আধিপত্য বিস্তারের লড়াই: পাহাড় জুড়ে আতঙ্ক

pahar 1

বেলায়েত হোসেন, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে :
(পাঁচ)
পার্বত্য চট্টগাম জুড়ে সশস্ত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারে পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর দেড় শতাধিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করার পর অপহরণ,মুক্তিপন এবং চাঁদাবাজি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বছরে এ এলাকায় প্রায় ৩’শ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
 
সরেজমিনে জানা গেছে, জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ১৯৯৭ সলের ২ ডিসেম্বর সরকারের সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দেড় শতাধকি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে পাহাড়ী অঞ্চল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন নিরাপত্তাহীন। পহাড়ীদের বিবাদমান গ্রুপের মধ্যে  আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এবং উপদলীয় কোন্দল চরমে। শান্তি  প্রতিশ্রুতি দিয়ে সন্তু লারমা ও সরকারের মধ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হলেও কাঙ্খিত শান্তি ফেরেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ও বিলুপ্ত শান্তি বাহিনী প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হলেও পার্বত্য জনগণের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করতে পারেননি তিনি ।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির পর জেএসএস এর পাশাপাশি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন) সক্রিয় রয়েছে। সংগঠনগুলোর রয়েছে জুম্ম ন্যাশনাল আর্মি, ব্লাক ডগ এবং সদক নামে কয়েকটি  সংগঠন। চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিনই প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে  ইউপিডিএফ নামে একটি চুক্তি বিরোধী সংগঠনের আত্ম প্রকাশ ঘটে। চুক্তি বাতিল করে সেনা প্রত্যাহার, বাঙালীদের সমতলে পূনর্বাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে এ সংগঠন। তিন বছর আগে জেএসএস ভেঙ্গে জেএসএস (এমএন) নামে আরো একটি সশস্ত্র গ্রুপের জম্ম হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চুক্তির আগে উপজাতীয় নৃ-গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের হাতে ভাঙ্গাচোরা অস্ত্র থাকলেও এখন এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, এলএলজি, এসএমজি  এবং রকেট লাঞ্চলেরর মতো আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তার ব্যবহার করছে। এসব অস্ত্র সংগ্রহের উৎস মিজোরাম ও বার্মা। ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রাঙামাটির সাজেক এবং বান্দরবানের থানছির রির্জাভ ফরেষ্ট এলাকা। নিরপত্তা বাহিনীর একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, চুক্তির পর  থেকে জেএসএস (সন্তু) ইউপিডিএফ এবং জেএসএস (এমএন) গ্রুপের হামলায়  ছয় শতাধিক ব্যক্তি নিহত, সহস্রাধিক আহত এবং দেড় সহ¯্রাধিক অপহৃত হয়েছে। তিন গ্রুপের  মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বন্দুক যুদ্ধ ও নিরাপত্তা বাহিনীর টহল দলের উপর সহ¯্রাধিক বার হামলা হয়েছে। চাঁদাবাজদের দাপটে অতিষ্ঠ পাহাড়ী-বাঙালীরা। প্রসঙ্গত: চুক্তির আগে শন্ত লারমার নেতৃত্বাধীন কথিত শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র হামলায় সেনা সদস্যসহ

 এলাকার ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ দিনের দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে জানান, পার্বত্য চুক্তির পর  থেকেই সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলেছে। চুক্তির আগে জেএসএসকে চাঁদা দিলেই নিবিঘেœ ব্যবসা- বাণিজ্য করা যেতো। এখন পদে পদে চাদা দিতে হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা টোকেন দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী রেহাই পাচ্ছেন না। সবচে বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে পরিবহন, বনজ সম্পদ এবং উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। মোবাইল কোম্পানী, বিভিন্ন টোল কেন্দ্র, বাজার ডাক, ফসলের জমি, ঝুম চাষ, গবাদিপশু এমনকি পেশাজীবিদেরও বার্ষিক চাঁদা দিতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের মালিক, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক চাঁদা দিয়ে পরবর্তী বছরের টোকেন সংগ্রহ করেন। চাঁদা না দিলে অপহরণের হুমকি দেয়া হয় ।

পরিবহন মালিক সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাধীনমতকে জানান, ট্রাক, বাস বা কোষ্টার প্রতি বার্ষিক চাঁদা  ১১  হাজার টাকা, জীপ,চাঁদের গাড়ী ৪ হাজার টাকা, বেবিটেক্সী ২ হাজার, রিক্সা ৩ থেকে ৪শ, বড় সাইজের বাঁশ প্রতি হাজার ৬  ৮শ টাকা, কড়ই, গর্জন, চাপালিশ ও সেগুন প্রতিঘনফুট ৬০টাকা, গোলকাঠ প্রতি ফুট  ৩০ টাকা, কলা, আদা হলুদ,সবজি, ধান ও চাউল ভর্তি প্রতি ট্রাক ৭ শ টাকা, প্রতিটি বাছুর ৮০ থেকে ১শ টাকা, ষাড় বা গরু ১৫০ টাকা  ছাগল ৭৫ টাকা , রাইচ মিল থেকে ৩৫ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও কৃষক ও ঝুম চাষীদের চাঁদা দিতে হহচ্ছে নিয়মিত। একজন উপজাতীয় নেতা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত উপজাতীয় চাকরিজীবিদের বেতনের স্কেল হিসেবে বার্ষিক  চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন সংগঠনকে। সূত্র জানায়, চাঁদা আদায়ের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫ উপজেলা ছাড়াও প্রত্যেক ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে  কমিশনভিত্তিক কালেক্টর নিযুক্ত করা আছে। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাছে অভিযোগ না করেই গোপনে চাঁদা পৌছে  দেয়। ফলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেনা প্রশাসন।

সন্তু লারমা সমর্থিত জেএসএস কেন্দ্রীয় সহ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সজীব চাকমার দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি অভিযোগ প্রত্যাখান করে বলেন, জেএসএস গণতান্ত্রিক সংগঠন। অস্ত্রের রাজনীতি এবং চাঁদাবাজিতে বিশ্বাস করেনা। ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রদীপন খিসা ,ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় নেতা ও অঙ্গ সংগঠন গণতান্ত্রিক যুবফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা বলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছেন। ইউপিডিএফ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল; সদস্য, শুভাকাঙ্খী এবং জণগণের স্বেচ্ছায় দেয়া চাঁদার ওপর দল নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে  যোগাযোগ করে জেএসএস (এমএন) গ্রুপের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: মাসুদ করিম বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ সুপার শেখ মো. মিজানুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজি রুখতে জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে। সতর্কাবস্থায় আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন