ্যমও আদিবাসী শব্দের ব্যবহারে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। এই প্রবণতা জোরালো রূপ ধারণ করে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ২০০৭’ গৃহীত হওয়ার পরপরই। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে তখন নতুন করে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। যুগ যুগ ধরে উপজাতি হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে হঠাত্ আদিবাসী অভিধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে।

গত ১০ মার্চ ঢাকায় টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে আদিবাসী ও দলিতদের অধিকার ও সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার চিত্রটি বেশ প্রকট। এক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোতেও দুর্বলতা রয়েছে।…তাই সংবিধানে আদিবাসী ও দলিতদের স্বতন্ত্র ও আলাদা পরিচয় নিশ্চিত করতেই হবে’।

সংবাদ সম্মেলনে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিতে আদিবাসী ও দলিতদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন কার্যকর করাসহ ১৩ দফা সুপারিশ করে টিআইবি।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী স্বীকৃতির দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবনের জন্য আদিবাসী শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, এক্ষেত্রে সাধারণত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেনশনের দোহাই দেওয়া হয়ে থাকে; কিন্তু জেনে রাখা ভাল যে, এই ঘোষণাপত্র এবং কনভেনশনের কোনোটির সঙ্গেই বাংলাদেশ নেই। আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে—এমন যুক্তি দেখিয়ে অনেকে বলেন, আদিবাসী আন্দোলনকারীরা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে মদদ দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী শব্দটির সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞাও আসলে নেই। জাতিসংঘের ফ্যাক্টশিটে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করে, জাতিসংঘের কোনো সংস্থাই এই শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রণয়ন করেনি। সংজ্ঞা স্পষ্ট না করেই আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধাদির কথা বিবৃত হয়েছে। এ কারণে আদিবাসী শব্দটিকে সুযোগসন্ধানী চক্র তাদের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

পৃথিবীতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যেসব দেশ জোরালো ভূমিকা পালন করছে সেসব দেশও আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এবং জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র-২০০৭ গ্রহণ করেনি। তারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে এমন কোনো কিছু করতে নারাজ। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শিতার পরিচায়ক তা বলাই যায়।

লেখক: সাংবাদিক, সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন