ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ী হচ্ছে রোহিঙ্গারা!

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—প্রায় সব বয়সী রোহিঙ্গাই এই জেলায় বিভিন্ন এলাকায় কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। তারা ক্যাম্পে থাকা ও বাইরে গিয়ে কাজ করা—দুটোই চালাচ্ছে সমানতালে। স্থানীয় বাঙালিরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এভাবে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগে ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ী হচ্ছে।

গত ৩১ অক্টোবর, ১ নভেম্বর ও ২ নভেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী-১, বালুখালী-২, রাজপালং, কুতুপালং, ময়নারগোনা ক্যাম্প ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং এসব ক্যাম্প ও এসব অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বেশিরভাগই অটোচালক, দোকানের কর্মচারী, মেকানিক ও স্থানীয়দের ঘরের কাজে যুক্ত হয়েছে। অটোচালক হয়ে রোহিঙ্গাদের কেউ-কেউ আবার আশেপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পুরনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামে তৈরি পোশাক শিল্পে যোগ দিয়েছে বলে রোহিঙ্গারা জানায়।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় রোহিঙ্গা আলি আকবরের (ছদ্মনাম)। তিনি এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, তাদের একটি অংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে এসে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় কাজে যুক্ত হয়েছেন। তারা মিয়ানমারের পরিস্থিতি শান্ত হলে স্বদেশেও ফিরতে চান। তার কথায়, ‘আমি ২০০৯ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসি।

বর্তমানে পরিবারসহ বালুখালী-১ ক্যাম্পে আছি। আমার বাড়ি ছিল মিয়ানমারের বুচিডংয়ে।’
আলি আকবর বর্তমানে কক্সবাজার শহরের বিমানবন্দর এলাকায় একটি অটো গ্যারেজে কাজ করেন। সেখানে তিনি রঙমিস্ত্রির কাজ করছেন। তার সঙ্গে এই গ্যারেজে আছে আরও অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা। দুই বছর আগে তিনি বালুখালীর কুতুপালং ক্যাম্প এলাকায় বাড়িও বানিয়েছেন। গত বছরের শেষ দিকে মিয়ানমার ছেড়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এলে ওইসময় আলি আকবর কুতুপালং ক্যাম্পে নাম লেখান।

বাংলাদেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান রবি’র সিম ব্যবহার করেন আলি আকবর। তার ভাষ্য, ‘পুরো কক্সবাজারে পাঁচ হাজারের মতো নতুন-পুরনো রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে।’ এই পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কী ধরনের কাজে যুক্ত, এমন প্রশ্নের জবাবে তার দাবি- ‘তারা রিকশা ও অটো চালানো আর মাছ ধরার কাজে যুক্ত। কেউ-কেউ কেবল ঘোরাফেরা করেই দিন কাটায়। গ্যারেজে কাজ করে মাসে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা আয় করি।’
উখিয়া সদর বাজার থেকে বালুখালী যেতে কুতুপালং বাজারের আগে সড়কের বাঁ-পাশে পাহাড়ের ভেতর অবস্থিত মাদ্রাসা মুয়াজ বিন জাবাল। ঘন বনের ভেতরে বানানো মুয়াজ বিন জাবালের সহকারী শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন রোহিঙ্গা শিক্ষক আজিমুল্লাহ। ২০ বছর বয়সী এই শিক্ষক প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন বলে তিনি নিজেই জানান।

রোহিঙ্গা আলী আকবর (কক্সবাজারের একটি হোটেলে)কক্সবাজারের পুরনো শহরের একটি এলাকায় বসবাস করেন আরিফ নামে একজন রোহিঙ্গা। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। তবে তার কোনও সন্তান নেই। দুই মাস আগে কক্সবাজার শহরে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টেকনাফের শাহপুর দ্বীপের একটি ক্যাম্পে আমরা আছি।’

আরিফের সঙ্গে কথা বলার পর কথা হয় তার দুই বন্ধুর সঙ্গেও। এই দুই জনের নাম যথাক্রমে রিয়াজ ও শাকের। দু’জনই অটোচালক। তবে দিন শেষে তারা ফিরে যান ক্যাম্পে। মিজান আসহারী (ছদ্মনাম) নামে এক রোহিঙ্গা তার শ্বশুরের পরিবারের সঙ্গে টেকনাফের মুছুনি ক্যাম্পে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেই প্রায় ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে টেকনাফের ক্যাম্পে একটি বাড়ি বানিয়েছি।’

স্থানীয় অটোচালক মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলার শুধু বিমানবন্দর এলাকায় প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। অনেকেই স্থানীয় চায়ের দোকানে কাজ করছে।’ রোহিঙ্গা ইসমাইল কাজ করেন বিমানবন্দর এলাকায়। দশম শ্রেণি পাস এই রোহিঙ্গা যুবক কক্সবাজার শহরের যেখানে বসবাস করছেন, সেখানেই একজন স্থানীয় নাগরিক তাকে বাংলা বর্ণমালা শেখাচ্ছেন।

ইসমাইল বলেন, ‘আমার বাবা-মা এখনও মিয়ানমারের বুচিডংয়ে আছেন। ওই দেশে থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার হেঁটে সীমান্ত পার হতে হবে বলে বৃদ্ধ মা-বাবা বাংলাদেশে আসতে পারেনি। তারা মোটামুটি ভালো আছেন। তবে মিয়ানমারে দোকানপাট বন্ধ আছে। মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে খবর নিই।ন আমি কাঠমিস্ত্রির কাজ করছি। শহরে মিস্ত্রির কাজে অর্ডার হলে আমার ডাক পড়ে। দিনে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার হয়।’

কক্সবাজার শহরের চরপাড়া, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়। এর বাইরে চট্টগ্রাম, পটিয়া, আমিরাবাদ, আরফিননগর, স্থানীয় বাংলাবাজারেও ছড়িয়ে আছে তারা।

রোহিঙ্গাদের বাইরে থাকার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে হারে রোহিঙ্গারা এখানে স্থায়ী হচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর তারাই এখানকার প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে!’

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে যা যা করণীয়, তা করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের দলের প্রধান বলেছেন, তাদের এখানে স্থায়ীভাবে রাখা সম্ভব না। কিন্তু তারা কাজের জন্য ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের নগদ টাকা দেওয়া দরকার, কারণ তারা নগদের আশায় ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে গেছে।

এটা ঠেকানো না গেলে খুব সমস্যা হবে।’ সম্প্রতি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এসেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘প্রথমত এত রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে বেঁধে রাখা যাবে না। তারা বেরিয়ে পড়বেই। তারা উৎপাদনশীল কোনও কাজ করছে না। একসঙ্গে এত লোককে আটকে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার।’ সুজনের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই উদ্যোমী। তারা বেরিয়ে পড়বেই। ফলে সমাধান হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব তাদের দেশে ফেরানো দরকার।’

মাদ্রাসা-মুয়াজ-বিন-জাবালের-হেফজ-খানায়-রোহিঙ্গা-ছাত্র-ও-শিক্ষক-আজিমুল্লাহরোহিঙ্গারা স্থায়ী হলে বাঙালিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন বদিউল আলম মজুমদার। তার সতর্কভাষ্য, ‘দ্বিতীয়ত আমাদের ব্যবস্থাই হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত। এ কারণে রোহিঙ্গারা অর্থের বিনিময়ে সুযোগ আদায় করতে চাইবে।’

ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। রোহিঙ্গারা যেন কোথাও যেতে না পারে, সেজন্য আমরা ১১টি চেকপোস্ট বসিয়েছি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আটক করে ক্যাম্পে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে সেটা আমাদের জানালে অবশ্যই আমরা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।’

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন