কক্সবাজারে জেলেদের মানববন্ধন-স্বারকলিপি পেশ-সংবাদ সম্মেলন

fec-image

সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজার-টেকনাফে সমুদ্র সীমানায় ২০ মে থেকে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এরপর থেকে বোট মালিক ও জেলেরা একপ্রকার আন্দোলনে নেমেছে। মানববন্ধন-স্বারকলিপি পেশ ও সাংবাদিক সম্মেলন করে সেই দুর্ভিক্ষ আইন অন্তত সংশোধন করতে অনুরোধ জানান।

রবিবার (২৬ মে) সকালে এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে বিশাল মানববন্ধন, জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্বারকলিপি দিয়েছেন। পরে কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নৌকা মালিক সমিতির নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে নৌকা মালিক সমিতির পক্ষে টেকনাফের সোলতান আহমদ বিএ বলেন, টানা ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞায় কক্সবাজার-টেকনাফের জেলেদের মধ্যে চরম অসেন্তাষ দেখা দিয়েছে। এমনিতে গত দুই বছর ধরে টেকনাফে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। কথিত মাদকপাচারের ভূয়া অজুহাত তুলে এ কালো আইন করে একমাত্র উপার্জনকৃত জেলেদের অনাহারে বসিয়ে রেখেছে সরকার। তার উপর আবার এখন ৬৫ দিন একটানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। এভাবে তো চলতে পারে না। এখন পবিত্র রমজান-সামনে ঈদ আমরা করব কি? খাব কি? সন্তান পরিবার-পরিজনকে নিয়ে কি করবো সেই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। এই আইন বাতিলে প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাওয়ারও হুমকি দেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে টেকনাফে নেই সুপারী-পান ব্যবসা। এই মৌসুমে আছে শুধু মাছ আহরণ। সেই মাছ ধরার মৌসুমে পেটে এমন ধাক্কা মারবে তা কখনো কল্পনা করিনি। আমাদের বোট ও জেলেরা মূলত ফজরের পর থেকে দুপুর পর্যন্ত সাগরে থাকে। কিন্তু কেন কি অজুহাতে এতোদিন মাছ ধরতে পারবে না তা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। জেলেরা এই সময়ে উপার্জনহীন হয়ে পড়ার শঙ্কাও তুলে ধরেন তিনি। এমনকি কিছুদিন আগে মাছ ধরতে যেতে না পেরে সংসারে ভরণপোষণ দিতে না পেরে সাবরাংয়ের এক জেলে ঝাউগাছে রশি বেধে আত্মহত্যা করেছে। সেই রকম ঘটনা সামনে আরও ঘটবে। সেই দায়িত্ব সরকারকে নিতেই হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য নৌকা মালিক ও জেলেরা জানান, তারা মহাজন ও আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়েছেন। এনজিও থেকে ঋণ এবং চড়া সুদেও টাকা এনেছেন অনেকে। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সমুদ্রে মাছ ধরতে না পারলে তাদের পক্ষে ঋণ শোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো জাল-ট্রলার বিক্রি করে এসব দেনা শোধ করতে হবে। আর কি খেয়ে বেঁচে থাকবো।

নৌকা মালিক আবদুস সালাম বলেন, ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন সমুদ্রে সব ধরণের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। কিন্তু জেলে পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনাফের প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শুধুই কি চাল খেয়ে বেঁচে থাকা যায়।

তিনি আরও বলেন, আমরা মাছ ধরে দৈনিক যা আয় করি, তা দিয়েই সংসার চলে। প্রায় আড়াই মাস যদি মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে এতোগুলো পরিবার চলবে কীভাবে? আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা পুনরায় বিবেচনা করুন। জেলেদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিন।

অপরদিকে স্বারকলিপিতে বলা হয়েছে, এখন পবিত্র রমজান মাস। সামনে ঈদ। টানা ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কারনে টেকনাফের ৪০ হাজার জেলে পরিবারে এখন হাহাকার চলছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এসব পরিবারের ঈদ উদযাপনসহ রমজানের সার্বিক কর্মকান্ড। এমনিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ইয়াবা পাচাররোধে টেকনাফের অন্যতম মৎস্য ক্ষেত্র নাফ নদীতে মাছ আহরণ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধের সিদ্ধান্ত জেলে পরিবারে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। প্রতিবছর আমরা আশ্বিন মাসের প্রথম তারিখ থেকে ২২দিন ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্ত মেনে চলি। এতে টানা ২২দিন জেলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

স্বারকলিপিতে আরও বলা হয়, গভীর সাগরে বড় বড় ট্রলার গুলো টলিন জাল যোগে মাছ ধরে থাকে। ওই সব টলিন জাল যোগে মাছ ধরা ৬৫দিন বন্ধ রাখতে ২০ মে ২০১৫ সালে সরকার একটি গেজেট প্রকাশ করে। এ গেজেটের আদেশ মূলত ছোট নৌকার জন্য প্রযোজ্য নয়। তবুও নানা কারনে এখন ওই ছোট নৌকার মাছ ধরাও এই প্রথম ৬৫ দিন বন্ধ রাখার আদেশ কার্যকর হচ্ছে।

এদিকে মৎস্য অধিদফতার সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশসহ অন্যান্য বড় বড় মাছের প্রজনন মৌসুম। এসময় মাছ শিকার করলে মৎস্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। তাই ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মৎস্য নৌযানের বাণিজ্যিকভাবে যেকোনো প্রকার মৎস্য ও ক্রাস্টশিয়ান্স আহরণ বন্ধ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে সমুদ্রে মাছের এই প্রজনন মৌসুমে (২০ মে থেকে ২৩ জুলাই) মাছ ধরা আইন চালু করা হয়।

স্বারকলিপি-মানববন্ধন ও সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টেকনাফ নৌকা মালিক সমিতির সভাপতি বেলাল উদ্দিন, সহ-সভাপতি আবদুল গফুর, সাধারণ সম্পাদক ডা: নুর মোহাম্মদ গণি, ফিরোজ মিয়া, আবদুস সালাম, মোহাম্মদ হাশেম, নুর মোহাম্মদ, মোহাং হোছন, নুর বশর, ছৈয়দ আহাং, তাজুল ইসলাম, মৌ: মোকতার আহমদ, রহিম উল্লাহ, নাজির আহমদ ও সিরাজুল হক প্রমুখ।

অপরদিকে এর আগে সকাল ১১টায় মানববন্ধনে কক্সবাজারের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অধিকার আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।

মানববন্ধনে কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, এই অনাহারী কালো আইন অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। না হলে জেলেদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন করা হবে। গরিব অসহায় মানুষ কিভাবে ঈদ করবে? কিভাবে সংসার চালাবে? তা অবশ্যই সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

সাংবাদিক ও অধিকার আন্দোলনের নেতা এইচএম নজরুল ইসলাম জানান, সীমান্ত ও সাগরে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনদিন মাদক বন্ধ হবে না। খোঁড়া অজুহাত তুলে টানা ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ এটা জেলে ও মালিকদের পেটে লাথি মারার সমান। আমরা দ্রুত এ আইন বাতিল চাই। আর না হয় জেলে পরিবারের মানুষ না খেয়ে মরবে এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, জেলে
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন