জুমের আগুনে জ্বলছে বান্দরবানের পাহাড়, ধ্বংসের মুখে বনাঞ্চল- প্রাণীজ সম্পদ

পার্বত্য নিউজ এক্সক্লুসিভ

জমির উদ্দিন, বান্দরবান :
জুমের আগুনে পুড়ছে বান্দরবান। আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের জন্য বান্দরবানে শত শত পাহাড়ের ঝোপ-জঙ্গল, মূল্যবান গাছপালা কেটে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। পাহাড়ি জুমিয়া পরিবারগুলোর লাগানো আগুনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি।

বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়কের আশে পাশে অসংখ্য পাহাড় জুম চাষের জন্য আগুনে পোড়াতে দেখা গেছে। বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী।

জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ে আগুন দিয়ে আদি পদ্ধতিতে জুম চাষ করে সারা বছরের খাদ্য শস্য ঘরে তুলতে পারলেও জুম চাষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটি ক্ষয় এবং প্রাণীকূলের খাদ্য ও বসবাসের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে।

কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে এবার বান্দরবানে সর্বাধিক জমিতে জুম চাষের প্রস্তুতি নিয়েছে পাহাড়িরা। জেলায় প্রায় ১১ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলা সদরের ডলুপাড়া, গেজমনি পাড়া, শৈলপ্রপাত, যৌথখামার এলাকা, কানাপাড়া, মেঘলা, মাঝেরপাড়া, আমতলীপাড়া, সাতকমলপাড়া, ফারুকপাড়া, বান্দরবান-চিম্বুক, বান্দরবান-রোয়াংছড়ি, বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়কসহ জেলার সাত উপজেলায় শত শত পাহাড়ে জুম চাষের প্রস্ততি নিয়েছে পাহাড়িরা।

সরজমিনে বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়িদের লাগানো জুমের আগুনে পুড়ছে অসংখ্য পাহাড়। আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের সবুজ শ্যামল পাহাড়গুলোর ঝাড়-জঙ্গল, গাছ-পালা কেটে নির্বিচারে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে জুম চাষের উপযোগী করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আগুনে পোড়ানো পাহাড়গুলো পরিষ্কার করে জুম চাষের প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে জুমিয়া পরিবারদের।

মূলত বছরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে জুমিয়ারা পাহাড়ে আগুন দেয় এবং মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। চিম্বুক সড়কের বাসিন্দারা হারেং ম্রো এবং খানসামার বাসিন্দার প্রুসাচিং মারমা জানিয়েছেন, পাহাড়ে জুম চাষ তাদের পূর্বপুরুষের আদি পেশা। তারাও জুম চাষের মাধ্যমে সংসার চালায় এবং বছরের খাদ্য সামগ্রী মজুদ করে। জুমে পাহাড়ি ধান, ভুট্টা, মরিচ, যব,সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, টকপাতা,মরিচ, এবং আদাসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ করে।

কৃষিবিদ আলতাফ হোসেন এবং মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জুম চাষ। পাহাড়ে জুমিয়া পরিবারদের লাগানো আগুনে গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী ধংস যাচ্ছে। মাটি ক্ষয় হয়ে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। সবুজ পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে গাছপালা, বন্যপ্রাণী এবং পাহাড়ধস রোধ করা সম্ভব হবে। জুম চাষের মাধ্যমে আরো অধিক ফলনও উৎপাদন সম্ভব হবে। তবে আমাদের পরিবেশবাদীরা অন্য অনেক বিষেয়ে সোচ্চার থাকলেও জুম চাষের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দুষণের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরব।

মৃত্তিকা ও পরিবেশবাদী সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, জুম চাষের ফলে বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাসকরে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস হচ্ছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। ভূমি অবক্ষয় সম্পর্কিত একজরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট পাহাড়ি ভূমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি এখন ক্ষয়ের মুখে। তার জন্য প্রধানত জুম চাষকে দায়ী করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে অপর এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, পার্বত্য চট্রগ্রামে ভূমিক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, পার্বত্যাঞ্চলে প্রতি হেক্টরে ১০০ থেকে ১২০ টন মাটি ক্ষয় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইউসিএন সংস্থার মতে, দুর্গমাঞ্চলে ১৯৬৪ হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছরে মৃত্তিকা সম্পদ শতকরা ১৮ ভাগ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উপরোক্ত সংস্থাগুলোর জরিপে ভূমিক্ষয়ের জন্য পাহাড়ের জুম চাষকেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কালাম জানান, জুম চাষ পরিবেশগতভাবে ক্ষতি হলেও সুফলও আছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর পাহাড়ে জুম চাষের প্রস্তুতি চলছে। জুমে ধানের পাশাপাশি মারফা, মরিচ, ভূট্টা, সরিষা, যব, তিল ও তুলাসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থকরী ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশ সম্মতভাবে জুম চাষ করলে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না। তবে বর্তমান পদ্ধতিতে জুম চাষ অব্যাহত থাকলে আগামী একদশকে সবুজ বনাঞ্চল সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যাবে।

পাহাড়ি লেখক ও গবেষক সিংইয়ং ম্রো জানান, জুম চাষ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি সম্প্রদায়রা জুম চাষ করে আসলেও ইদানিং মিশ্র ফল চাষের দিকে ঝুঁকছে। তবে সর্বক্ষেত্রে অবহেলার শিকার ম্রো জনগোষ্ঠীরা এখনো পুরোপুরি জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে জুমচাষের প্রবনতা অনেকাংশে কমে গেছে। জুম চাষের মাধ্যমে জুমিয়া পরিবারগুলো সারাবছরের খাদ্য সংগ্রহ করলেও এটি পার্বত্য চট্রগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য-সংস্কৃতির একটিও অংশ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন