ইউপিডিএফের হাতে ১ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র: বার্ষিক চাঁদা আদায় ৬০ কোটি টাকা

পার্বত্যনিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:
প্রসীত-রবি’র নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ এখন পরিবার ও আত্মীয়তন্ত্র পাটিতে পরিণত হয়েছে। অনেক নেতৃত্ব ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারী ও নারী কেলেংকারীসহ নানা অপকর্মে জড়িত। গোষ্ঠীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, স্বজনপ্রীতির কারণে পার্টির মধ্যে বিভেদ বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের রক্ষা করে সৎ ও যোগ্য নেতাকর্মীদের পদে পদে বঞ্চিত করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। হত্যা করা হচ্ছে বিরুদ্ধচারণকারীদের।

প্রসীত-রবি’র নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ তিন পার্বত্য জেলা থেকে ৫০/৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। এ অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে অস্ত্র ক্রয়ে। এছাড়া আইন-আদালত, কতিপয় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের পিছনে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ইউপিডিএফ’র অস্ত্র আসে ভারতের মিজোরাম হয়ে। ইউপিডিএফ’র সামরিক শাখায় তিনটি কোম্পানি রয়েছে। এদের কাছে রকেট লাঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ ও এম-১-এর মতো ভয়ানক অস্ত্রসহ প্রায় এক হাজার অত্যাধুনিক এবং ভারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তবে কোনো স্থায়ী সামরিক ক্যাম্প নেই। সবগুলোই ভ্রাম্যমাণ। বাঙালিদের সাথে পাহাড়ি নারীদের প্রেমের ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে ইউপিডিএফের প্রচ- বাধা রয়েছে। অবাধ্য হলে নিলামে তোলা, মৃত্যুদণ্ডসহ চরম খেসারত দিতে হয়।

প্রসীত-রবি’র নেতৃত্ব প্রত্যাখান করে বেরিয়ে এসে সদস্য গঠিত বর্মা-তরু নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) দুই শীর্ষ নেতা পার্বত্যনিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন পিলে চমকানো চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির একটি রেস্টুরেন্টে বসে পার্বত্যনিউজের পক্ষ থেকে এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। অডিও ও ভিজ্যুয়াল দুই পদ্ধতিতেই পুরো সাক্ষাৎকারটির রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। আর ঐদিনই প্রসীত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ানে শত শত কালো পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানানো হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে প্রসীত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে আধিপত্য বিস্তার ও রক্ষার লড়াই। এসময় থেকে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক চাঁদাবাজি, হত্যা ও অপহরণের পাশাপাশি নিরাপত্তার বাহিনীর সাথে মাঝে মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হতে থাকে তারা। এতে প্রাণ হারায় বহু নেতাকর্মী। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের মাথায় ইউপিডিএফ ভেঙ্গে যায়। গত ১৫ নভেম্বর ২০১৭ প্রসীত-রবি’র নেতৃত্ব প্রত্যাখান করে বেরিয়ে এসে তপন কান্তি চাকমা বর্মাকে আহ্বায়ক ও জলেয়া চাকমা তরুকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ১১ সদস্যের ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল।

নবগঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর আহ্বায়ক তপন কান্তি চাকমা বর্মা পার্বত্যনিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ইউপিডিএফ আবির্ভূত। ১১ সদস্য নিয়ে ছিল এর কমিটি। ব্যাপক জনসমর্থন না থাকলেও তৎকালীন পাহাড়ী ছাত্র ও যুব সমাজে কিছুটা প্রভাব ছিল। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে শুরু থেকে আমরা অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে এবং জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সংগঠনের স্বার্থে কাজ করেছি। সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাঁদের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল। তখন পর্যন্ত নেতাদের বাইরের চেহারায় সৎ ও যোগ্য বলে প্রতীয়মান হতো। কিন্তু মুখোশের আড়ালে নেতাদের ভিতরে যে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, চারিত্রিক স্খলন ও স্বেচ্ছাচারিতা ছিল আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মুখোশ উম্মুচন হতে লাগল।

আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরে পার্টির নিয়ম অনুযায়ী সমালোচনা-আত্মসমালোচনা ও দ্বন্দ্ব নিরসনের গঠনমূলক উপায়ে সমস্ত অভিযোগ ও দুর্বলতা পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পার্টির ভাবমর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পার্টির নেতৃত্ব বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বরং চরম অবহেলা করতে থাকে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের রক্ষা করে সৎ ও যোগ্য নেতাকর্মীদের পদে পদে বঞ্চিত করার প্রবণতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ কারণে সঞ্চয় চাকমা, দীপ্তিশংকর চাকমা, দীপায়ন খীসা, অভিলাষ চাকমা, সমীরণ চাকমা, অনিল চাকমা, ধ্রুবজ্যোতি চাকমাসহ আরো অনেক নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে দেশে-বিদেশে অবস্থান করছেন।

তাদের মধ্যে পার্টি কর্তৃক অনিল চাকমা ও অভিলাষ চাকমাকে খুন করা হয়েছে। তাছাড়াও অনিল চাকমার অনুসারী সন্দেহে লক্ষীছড়িতে রয়েল মারমাকে মার্সিং অবস্থায় পিছন থেকে সুপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় রঞ্জন মুনি চাকমা (আদি)-এর নেতৃত্বে বাঘাইছড়ি জারুলছড়িতে তার শ্বশুর বাড়িতে সাহসী ও দক্ষ কর্মী স্টেন চাকমাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এভাবে নিষ্ক্রিয় ১০ নেতাকর্মীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বর্মা বলেন, পার্টির এসব আদর্শহীনতা, অন্যায় দেখে আমরা কিছু লোক তিন বছর আগে নিষ্ক্রিয় হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা আমাদের সে সুযোগ দেয়নি। আমাকেও পর পর তিনবার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের জীবন রক্ষার্থে নিশ্চুপ বসে থাকার সুযোগ ছিলো না। আমরা আত্মরক্ষার্থে কিছু একটা করার মানসে জেএসএস সংস্কারের সাথে যোগাযোগ করি তাদের দলে যোগ দেয়ার জন্য। তারা রাজি থাকলেও ইউপিডিএফ থেকে চিঠি দিয়ে তাদের দলে আমাদেরকে নিতে নিষেধ করা হয়। ফলে আমরা জেএসএসের সাথে যোগ দিতে পারিনি। তাই আমার বাধ্য হয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করেছি।

তপন কান্তি চাকমা বর্মা বলেন, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়ে যেখানে সহযোগী গড়ে তুলে পার্টি এগিয়ে নেওয়ার কথা, সেখানে উল্টো দুর্নীতিবাজ, লোভী, অযোগ্য, বিতর্কিত তথা নিয়ম লংঘনকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সংগঠন চলানোর প্রতিবাদে আমরা দল গঠন করেছি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ^াস রেখে আমাদের নতুন সংগঠনের পথ চলা শুরু হয়েছে।
প্রসীতের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের ‘পূর্ণস্বায়ত্ত্বশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র সমাধান’ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশ। ‘পূর্ণস্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি রাষ্ট্রবিরোধী। আর সেনাবাহিনী কোথায় থাকবে এটা রাষ্ট্রই নির্ধারণ করবে।

তপন কান্তি চাকমা আরও বলেন, প্রসীতের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের জনস্বার্থ ও সংগঠন বিরোধী কর্মকা- পার্টির বৈঠকে বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিচার পাইনি। তাই সংগঠন থেকে বেরিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ায় বাধ্য হয়ে নতুন সংগঠন করেছি।

তিনি বলেন, দলের কেউ নিষ্ক্রিয় হলেও রেহাই নেই। তাদের গৃহবন্দী, গ্রাম বন্দী ও অর্থদ- করা হয়। অনেক সময় মেরে ফেলা হয়। সংগঠন ছাড়ার অপরাধে গত কয়েক বছরে ১০ নেতাকর্মীকে প্রসীত বিকাশ খীসার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে।

তপন কান্তি চাকমা বর্মা ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক নারীদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, উপজাতি মেয়েরা কোন বাঙালি যুবকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক করলে তাকে ও তার পরিবারকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। হত্যা, শারীরীক নির্যাতনের পাশাপাশি অর্থদ- করা হয়। রীনা দেওয়ান ও কবিতাসহ অনেক নারীদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রীদের পার্টির বাইরে কাউকে বিয়ে করার সুযোগ নেই।

ইউপিডিএফের সম্পদ প্রসঙ্গে বর্মা বলেন, চাঁদাবাজির মাধ্যমে ইউপিডিএফের বার্ষিক আয় ৫০-৬০ কোটি টাকা। এ টাকা তারা অস্ত্র ক্রয়, পার্টির পরিবার ও কল্যাণের পেছনে ব্যয় করে থাকে। কিন্তু এর বাইরে পার্টির নেতৃবৃন্দ এই অর্থ লুটপাট করে নিজেরা সম্পদের মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। সম্প্রতি এক নেতার বাড়ি থেকে ৮০ লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার হওয়া তার বড় প্রমাণ। ইউপিডিএফ তাদের সঞ্চয়কৃত অর্থ ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করে না। তবে বিশ^স্থ ব্যক্তিদের নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে বা তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে থাকে বলেও তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, ইউপিডিএফের দু’টি গঠনতন্ত্র রয়েছে। একটি গঠনতন্ত্র তারা জনগণ ও কর্মীদের মাঝে প্রকাশ করে। অন্য গঠনতন্ত্রটি পার্টির ৫/৬ জন সিনিয়র নেতা ছাড়া অন্যকেউ দেখতে পায় না। প্রকাশ্যে যাই বলুক প্রকৃতপক্ষে সংগঠন পরিচালিত হয় ঐ গুপ্ত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী।

আপনাদের নব্য মুখোশ বাহিনী বলা হচ্ছে কেন জানতে চাইলে বর্মা বলেন, আমরা মুখোশ পরে আছি কোথায়? ইউপিডিএফের যেভাবে জন্ম, আমাদেরও সেভাবেই জন্ম। তারাও সাংবাদিক সম্মেলন করে পার্টির আত্মপ্রকাশ করেছিলো, আমরাও সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমেই আমাদের পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছি। আমরা মুখোশ পরে নেই। তাদের দলের প্রতিষ্ঠার সাথে সরকারি কোনো সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, জেএসএস ইউপিডিএফের জন্মের ব্যাপারে একই অভিযোগ করে থাকে।

পার্টি চালাতে তো আর্থিক সমর্থন লাগে। আপনাদের দাবি অনুযায়ী ইউপিডিএফ না হয় চাঁদাবাজি করে চলে। কিন্তু আপনারা চলছেন কীভাবে- এ প্রশ্নের উত্তরে বর্মা বলেন, আমরা জনগণের কাছ থেকে সহায়তা নিই। ইউপিডিএফের মতো চাঁদার রেট বেঁধে দিই না। যার যেমন খুশি আমাদের সহায়তা করে।

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সদস্য সচিব জলেয়া চাকমা তরু বলেন, ইউপিডিএফ-এ ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে। ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীরা চরম হতাশাগ্রস্ত। লবিং-গ্রুপিং মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আমার লোক-উনার লোক বলে গোষ্ঠীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, স্বজনপ্রীতির কারণে পার্টির মধ্যে বিভেদ বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পার্টির কিছু সৎ নেতাকর্মীদের মুখের দিকে তাকিয়ে সকল প্রকার বৈষম্য ও বঞ্চনাকে মুখ বুঁজে সহ্য করেছিলাম। মূলতঃ ইউপিডিএফের মধ্যে একটি দুর্নীতির সিন্ডিকেট/চক্র সৃষ্টি করে নিজেরা অর্থশালী ও সম্পদশালী হওয়ার হীন উদ্দেশ্যে খুবই তৎপর। দায়িত্ব পালনের চেয়ে নিজের স্বার্থে অর্থ, খ্যাতি ও পদবী লাভ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সহকর্মীদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন এবং কর্মীরা যাতে তাদের বড় মন করে সে ধরনের আচরণ দেখান- যার ফলে কর্মীরা তাদরে ভয় পায়, সমস্যার কথা বলার সাহস পায় না।

অনেকে ইউপিডিএফ-এ যোগদানের আগে পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ হলেও বর্তমানে পার্টির দায়িত্ব পালনের সুবাদে যেন আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছে। ইউপিডিএফের অনেক নেতার অবস্থার উন্নতির পরিবর্তন মানুষকে অবাক করে তুলেছে। তাদের স্ত্রীদের স্বর্ণালংকারের অভাব নেই। তাদের ছেলের জন্মদিনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়। অনেক নেতা নানা অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত। কতিপয় নেতা জনগণের বা পার্টির লক্ষ লক্ষ টাকা দুর্নীতি করে ব্যবসা পরিচালনাসহ বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছে। অনেকের নামে-বেনামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স ও সম্পত্তি রয়েছে। তাই আমরা এই দুর্নীতিবাজ, প্রতারক ও নীতি-আদর্শহীন নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছি।

তিনি বলেন, ইউপিডিএফ যদিও নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক পাটি দাবি করে কিন্তু তাদের কাজেকর্মে তথা অকর্মী সুলভ আচরণের কারণে ইউপিডিএফ আজ ডাকাতের পার্টিতে পরিণত হয়েছে। যার কারণে ইউপিডিএফ তার নিজ কর্মীকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না।

নেতাদের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার অপরাধে গত কয়েক বছরে ১৭ জন নেতাকর্মীকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। এরা হচ্ছে সুমন চাকমা, স্টালিন চাকমা, পরাক্রম চাকমা, দম্বা চাকমা, দিবাকর চাকমা, সংগ্রাম চাকমা, কিশোর মোহন চাকমা, দুর্জয় চাকমা, বরুণ চাকমা, জ্যোতি বিকাশ চাকমা, দেব বিকাশ চাকমা, স্টেন চাকমা, জেনেল চাকমা, সাজেকে বীর চাকমা, তুহিন চাকমা, তনদ্রুং চাকমা ও রাহুল চাকমা।

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সদস্য সচিব জলেয়া চাকমা তরু আরও বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রামে শতকরা ৯০ জন মানুষ জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। ইউপিডিএফ সবুজ বনভূমি রক্ষা বা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার নামে জুম চাষ বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি রাবার গাছ, সেগুন গাছ ও বাগান সৃজন করা বন্ধ করে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জুম্ম জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাদের পছন্দমত ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা এবং জনগণকে শারীরিক নির্যাতন ও হাজার হাজার টাকা আর্থিক দ-ে দ-িত করে জনগণের যৌক্তিক কণ্ঠ রোধ করে দেওয়াটা ইউপিডিএফের উদ্দেশ্য।

তিনি বলেন,পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য ফলদ বাগান নষ্ট করে দেওয়া এবং ট্রাক পুড়িয়ে দেয়াসহ শিক্ষা সফরে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বাস ডাকাতি-ইউপিডিএফের নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে।
জলেয়া চাকমা তরু বলেন, জুম চাষ বন্ধ করে দেওয়া হলেও কোন কোন জায়গায় জুম চাষে উৎপাদিত কাঁচামাল যেমন- আদা, হলুদ, তিল, তুলা, মরিচ জব্দ করে আত্মসাৎ করছে। সম্প্রতি জুম চাষ বন্ধ করার নামে মাইচছড়ি ছাদি পাড়ায় ত্রিপুরাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, বিগত ১৮ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এইভাবে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন কায়েম করার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ জুম্ম জনগণের একটা অংশ এই জঙ্গী চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর ইউপিডিএফের অনেক দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীও আজ চরম বিপদে। কারণ ইউপিডিএফ সংগঠনে যোগ দেওয়া যায়, কিন্তু সরে আসার কোন সুযোগ থাকে না।

তিনি ইউপিডিএফের কাছে যারা জিম্মী তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আজ আমরা এই জিম্মীদশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য একজোট হই। ইউপিডিএফ নেতৃত্ব যদি তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনে সচেষ্ট না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।

প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, তপন কান্তি চাকমা বর্মা এবং জলেয়া চাকমা তরুর নেতৃত্বাধীন কোনো কমিটি সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না, অতএব তাদের অভিযোগ সম্পর্কেও আমাদের কিছু বলার নেই।

নবগঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর আহ্বায়ক তপন কান্তি চাকমা বর্মা এবং সদস্য সচিব জলেয়া চাকমা তরুর করা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসীত-রবি’র নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নিরণ চাকমা পার্বত্যনিউজকে মোবাইলফোনে জানান, এসব আসলে সবই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ। ইউপিডিএফ শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক একটি দল ছিল, এখনও তাই আছে। ইউপিডিএফ জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন করে বলে জনগণই আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে। তাই চাঁদাবাজি করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অস্ত্রেরও দরকার পড়ে না। তাই এক হাজার অস্ত্র থাকার অভিযোগটিও সত্য নয়। আর নিজেদের কর্মী হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউপিডিএফ কখনো হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, হত্যাকারী তো তারাই, নব্য মুখোশ বাহিনীর প্রধান তপন কান্তি চাকমা বর্মার বিরুদ্ধেই তো হত্যার অভিযোগ আছে। সে নিজেই তো ক্যাপ্টেন গাজী হত্যা মামলার আসামি। সে কীভাবে অন্যদের হত্যাকারী দাবি করতে পারে?

প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। এসব বিষয়ে নিরণ দাদার সাথে কথা বলেন। উনার কথাই আমার কথা।

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন