ইউপিডিএফ ভাঙার নেপথ্যে

কাজী সোহাগ |
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১৯ বছর বয়সী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে নভেম্বরে। নতুন সংগঠনের নাম ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’। ১৫ই নভেম্বর খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি।

ইউপিডিএফ থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত ও জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থি অংশের কিছু নেতাকর্মী এই দলটি গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি সংগঠনটি ভাঙার কারণ জানিয়ে পার্বত্যবাসীর কাছে ‘খোলা চিঠি’ নামে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। তারই একটি কপি মানবজমিনের হাতে এসে পৌঁছেছে।

সেখানে ইউপিডিএফ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিজ দলের নেতা-কর্মীকে খুন রয়েছে। খোলা চিঠিতে ইউপিডিএফ এর কাছে যারা জিম্মি রয়েছেন তাদের এক জোট হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী বিশেষ মহলের প্ররোচনায় ইউপিডিএফ নাম দিয়ে জুম্ম জনগণের একটা অংশকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। বিগত ১৮ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেল- এইভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ জুম্ম জনগণের একটা অংশ এই জঙ্গি চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

কারণ এই সংগঠনে যোগ দেয়া যায় কিন্তু সরে আসার কোনো সুযোগ থাকে না। খোলা চিঠির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ইউপিডিএফ এর ভ্রান্তনীতি, এক তরফা দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে আত্মরক্ষার পথ বেছে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ ছিল না বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী জুম্ম জনগণের কাছে খোলা চিঠি বা বিবৃতি দিতে বাধ্য হলাম। চিঠিতে মোবাইল নম্বরসহ নাম দেয়া হয়েছে বর্মা চাকমা ও তরু চাকমার। উল্লিখিত মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তা কেউ রিসিভ করেননি। এদিকে ১৬ পৃষ্ঠার খোলা চিঠিটি বিভিন্নভাবে পার্বত্য এলাকার জনগণের কাছে বিলি করা হচ্ছে।

খোলা চিঠিতে যা আছে-
চিঠির শুরুতে প্রিয় পার্বত্যবাসী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শুরু থেকে আমরা অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে এবং জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সংগঠনের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। কারণ আমরা জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের প্রতি আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। এ যাবৎ নেতাদের বাইরের চেহারায় সৎ ও যোগ্য বলে প্রতীয়মান হতো। কিন্তু মুখোশের আড়ালে নেতাদের ভেতরে যে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারী ছিল আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মুখোশ উন্মোচন হতে লাগলো।

আমরা বিষিয়টি বুঝতে পেরে পার্টির নিয়ম অনুযায়ী সমালোচনা-আত্মসমালোচনা ও দ্বন্দ্ব নিরসনে গঠনমূলক উপায়ে সমস্ত অভিযোগ ও দুর্বলতা পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পার্টির ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছি। পার্টির নেতৃত্ব বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে বরঞ্চ চরম অবহেলা করতে থাকে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের রক্ষা করে সৎ ও যোগ্য নেতা-কর্মীদের পদে পদে বঞ্চিত করার প্রবণতা ক্রমশ: বৃদ্ধি পেতে থাকে। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, এসব কারণে আজ সঞ্জয় চাকমা, দীপ্তিশংকর চাকমা, দীপায়ন খীসা, অভিলাষ চাকমা, সমীরণ চাকমা, অনিল চাকমা (গোর্কী), নিকোলাস চাকমা, দিলীপ চাকমা, পুলক চাকমা, দীপায়ন চাকমা, ধ্রুবজৌতি চাকমাসহ আরো অনেক নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে দেশে-বিদেশে অবস্থান করছে।

এদের মধ্যে পার্টি কর্তৃক অনিল চাকমা ও অবিলাষ চাকমাকে খুন করা হয়। এ ছাড়া অনিল চাকমার অনুসারী সন্দেহে লক্ষ্মীছড়িতে রয়েল মারমাকে পেছন থেকে সুপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় রঞ্জন মুনি চাকমার (আদি) নেতৃত্বে বাঘাইছড়ির জারুলছড়িতে তার শ্বশুর বাড়িতে সাহসী ও দক্ষ কর্মী স্টেন চাকমাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, এ অবস্থায় আমরা পার্টির সৎ, যোগ্য ও পরিশ্রমী নেতাকর্মীবৃন্দ নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। পার্টির মধ্যে বিভেদ বৈষম্য প্রকট হওয়ায় আজ চরম হতাশা বিরাজ করছে। মূলত ইউপিডিএফ এর মধ্যে একটি সিন্ডিকেট নিজেরা অর্থশালী ও সম্পদশালী হতে তৎপর। দায়িত্ব পালনের চেয়ে নিজের স্বার্থে অর্থ, খ্যাতি ও পদবি লাভের দিকে তাদের নজর বেশি।

এসব নেতাদের সুযোগের শুরুতে ও বিপদের শেষে দেখা মেলে। খোলা চিঠিতে বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। এ তালিকায় রয়েছেন, পার্টির কেন্দ্রীয় কালেক্টর রবি চন্দ্র চাকমা (অর্কিড/অর্নব), সমাজ প্রিয় চাকমা, জেএসএস থেকে বহিষ্কৃত প্রগতি চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব চাকমা, সুনেন্দু চাকমা, সমশান্তি চাকমা, কাঞ্চন চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রদীপন খীসা, কালোপ্রিয় চাকমা, শান্তিপ্রিয় চাকমা, রবি চন্দ্র চাকমা, সমির চাকমা, সুগত, জ্যোতিবিন্দু চাকমা, হ্যাচ্ছ্যা চাকমা, রাঙ্গ্যা চাকমা, রঞ্জনমুনি চাকমা প্রমুখ।

চিঠিতে ১০ জনের একটি তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, ইউপিডিএফ ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় হতে চাইলে আর্থিক দণ্ড দিতে হয়। এ মধ্যে রয়েছেন, খাগড়াছড়ির পানছড়ির জিতেন্দ্র পাড়ার শ্যামর চাকমা (কালেক্টর)। তার কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। একই জেলার লাম্বু পাড়া তারাবন্যার নিকের চাকমার কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের নাঙ্গেল পাড়ার উজ্জ্বল কান্তি চাকমা (প্রত্যয়) থেকে নেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

এ ছাড়া অন্যরা হলেন- বর্মছড়ির বড়ইতলির বিজিগুল চাকমা (ভাস্কর), নির্ণয় চাকমা, সতেজ চাকমা, এলিন চাকমা তনয় চাকমা ও দিবিন্দু চাকমা। তাদের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। চিঠিতে নিজ কর্মীদের খুনের উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ইউপিডিএফ যদি নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক পার্টি দাবি করে কিন্তু তাদের কাজ-কর্মে মনে হয় তারা ডাকাতের পার্টিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ইউপিডিএফ তার নিজ কর্মীকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না।

এ তালিকায় আছে সুবলং উকছড়ির সমুন চাকমা, রাঙ্গামাটির স্টালিন চাকমা, কুতুকছড়ি ইউপিডিএফ অফিসে দায়িত্বরত অবস্থায় খুন করা হয়েছে পরাক্রম চাকমাকে। অন্যদের মধ্যে রয়েছে অভিলাষ চাকমা (দল ত্যাগ করার কারণে), অনিক চাকমা গোর্কীদম্বা চাকমা, দিবাকর চাকমা, সংগ্রাম চাকমা, কিশোর মোহন চাকমা, দুর্জয় চাকমা, বরুণ চাকমা, জৌাতি বিকাশ চাকমা দেব বিকাশ চাকমা, স্টেন চাকমা, জেনেল চাকমা, বীর চাকমা, তুহিন চাকমা, তনদ্রং চাকমা, রাহুল চাকমা প্রমুখ।

সূত্র- মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন