একমাসে মিয়ানমারের আরাকানে চলে গেছে বান্দরবানের ৩১ উপজাতীয় পরিবার

নিজস্ব প্রতিনিধি:

প্রলোভনে পড়ে বান্দরবানে থানচি উপজেলার বড় মধক সীমান্তের লিটক্রে নামক স্থান থেকে দেশত্যাগ করে মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে পাড়ি দিয়েছে বহু  মারমা ও ম্রো পরিবার।  চলতি মার্চ মাসে ৩১ পরিবারের শতাধিক সদস্যের দেশ ত্যাগের তথ্য পাওয়া গেছে ।  মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী থানচি উপজেলার বড় মধকে কিছু পাড়া রয়েছে একেবারে মিয়ানমারের সীমান্তে ।

স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও কারবারীদের( পাড়া প্রধান) থেকে পাওয়া তথ্যনুযায়ী,  দেশত্যাগ করা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন কারবারী ছাড়াও গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও  রয়েছেন ।

এদিকে মারমা ও ম্রো কিছু পরিবার নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলে যাওয়া নিয়ে ইতোমধ্যে বান্দরবান জেলার আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে ।

ওই আইন শৃঙ্খলা সভায় থানচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ( ইউএনও) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকার কিছু পরিবারের দেশত্যাগ করার কথা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে শুনেছি । তারা কী কারণে দেশত্যাগ করলেন তা খতিয়ে দেখতে ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে ।

সরেজমিনে ৩ মার্চ শনিবার ভোর ৫টায় থানচি উপজেলা সদর থেকে ৯০ কিলোমিটার দুরে উপজেলার ১নং রেমাক্রী ইউনিয়নে পার্শ্বে শঙ্খ নদীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লিটক্রে নামক স্থানে থোয়াইচিং পাড়া গিয়ে এ প্রতিবেদক দেখতে পান, নয়টি পরিবার দেশত্যাগ করে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে ঘরের সব মালামাল গোছাচ্ছে ।  তাদের মধ্যে ওই পাড়ার প্রধান কারবারী থোয়াইচিংও রয়েছেন ।

দেশত্যাগকারী  থোয়াইচিং কারবারী ও ক্যথোয়াইমং মারমা, অংসাচিং মারমা ও অনেকে দেশ ত্যাগের আগে পার্বত্যনিউজকে জানান, বিভিন্নজনের কাছ থেকে তারা শুনেছেন, রাখাইন প্রদেশে গেলে মিয়ানমার সরকার পাঁচ বছর  পর্যন্ত বিনাশ্রমে খাবার দেবে ।  দোতলা ঘরবাড়ী ও ৫ একর জায়গা জমি দেবে । এজন্য তারা দেশত্যাগ করছে।

তিনি আরো বলেন, এছাড়াও দুর্গম এই পাড়ায় খাবারে অভাব রয়েছে ।  গত বছরে জুম চাষ করে যা ধান পেয়েছে তার পুরোটাই দাদনদারদের দিতে হয়েছে । আবার একটি পরিবেশবাদী এনজিও সংস্থা লোকজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে  সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জুম চাষ না করতে, বাঁশ ও বেত না কাটতে তাদের নিষেধ করে গেছে । সবকিছু ভেবে তারা রাখাইনে চলে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিয়েছেন।

কীভাবে যাবেন জানতে চাইলে  অংসাচিং মারমা ও থোয়াইচিং মারমা বলেন, চিম্বুক পাহাড় ধরে সিন্ধু (থানচি পাশে উপজেলা আলিকদমে ক্রুকপাতা  ইউনিয়নের একটি জায়গা নাম)  হয়ে রাখাইনের বুসিডং-মংন্ডু শহরের দিকে চলে যাবেন তারা । ৫ দিনের পায়ের হাঁটার পথ ধরে সীমান্ত পার হওয়ার পাহাড়ী পথ চেনে এমন লোকজনও তাদের সঙ্গে যাবেন।

তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ড থেকে ফোশৈউ পাড়া থেকে তিন পরিবার, বড়মধক পাড়া থেকে ২ পরিবার, উসাথোয়াই পাড়া হতে  তিন পরিবার, ক্রাহ্লাঅং পাড়া হতে ২ পরিবার, চাইশৈউ পাড়া হতে ১ পরিবারসহ মোট ১২ পরিবার গত এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করছিল থোয়াইচিং পাড়ায়  ।

ওই দিন মোট ২১ পরিবার নিজেদের সামান্য কিছু মালামাল নিয়ে হেঁটে থানচি এবং আলিকদম উপজেলা মধ্যবর্তী চিম্বুক পাহাড় বা রংরাং পাহাড়ের দিকে চলে যায় ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, থোয়াইচিং পাড়া হয়ে চিম্বুক পাহাড়ে পথ দিয়ে হেঁটে রাখাইন প্রদেশে সীমান্ত পর্যন্ত যেতে তিন দিন লাগে । থানচি উপজেলা সদর থেকে শঙ্খ নদীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লিটক্রে এলাকার থোয়াইচিং পর্যন্ত সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলেও নৌকায় করে এবং পায়ে হেঁটে  সেখানে যেতে হয় ।

রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে মেম্বার মাংচং ম্রো ও ৯নং ওয়ার্ডে মেম্বার বাওয়াই মারমা থোয়াইচিং পাড়ার ৯পরিবারসহ তার ওয়ার্ড থেকে মোট মারমা ২১ পরিবার, ম্রো তাংখোয়াই পাড়া থেকে ১০ পরিবারসহ ৩১ পরিবারের দেশত্যাগের  কথা স্বীকার করেন।

তারা বলেন, চলে যাওয়া অনেক পরিবারকে বয়স্ক ভাতা, ৪০দিন কর্মসৃজন, ভিজিডি কার্ডধারী, বিধবা ভাতা ভোগীও ছিল।

জানতে চাইলে রেমাক্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা( রনি) পার্বত্যনিউজকে জানান, ৩১ পরিবারের দেশ ত্যাগ করে মায়ানমার চলে যাওয়ার কথা শুনেছি। তার আগে আমি লোকজনকে বুঝিয়েছি, সরকারীভাবে শঙ্খ নদীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বসবাসরত অধিবাসীদের পূর্ণবাসন করার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা পরিদর্শন করবেন এবং এ বিষয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে । কিন্তু বহিরাগত কিছু লোক গুজব ছড়িয়ে সহজসরল ও দরিদ্র লোকজনকে মিয়ানমার সরকার ঘর দেবে, বাড়ী দেবে, ৫ বছর খাওয়ানো হবে বলে প্রলোভন দেখিয়ে রাখাইন প্রদেশে সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুর্গম পাড়ায় গুজব ছড়াচ্ছে বলে তারা শুনেচ্ছেন ।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে হত-দরিদ্র মারমা ও ম্রো পরিবারের দেশত্যাগের বিষয়ে বিজিবি আলিকদম ৫৭ ব্যাটালিয়নের জোনাল কমাল্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল রেজাউল করিম বলেন, অত্যন্ত দুর্গম থোয়াইচিং পাড়া হতে ৯ পরিবার রাখাইন প্রদেশে বা মিয়ানমার চলে গেছে এমন তথ্য তারাও জেনেছেন।

এদিকে বাংলাদেশে থেকে উপজাতীয় বাসিন্দাদের মিয়ানিমার চলে যাওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবানের একটি সূত্র পার্বত্যনিউজকে বলেন, ২০১২ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পরও এভাবেই কিছু উপজাতীয় বাসিন্দা মিয়ানমারে চলে গিয়েছিল প্রলোভনে পড়ে।  পরে প্রতিশ্রুত সুবিধা না পেয়ে তাদের একটি অংশ আবার ফিরেও আসে।

এভাবে যাওয়ার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে মিয়ানমার সরকার সেখানে সেনা স্থাপনা তৈরি করছে। এ কাজে সহযোগিতার জন্য প্রচুর সিভিলিয়ানের প্রয়োজন হয়।  মিয়ানমার সরকার তাদের দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিভিলিয়ানদের আরাকানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সংঘাতমুখর পরিবেশে থাকতে অনিচ্ছুক তাদের অনেকেই আবার আগের জায়গায় ফেরত গিয়েছে।  এই প্রলোভনের অংশ হিসাবে বাংলাদেশের কিছু উপজাতীয় সদস্য মিয়ানমার গিয়ে থাকতে পারেন।

তিনি আরো বলেন, জুম চাষের কারণেও স্থানীয় উপজাতিরা নিয়মিতই মিয়ানমারে যায়। চাষের মৌসুম শেষে আবার ফেরতও আসে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন