চবি ছাত্রের কোটি টাকা উৎস ইয়াবা ব্যবসা

কক্সবাজার প্রতিনিধি:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রবিউল আলম (২৪) এখন কোটিপতি। কোনো চাকরি কিংবা বৈধ ব্যবসা না করেও তার ব্যাংক ব্যালেন্স কোটি টাকা। ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ রবিউল ধরা পড়ার পর এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

বন্দরনগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে ২৫ মার্চ(২০১৮) একটি পাজেরোসহ রবিউলকে গ্রেফতারের পর তার অর্থের উৎস অনুসন্ধান শুরু করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এতে টেকনাফ উপজেলার নাজিরপাড়ার সিদ্দিক আহমেদের ছেলে রবিউলের কোটিপতি হওয়ার নেপথ্য কাহিনী বেরিয়ে পড়ে।

পুলিশ জানায়, শুধু রবিউল নয়, তার আপন মামা শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হামজালাল, তার বড়ভাই ফরিদুল আলম, বাবা ছিদ্দিক আহমদ ও ভাবি রায়হানা আকতার সবাই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের ব্যাংক একাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের চিত্র পাওয়া গেছে। শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’র স্টিকার ও ভিআইপি ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড যুক্ত পাজেরো (নম্বর চট্ট-মেট্রো-ঘ-১১-০২৮৯) থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের পর পুলিশের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গাড়ি আটকের সময় চালক জসিম উদ্দিনের (২০) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পাজেরোটি ফরিদুলের। পুলিশের তদন্তেও এর সত্যতা উঠে আসে।

ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় করা মামলার তদন্ত করেন ইন্সপেক্টর মো. কামরুজ্জামান। বর্তমানে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামান সাতজনকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে টেকনাফের সিদ্দিক আহমেদ (৫৫), তার ছেলে ফরিদুল আলম (৩৫) ও রবিউল আলম (২৪), একই এলাকার জালাল আহমেদের ছেলে মো. জসিম উদ্দিন (২০), দিলদার আলমের ছেলে সামসুল আলম ওরফে শফিকুল ইসলাম (২৫), টেকনাফের মৌলভীপাড়ার জাকির আহমেদের ছেলে সৈয়দ আহাম্মদ (৩৫) এবং আবদুল মালেককে (৩০) অভিযুক্ত করা হয়। নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, আসামিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়।

এতে জানা যায়, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় ২০১৫ সালের ২৮ মে তিনি একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তার এ অ্যাকাউন্টে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ১৮৭ টাকা জমা পড়ে। একই শাখায় ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ তিনি একটি মুদারাবা মেয়াদি জমা হিসাব খোলেন। এতে ৩০ লাখ টাকা জমা রাখা হয়। গাড়ির ব্যবসা থেকে এ টাকা আয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও ট্রেড লাইসেন্স ও টিআইএন নম্বর দেয়া হয়নি।

রবিউলের ভাই ফরিদুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও মিলেছে অস্বাভাবিক লেনদেন। ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় তিনি একটি হিসাব খোলেন। ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ ব্যাংক হিসাবে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬৮ টাকা জমা হয়। এ হিসাবে অধিকাংশ টাকা ঢাকা নবাবপুর শাখা, রমনা শাখা, ইসলামপুর শাখা, গাজীপুর চৌরাস্তা শাখা ও নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে জমা হয়। এছাড়া একই ব্যাংকে তিনি ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর বিশেষ সঞ্চয়ী (পেনশন) হিসাব খোলেন। এতে ২০১৭ সালের ২ মে পর্যন্ত ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯২ টাকা জমা হয়। এছাড়া ফরিদুল ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে ৫৫ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯১ টাকা জমা পড়ে। একই ব্যাংকে ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি আরেকটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। এতে ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৪৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা জমা হয়।

বরিউলের বাবা সিদ্দিক আহাম্মদ ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। এতে পেশা হিসেবে মুদির দোকান ও লবণ ব্যবসায়ী উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭২ টাকা জমা হয়। টেকনাফে জনতা ব্যাংক শাখায় ১৯৯৫ সালের ২৯ আগস্ট তিনি একটি হিসাব খোলেন। এ হিসাবে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০ লাখ ৮১ হাজার ৫৭৫ টাকা জমা হয়।

ফরিদুলের স্ত্রী রায়হানা আক্তারের ব্যাংক হিসাবে মিলেছে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য। এর মধ্যে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট তিনি একটি হিসাব খোলেন। এতে পেশা হিসেবে গৃহিণী ও আয়ের উৎস হিসেবে স্বামীর ব্যবসা দেখানো হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩ মে পর্যন্ত ওই ব্যাংক হিসেবে ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৪ টাকা জমা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০/১৫ বছর আগের কথা। টেকনাফ শহর তখন বিকশিত হচ্ছে। সীমান্ত শহরের মাফিয়া ডনদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে ওঠে বেশ কয়েকটি নেতার ঘর। অনেকে এই ঘরগুলোকে হোয়াইট হাউজ ইন টেকনাফ ও মাফিয়া ডন হাম জালালদের নতুন আস্তানা বলে বেড়াত। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান, স্বর্ণ চোরাচালান, জাল টাকার ব্যবসা, অস্ত্র সরবরাহ, চাঁদাবাজি, কন্ট্রাক্ট কিলিং- এসব কাজ ওই নেতার বাসাতে বসেই করতো হামজালালের কুখ্যাত ‘ইয়াবা সিন্ডিকেট’। ইয়াবা ডন হামজালাল সিন্ডিকেটে উল্লেখযোগ্য সদস্য শীর্ষ ইয়াবা কারবারী ছিদ্দিক, জসিম উদ্দীন, ভাতিজা সফিক আলম, ইয়াবা সুন্দরী রশিদা বেগম, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াবা বাহাদুর (ক্রসফায়ারে মারা গেছেন), ইয়াবা কারবারী রবিউল ও তুহিনসহ অন্তত ২০ সদস্যের ইয়াবা সিন্ডিকেট। এসব কুখ্যাত ডনরা মিয়ানমার ছাড়াও টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ পুরো দেশে জুড়ে আছে হামজালালদের নেটওয়ার্ক।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ইয়াবা ডন এর পাশাপাশি দিনদুপুরে জ্যান্ত মানুষ হত্যাকারী হামজলাল ইয়াবা পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় তার আছে অন্তত ডজনাধিক মামলা। হামজালালের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য মামলা মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানা মামলা নং- ১৬, জিআর-৫৪। মাদক সহ আটক আটক হন ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০১৬। ডিএমপি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা মামলা নং- ৩৭, জিআর- ৩১৬। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আটক হওয়া মাদক মামলার আসামি। টেকনাফ থানা মামলা নাম্বার ৩৫/জিআর ৫৯১/তাঃ ১৫সেপ্টেম্বর ২০১৫.হত্যা মামলা। টেকনাফ থানা মামলা নং-৩৭, জিআর-২২৪. তাং-৩১ জুলাই ২০০৮। টেকনাফ থানার এসিড নিক্ষেপ মামলা নং-১৪, জিআর-১২৮, তাং-৩১আগষ্ট ২০০৫ সাল। টেকনাফ থানা মামলা নং-১১, জিআর-৫৬, তাং- ২৫ এপ্রিল ২০০৫ সাল। স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে অ্যাকাউন্টটি খোলা হলেও অধিকাংশ টাকা টিটির মাধ্যমে জমা হয়। এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আসামিরা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে তারা অবৈধ সম্পদের মালিক বনেছেন। তাদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ফাইল সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন