গুইমারায় অবৈধ ইট ভাটায় যাচ্ছে পাহাড় ও ফসলি জমির মাটি, পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, নিরব প্রশাসন

গুইমারা প্রতিনিধি:

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় ফসলি জমি ও জনবসতির মধ্যে গড়ে ওঠা অবৈধ তিন ইট ভাটায় নির্বিচারে পাহাড় ও তিন ফসলি কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে ও সংরক্ষিত বনের কাঠ পুঁড়িয়ে তৈরি করছে ইট।

নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইট তৈরির জন্য স্কেভেটার দিয়ে কেটে নিচ্ছে পাহাড়, তিন ফসলি কৃষি জমির টপ সয়েল (ওপরের স্থরের র্উবর মাটি )। তবে নিরব ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসন।

ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও কৃষকরা। এতে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে কৃষি জমির র্উবর শক্তি অন্যদিকে মাটি কাটার ফলে উৎপাদনশীল জমি গুলো দিনে দিনে ছোট ছোট পুকুরে পরিনত হয়ে কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। মাটিবাহী ট্রাকের বেপরোয়া যাতায়তের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ আমতলীপাড়া ওবাইল্যাছড়ি এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট ও গ্রামের স্বাভাবিক পরিবেশ।

অনেকে ভাবছেন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩’এর উর্ধ্বে ইট ভাটার প্রভাবশালী মালিকরা। তাই আইন লঙ্গণ করে সহজে ইট তৈরির জন্য র্নিবিচারে পাহাড় ও ফসলি জমির মাটি কেটে নিলেও নেওয়া হয় না আইনগত কোন ব্যবস্থা।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইট ভাটার মালিকদের অর্থের জোগানে ম্যানেজ প্রশাসন। প্রতিবছর  পাহাড় ও ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা, অবৈধভাবে  ইটের ভাটায় লাকড়ি পোড়ানো নিয়ে প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় প্রশ্ন তোলে তাঁরা।

গতবছরে আমতলী পাড়া এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলো। তবুও প্রশাসন অবৈধ ইট ভাটা গুলো উচ্ছেদ করেনি। মাঝে মাঝে প্রশাসনের  কর্তা ব্যাক্তিরা লোক দেখানোর জন্য সামান্য জরিমানা করে চলে যান।

তবে মাটি কাটা, লাকড়ি জ্বালানো বন্ধ বা ভাটাগুলো উচ্ছেদ করা হয় না। এজন্য ভাটাগুলো চলে তাদের নিজস্ব গতিতে। এলাকাবাসীর ক্ষতি হোক তবুও ইট ভাটার  ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে তৎপর অনেক কর্তাব্যক্তি। অনতি বিলম্বে সংশ্লিষ্ট  কর্তৃপক্ষ ইট ভাটা গুলো উচ্ছেদ করবেন বলে উপজেলার ভুক্তভোগিদের দাবি ।

সরেজমিনে পরিদর্শণকালে দেখা গেছে, বিগত মৌসুমে উৎপাদিত বহু ইট ভাটায় মজুদ রয়েছে। প্রতিদিন এসব ইট ও লাকড়ি বোঝাই ভারী যানবাহন চলাচলের ফলে গ্রামীণ রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙ্গে জনসাধারণের চলাচলে দূর্ভোগ চরমে উঠেছে। দিনের বেলায় রাস্তাঘাট ধূলায় একাকার হয়ে  স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীসহ সর্বসাধারণের চলাচলে  বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। বাধা দেয়ার কথা যাদের, তারা রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন।

উপজেলার আমতলী এলাকায় ড্রামসিট চিমনি দিয়ে ফোর স্টার ও শহিদ ব্রিকস নামে ২টি ইট ভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। অপরদিকে উপজেলার বাইল্যছড়ি এলাকায় প্রভাবশালী বিএনপি নেতা কামাল ব্রিকস নামে একই রকম একটি ইট ভাটা রয়েছে।

প্রতিটি ভাটায় বিপুল পরিমাণ পাহাড়ের মাটি ও কাঠের লাকড়ি মজুদ রয়েছে। ভাটাগুলি থেকে একযোগে নির্গত কালো ধোঁয়ায় আকাশ মেঘাচ্ছন্নের মতো আবরণ সৃষ্টি হয়। ভাটায় নির্গত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে এলাকাবাসী শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ছোট ছোট গাছ ভাটায় লাকড়ি হিসেবে ব্যবহারের ফলে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন।

ভাটায় যাওয়ার সময়ে লাকড়ির গাড়ি থেকে টোকেনের মাধ্যমে তোলা হয় নির্দিষ্ট হারে চাঁদা। সে চাঁদার ভাগ যায় বিভিন্ন ঘাটে। শ্রমিকদের পয়ঃনিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছে তারা ।

ইট প্রস্তুত ও ভাটাস্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৬ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোন কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না। এ আইন অমান্য করলে অনধিক ৩ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৩ (তিন) লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। মর্মে এ আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে। একই আইনের ৪ ধারায় উল্লেখ আছে, জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবেন না’। ৫ নং ধারায় বলা আছে, কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না’। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া, পাহাড় , জমি ও বিদ্যুতের পিলারের গোড়ার মাটি কাটছে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করছে। সব মিলিয়ে সকল আইনকে উপেক্ষা করে  অবৈধ  ইট ভাটার মালিকরা নাকে হ্যাঁ বানিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের ভাটা।

রামগড়ের অধিবাসী ভাটা মালিক শহিদ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সরকারিভাবে তাদের কোন অনুমতি নেই তবে আবেদন একটি করেছেন বহু আগে। সেই আবেদনপত্র দিয়েই সমিতির মাধ্যমে ম্যানেজ করে বাৎসরিক কোন এক নিয়মেই চলছে ইটভাটাগুলো। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন বিধি নিষেধ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাটার দায়িত্বরত এক ব্যক্তি জানান, প্রশাসন সব জানে মাঝে মাঝে সাংবাদিকরা নিউজ করলে এসে কিছু জরিমানা করে যায়। তবে উচ্ছেদ, লাকড়ি পোড়ানো বা পাহাড় ও জমির মাটি কাটার বিষয়ে কোন বিধি নিষেধ নেই।

তবে পরিবেশ অধিদফতরের খাগড়াছড়ি অঞ্চলের পরির্দশক মাইদুল ইসলাম জানান, খাগড়াছড়িতে পরিবেশ অধিদফতরের কোন জনবল না থাকায় জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাজ করতে হয়। তবে অবৈধ পাহাড়, জমি কাটা, জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার এবং পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া ইটভাটা স্থাপনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট পরিবেশ অধিদফতর থেকে লিখিতপত্র পাঠানো হয়েছে । তিনি আশা করছেন জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিগণ অবৈধ ইট ভাটা গুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন। অন্যথায়  পরিবেশ অধিদফতর ব্যাবস্থা নিবেন বলেও জানান তিনি।

গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, গুইমারায় কোন ইটভাটার লাইসেন্স নেই। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইট ভাটা মালিকদের বেশ কিছু জরিমানা করা হয়েছে। শীঘ্রই আবার অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন