এমপি কাজলকে ঠেকাতে মরিয়া একটি গ্রুপ : মহাজোট নেতারা ছুটছেন ঢাকায়

Mohammad Shahjahn

আসন্ন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : কক্সবাজার আসন -০৩

আবদুল্লাহ নয়ন, কক্সবাজার:
দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা কক্সবাজারে আসন্ন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নড়েচড়ে বসেছেন। দলীয়, ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের সম্ভাব্য নির্বাচনের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ দলের উর্ধ্বতন মহলে কড়া নাড়ছেন ‘মনোয়ন’ প্রত্যাশায়। তবে আগামী নির্বাচনে কক্সবাজারের ৪ আসনে রাজনীতির মোড় ঘুরে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সরকার-বিরোধীদলের নানা কর্মকান্ড সামনের নির্বাচনে দারুণ প্রভাব ফেলতে পারে।

বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোটের ব্যর্থতা এবং সরকারী দল হিসেবে মহাজোটের ‘অসফলতা’কে জনগণ নিবীড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। বিশেষ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেংকারী, শেয়ার বাজারে ধ্বস, ভিন্ন মতের উপর দমন-নিপীড়ন এবং হেফাজত ইস্যুকে পূঁজি করে নিজেদের জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন বিরোধীদল। আর ক্ষমতাসীনরা চাইছেন, স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে ‘ব্যবহার’ করে পুনরায় বিজয় লাভ করতে। সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনের অর্ধ বছর অবশিষ্ট থাকলেও গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে এমনকি চা’র টেবিলেও চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা।

কক্সবাজার সদর-রামু নির্বাচনী আসনটি বরাবরই বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। তবে এখানে বিএনপি ছাড়াও জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে। জামায়াত বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় ভোটের অঙ্কে এ আসনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

আসন্ন নির্বাচনে  আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হারানো এ আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করছেন সংগঠনটির নেতারা। তবে বিএনপির নেতারাও বসে নেই। তারা ইতিমধ্যে ঢাকার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের বাড়িয়ে দিয়েছেন। যোগাযোগ বাড়িয়েছেন গ্রাম-গঞ্জেও। দু’দলের নেতারাই পাল্টা দিয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তবে জেলা বিএনপির গ্রুপিং’টি জাতিয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন নেতাকর্মীরা।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের একটি সুত্র জানিয়েছেন, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদর-রামু আসনের মনোনয়ন লাভের জন্য কক্সবাজারের এক ডজন আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। এসব নেতার মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক ও ৩ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, ঝিলংজার সাবেক চেয়ারম্যান ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী জহিরুল ইসলামের পুত্র রাশেদুল ইসলাম। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাশেদুল ইসলাম নমিনেশনও পেয়েছিলেন। পরে ওই নমিনেশন পরিবর্তন করা হয়। রাজনীতির মাঠে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।

তবে তিনি জানিয়েছেন, “আপাতত এবছর নির্বাচনে লড়াই করার সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে বিরত রাখছি।”
এছাড়াও কক্সবাজার-সদর-রামু আসনে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর বড় ছেলে ও বর্তমান রামু উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, মেজ ছেলে  ও বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাইমুম সরওয়ার কমলও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
গতবার নমিনেশন পেয়ে বিপুল ভোটে হেরে যান কমল। দল সরকার গঠন করলে তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়। পরে তিনি সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে ইমেজ সঙ্কটে পড়েন।

অপরদিকে কক্সবাজার সদর-রামু আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ আসনে এবার মনোনয়ন যুদ্ধে নতুন কোন মুখ নেই। গতবারের প্রার্থীরাই এবারও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত মনোনয়ন দৌঁড়ে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। গতবারের মনোনয়ন বঞ্চিত সাবেক এমপি মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান এবারও মনোনয়ন চাইবেন। সংস্কারপন্থি গ্রুপের নেতা হিসেবে গতবার তিনি মনোনয়ন দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়েন। মনোনয়ন না পেয়ে দলীয় প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। বিদ্রোহী এ প্রার্থী ৬০ হাজারেরও বেশি ভোট পান। সংস্কারপন্থি বদনাম থাকায় সেই সময় তার পাশে দলের উল্লেখযোগ্য কোন নেতাকর্মী ছিলেন না। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। জেলা বিএনপির শক্তিশালী একটি গ্রুপ বর্তমান এমপি লুৎফুর রহমান কাজলকে মাইনাস করে তাকে প্রার্থী করতে চান। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি মাঠে রয়েছেন। মাঠে রয়েছেন বিএনপির বর্তমান এমপি লুৎফুর রহমান কাজলও।

এব্যাপারে বর্তমান এমপি লুৎফুর রহমান কাজল জানান, “দলীয় সিদ্ধান্ত অর্থাৎ নেত্রীর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হিসেবে মেনে নিবো। নেত্রী অনুমতি দিলে নির্বাচন করবো। আর নমিনেশন না পেলে দলের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করবো।”
তিনি আরো জানান, “জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। নিজস্ব তহবিল থেকে নির্বাচনী এলাকার লোকজন যখন-যেখানে সহযোগিতা চেয়েছেন-তাও তিনি করেছেন”।
এরপরও নিজ দল ক্ষমতায় না থাকায় তার অক্ষমতা’র বিষয়টি জনগণ বুঝে দাবী করে তিনি বলেন, “১০ম জাতিয় সংসদ নির্বাচনেও জনগণ তাকে নির্বাচিত করবেন বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদী।”

সুত্র আরো জানায়, কক্সবাজার সদর-রামু নির্বাচনী আসনটি বরাবরই বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৯১ ছাড়া প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে এখানে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এখানে বিএ রশিদ ও শাহজাহান চৌধুরী এমপি ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলে নির্বাচনী এলাকা ভাগ হওয়ার পর কক্সবাজার, সদর, রামু আসনে পর পর দু’বার এরশাদের প্রার্থী জয়ী হন। এর পর ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে জয়লাভ করেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক শ্রমমন্ত্রী মরহুম মৌলানা ফরিদ আহাম্মদের পুত্র এডভোকেট খালেকুজ্জামান। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে রামু নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি মারা যান। বন্ধ হয়ে যায় নির্বাচন। পরবর্তী তফশিলে লুৎফুর রহমান কাজলকে মনোনয়ন দেয়া হলে খালেকুজ্জামান অনুসারীরা তা মেনে নেয়নি। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে প্রার্থিতা পরিবর্তন করে খালেকুজ্জামানের ছোটভাই শহীদুজ্জামানকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এক প্রকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শহীদুজ্জামান নির্বাচিত হন। ২০০৮-এর নির্বাচনে সংস্কারবাদিতার অভিযোগে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ষাট হাজার ভোট পান।  আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে লুৎফুর রহমান কাজলের মনোনয়ন চূড়ান্ত হলেও বসে নেই শহীদুজ্জামানও। তিনি গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা যায়, একটি শক্তিশালী গ্রুপ কাজলকে ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। লুৎফুর রহমান কাজল বিরোধী গ্রুপটি মোহাম্মদ শহীদুজ্জামানকে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার জন্য উপর মহলে চেষ্টা-তদবির করছেন বলে জানা গেছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন