খাগড়াছড়ি প্রয়াত মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সেইনের শিক্ষাবৃত্তি অনুষ্ঠানে অবিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার আহবান 

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি:

মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সেইনের বিরল অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত না পেলেও খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন তার নামে শিক্ষাবৃত্তি চালুর মাধ্যমে অবশেষে স্থানীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলেন। সেনাবাহিনীর এ মহতি উদ্যোগ সর্ব মহলের প্রশংসিত হয়েছে। দাবি উঠেছে এ প্রয়াস অব্যাহত রাখার। অনুষ্ঠানে সম্প্রীতির খাগড়াছড়ি গড়ার জন্য   পাহাড়ি-বাঙালি অবিশ্বাসের প্রাচীর তৈরি হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলার আহবান জানার বক্তারা।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্নে ১নং সেক্টরের অন্যতম সূতিকাগার ছিল রামগড়। চট্টগ্রাম থেকে রামগড় যাবার পথেই মানিকছড়ি রাজবাড়িরঅবস্থান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগঠকদের সহজ যাতায়াত পথ ছিলো ফটিকছড়ি থেকে মানিকছড়ি হয়েই। জীবন বাঁচাতে পলায়ন উম্মুখ হাজার হাজার শরণার্থীরা মাঝপথে বিশ্রামের জন্য বেছে নিয়েছেলেন ‘মং রাজবাড়ি’ কেই।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িস্থ ‘মং রাজবাড়ি’ বৃহত্তর চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের কাছে ছিল নির্ভরতার এক অনন্য ঠিকানা। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি লাগোয়া এই রাজবাড়িরকর্ণধার প্রয়াত মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সেইন মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উদার চিত্তে শামিল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও রসদ প্রদানে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল প্রধানের মধ্যে একমাত্র মং সার্কেল চিফ মং প্রু সেইন-ই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিলেন। রাজ ভান্ডার উজার করে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের কাতারে। তিনিই আমাদের অস্থায়ী সরকারের কাছে ১১শ’ ডলার দান করেছিলেন। যা ছিল প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের ঘটনা। শুধু কী তাই, তিনি রাজ পরিবারের ৩৩টি বন্দুক এবং কয়েকটি দামি গাড়িও তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। কিন্তু তার এ অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি মেলেনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সেইনের বিরল অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন উদ্যোগ নেয়, খাগড়াছড়িতে এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারী কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘সার্কেল চিফ বীর মুক্তিযোদ্ধা মং প্রু সেইন’ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার।

রবিবার (৩১ মার্চ) দুপুরে স্থানীয় টাউন হলে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন আয়োজিত শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে  প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা  এমপি।

খাগড়াছড়ি রিজিয়নের আঞ্চলিক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক এর সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল গাজী মাহমুদ সাজ্জাদ, ডিজিএফআই এর কর্ণেল জিএস কর্ণেল মো. নাজিম উদ্দিন, জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান, খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ সাচিংপ্রু চৌধুরী ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল আলম।

পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি সম্প্রীতির খাগড়াছড়ি গড়ার জন্য আহবান জানিয়ে বলেন, পাহাড়ি-বাঙালি বলতে বলতে আমরা এটাকে বেশি শক্তিশালী করে ফেলেছি। এ পাহাড়ি-বাঙালি প্রাচীর ভেঙ্গে খাগড়াছড়িবাসী ও বাংলাদেশী এ পরিচয়ে আমরা যেন ঐক্যের বন্ধন আরও সু-দৃঢ় করে আমাদের মধ্যে যে অবিশ্বাসের প্রাচীর তৈরি হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আমরা সবাই একই মায়ের অভিন্ন সন্তান। আমাদের পরিচয় বাংলাদেশি।

খাগড়াছড়ি রিজিয়নের আঞ্চলিক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক বলেন, আমরা সম্প্রীতির কথা বলবো। আমরা যাতে জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় বিনা বাঁধায়, বিনা  বৈষম্যে বেড়ে উঠতে পারে সেটাই হবে আমাদের লক্ষ্য। আমরা এমন কোন বক্তব্য রাখবো না, এমন কোন কর্মকাণ্ড করবো না, এক সাথে বসবাসের সুন্দর পরিবেশটা নষ্ট হয়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, নতুন প্রজন্ম যাতে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় গড়ে তুলতে পারে তার জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যারা অশান্ত করতে চাইছে সন্ত্রাসীদের কোন ধরণের ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।

অনুষ্ঠানে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের আওতাধীন এসএসসি ও জেএসসি’র ৪০ কৃতি শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের এ উদ্যোগ পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও সু-দৃঢ় করবে।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শানে আলম ও জেলা পরিষদ সদস্য মংশেপ্রু চৌধুরী অপু খাগড়াছড়ি সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগকে খাগড়াছড়ির সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, খাগড়াছড়ির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: খাগড়াছড়ি, মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সেইনের শিক্ষাবৃত্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন