জুমের আগুনে পুড়ছে বনাঞ্চল : খাগড়াছড়ির বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা বৃক্ষশূন্য

খাগড়াছড়ি জেলা সংবাদদাতা : পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও পাহাড় ধ্বংসের অন্যতম কারণ হওয়া সত্ত্বেও পাহাড়ে সনাতন পদ্ধতিতে অবাধে চলছে জুম চাষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য পাহাড়ে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একশ্রেণীর উপজাতিয়রা জুম চাষের নামে পাহাড়ে আগুন জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে মূল্যবান গাছপালা। জুম চাষে ভালো ফসল ফলাতে হলে পাহাড়ে আগুন জ্বালাতেই হবে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই পাহাড়িরা প্রতিবছরের মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ৩ মাস প্রকৃতি শুষ্ক থাকায় আগুন এক জায়গায় জ্বালানোর সাথে সাথে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন নেভানোর কোন ব্যাবস্থাও নেই। আর কেউ তা নেভাতেও চায় না । এতে করে পুড়ে ছাই হয়ে যায় পাহাড়ের পর পাহাড়, যার ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস ও উপকারী কীটপতঙ্গ কমে যাচ্ছে। পাহাড় ধস ও নদীসমূহের গভীরতা কমে আসছে। এছাড়াও বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। জুম চাষের জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় আগুনে পুড়ে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫টি থানায় প্রতিবছর চৈত্র মাস হতে বৈশাখ মাস পর্যন্ত জুম চাষের লক্ষ্য নির্ধারিত। নির্ধারিত মাসের পূর্বেই প্রতিযোগিতামূলকভাবে পাহাড় নির্ধারণ করা হয়। এরপর উপজাতি জুমিয়ারা বাঁশ, গাছ, ছন ও লতা-গুল্ম ভরপুর পাহাড়গুলোতে নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। অরণ্যে ঘেরা সবুজ পাহাড়ে অগ্নিসংযোগের ফলে পাহাড়ের উপরিভাগের কয়েক ইঞ্চি মাটি আধা পোড়া হয়ে যায়। আর এ পোড়া মাটির উর্বরতা দিয়ে জুম চাষের ফসলাদির ভালো ফলন হয় বলে ধারণা চাষীদের। এ কারণে অসচেতন জুমিয়াদের লাভের আশায় প্রতিবছরই নষ্ট হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ। একই স্থানে একবার জুম চাষ করলে সেখানে ৩-৪ বছরের মধ্যে আর কোন শস্য উৎপাদন হয় না। তাই পাহাড়ের ১০টি উপজাতি গোষ্ঠী প্রতিবছর নতুন নতুন পাহাড়ে জুম চাষের জন্য শত শত বছরের পুরোনো ও মূল্যবান সেগুন, গর্জন, গামারী, চাপালিশ, বড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় গাছ পুড়িয়ে ধ্বংস করে থাকে। জুম চাষ সরকারিভাবে নিষেধ থাকলেও উপজাতিয়রা জুম চাষের ক্ষেত্রে কোনপ্রকার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, সরকার জুম চাষের পরিবর্তে স্থায়ী ও বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেনি।
উপজাতিয়রা ঐতিহ্যগতভাবে জুম চাষ করে আসলেও বর্তমানে পাহাড়ে উপজাতিয়দের পাশাপাশি বাঙালিরাও বিভিন্ন চাষাবাদ করছে। যেমনÑ কচু, আদা, হলুদ প্রভৃতি। এসব চাষের জন্য প্রথমে পাহাড়ের মূল্যবান গাছপালা কেটে ফেলা হয়, পরে প্রচ- রোদে শুকিয়ে গেলে আগুনে পোড়ায়। এরপর পাহাড়ের মাটিগুলোকে কুপিয়ে চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি করা হয়। এসময় গাছপালার শেকড় পর্যন্ত তুলে ফেলতে হয়। বৃক্ষ শূন্য পাহাড়ে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই জুম চাষের জন্য পাহাড় প্রস্তুত করে শুরু হয় জীবন ও জীবিকা নির্বাহের চাষাবাদ। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড়ে এভাবে চাষাবাদের ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি, এতে পাহাড় ক্ষয় ও ভূমির উর্বরতা শক্তি হ্রাসসহ গিরি ঝর্ণা নষ্ট হয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, পাহাড়ে বন ধ্বংসের কারণে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে পাহাড় ভেঙে পড়ায় গিরি ঝর্ণা হুমকির সম্মুখীন এবং জলবায়ু পরির্বতনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বর্তমানে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বাড়িঘর ও ইটের ভাটা নির্মাণ, ক্ষতিকারক তামাক চাষ করা হচ্ছে। জুম চাষ করার নামে লক্ষ লক্ষ টন কচি কচি মূল্যবান গাছগাছালি কেটে জ্বালানি কাঠ হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে ইটভাটায়। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার সবুজে শ্যামল উঁচু নিচু পাহাড়ের আগের সৌন্দর্য আর নেই। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে হলে কৃত্রিমভাবে বনায়ন করতে হবে এমনটাই দাবি পরিবেশ প্রেমীদের। থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, চীনের মতো যদি বৈজ্ঞানিক পন্থায় জুম চাষ করা হয় তবে ভূমির ক্ষয় রোধ, বনজ সম্পদ ধ্বংসের পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসতো। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ায় জুমিয়ারা এখনও চাষাবাদ করছে সনাতন পদ্ধতিতে। আর সরকার তাদের বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষাবাদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঢালছে। কাজের কাজ কিছু না হলেও কর্মকর্তাদের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য পাহাড়ের এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিতে আসা কর্মকর্তাদের অনেকেই বদলী নিতেও নারাজ। কারণ, পার্বত্য এলাকা বিধায় এখানে কাজের অডিট, কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বড়ই অভাব। নিরাপত্তা, সন্ত্রাস, গেরিলা, পাহাড়ি নানা অজুহাতে পার পেয়ে যাচ্ছে কৃষি গবেষণার কর্মকর্তারা। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবছর ৫০ হাজার একর জমিতে জুম চাষ করা হয়। এ কারণে ঐ সকল এলাকা থেকে বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণে হেক্টরপ্রতি ১০০ হতে ২৫০ মেট্রিক টন পর্যন্ত মাটি ক্ষয় হয়ে থাকে। ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি বৃষ্টির পানিতে মিশে পাহাড়ি ঝরণা ও ছড়া গড়িয়ে তার বিস্তৃতি ঘটছে পার্বত্য নদ-নদী ও বৃহত্তর কাপ্তাই লেক পর্যন্ত। ফলে চেঙ্গী, মাইনী, ফেনী, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, কর্ণফুলী নদীসহ কাপ্তাই লেক, বগা লেক ভরে গিয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। এ কারণে একদিকে যেমন বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড় ধসে গত এক যুগে দুই শতাধিকেরও বেশি লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি বিভাগের মতে, প্রতিবছরের মতো এবারও পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষীরা অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে জুমিয়ারা। ফায়ার লাইন ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে অগ্নিসংযোগের কারণে এক পাহাড়ের আগুন অন্য পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিক কালো ধোঁয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ে। সর্বত্র গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এরূপ আবহাওয়া জনজীবনে প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ের প্রজ্বলিত দাবানলে গাছপালা ধংসের ফলে বন্যপ্রাণীও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। হারিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য বন্যপ্রাণী। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংখ্য পাহাড় ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। জীবন ও জীবিকার জন্য জুম চাষ অপরিহার্য। এ জন্য অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ না করে পরিকল্পিতভাবে ফায়ার লাইন দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মরুকরণের হাত হতে রক্ষা পাবে। অন্যথায় প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামই নয়, পুরো দেশবাসীকে খেসারত দিতে হবে। আর তাই এখনই প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ।

 সৌজন্যে: দৈনিক ইনকিলাব ২৩-০৪-২০১৩

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন