জুমের পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত বান্দরবানের জুমিয়ারা

জুম চাষ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জুমের পাকা ধানের গন্ধ মৌ মৌ করছে সবখানে। বান্দরবানের পাহাড়ে চলছে জুমের ধান কাঁটার উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ে জুম ক্ষেতে এখন পাকা ধান তোলার ভর মৌসুম। জুমিয়ারা ঘরে তুলছে সেই কাঙ্ক্ষিত সোনালী ধান। জুমে বাম্পার ফলনে পাহাড়ে ধান কাটার আনন্দে মেতেছে ম্রো, বম, মারামা, চাকমা সম্প্রদায়সহ উপজাতি নারী-পুরুষেরা। ঘরে বসে নেই শিশু কিশোর, বাবা-মা কেউই।

 

পরিবার-পরিজন নিয়ে জুমিয়া পরিবারেরা ধান কাটতে নেমেছে পাহাড়ে পাহাড়ে। জুমের সোনালী ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি আদিবাসী পল্লীগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি।

গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় প্রায় ৬০৩ হেক্টর পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ। গতবছর বান্দরবান জেলায় ৮ হাজার ৪৩৯ হেক্টর জমিতে পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ হয়। চলতি ৯০৫০বছর জুম চাষ হয়েছে।

কৃষি বিভাগ ও জুম চাষীদের সূত্রে জানাগেছে, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা প্রতিবছর জেলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাহাড়ে জুম চাষ করে। একই পাহাড়ে একাধিকবার জুম চাষ করা যায় না বলে জুমিয়ারা প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে জুমের চাষ করে থকে। জেলায় বসবাসরত মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, লুসাই, পাংখো, বম, চাকসহ ১১টি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশরাই জুম চাষের উপর জীবণ জিবিকা নির্বাহ করে থাকে।

জুম চাষ

জেলা শহরে বসবারত কিছু সংখ্যক শিক্ষিত পরিবার ছাড়া দূর্গমাঞ্চলে পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিরাও আজও জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে ১১টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রো সম্প্রদায় আদিকাল থেকেই জুম চাষের মাধ্যমেই সারাবছরের খাদ্য শস্য সংগ্রহ করে রাখে।

জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতিবছর বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়। মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড় পরিষ্কার করে জুম চাষ শুরু করে। প্রায় ৩/৪ মাস পরিচর্যার পর বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষেরে দিকে জুমের ধান কাটা শুরু করে।

চলতি মৌসুমেও বান্দরবান জেলায় প্রায় ৬ হাজার ৫০ হেক্টর পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। তারমধ্যে সদর উপজেলায় ৫৮০ হেক্টর, রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৩২৬ হেক্টর, রুমা উপজেলায় ১ হাজার ৮৭৫ হেক্টর, থানছি উপজেলায় ২ হাজার ৮৪৭ হেক্টর, লামা উপজেলায় ১ হাজার ৩১৭ হেক্টর, আলীকদম উপজেলায় ৯১৫ হেক্টর এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৭১৫ হেক্টর পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়েছে।

মংহ্লা মং, উথাইচায়, রেংনিং ম্রোসহ একাদিক জুম চাষী জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং আবাহাওয়া জুম চাষের অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে জুমের ফলন ভাল হয়েছে। জেলার রুমা, থানছি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবান সদর উপজেলার ডলুপাড়া, মেঘলা, শৈলপ্রপাত, ফারুক পাড়া, কানাপাড়া, শ্যারণ পাড়া, ওয়াইজংশন, পোড়া পাড়া, হাতিভাঙ্গা পাড়া, গেৎমনি পাড়া, কানাপাড়া, ডলুপাড়া, সাতকমল ইত্যাদি এলাকায় জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে।

বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের দুপাশের পাহাড়ের পাকা ধানের গন্ধে মৌ মৌ করছে। স্ত্রী পরিবার-পরিজন নিয়ে জুমিয়া পরিবার গুলো নেমে পড়েছে জুমের ধান কাটতে। বাবা-মায়ের সাথে ধান কাটছে পাহাড়ী শিশুরাও। জুম চাষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ক্ষতি করলেও উপজাতি জনগোষ্ঠীর কাছে এটি ঐতিহ্য। জুমিয়ারা পাহাড়ে ধানের পাশাপাশি ভূট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, টকপাতাসহ বিভিন্ন রকম অর্থকারী ফসল ও সবজির চাষ করে।

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, এবারে হেক্টর প্রতি ৩৫-৪০ মন ধান উৎপন্ন হয়েছে। তবে গুন্ডা জাতের ধান হেক্টর প্রতি প্রায় ৮০ মন পর্যন্ত উৎপন্ন হয়েছে। জুমিয়ারা লাল চিকন, পিড়ি, কক্স, বিন্নী, গেলন, ময়মনসিং, সূর্য্যমূখি ও গুন্ডা জাতের ধান চাষ করে থকে।
তিনি আরো জানান, আদিপদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে পাহাড়ের ক্ষয়সৃষ্টি হচ্ছে এবং জমির উর্ব্বরা হ্রাস পাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে জুমিয়ারাও লাভবান হবে।

এদিকে জুমের ধান কাটার সময়টা পাহাড়ীরা নবান্ন উৎসব হিসেবেও পালন করে। পাহাড়ে জুমের ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি আদিবাসী পল্লীগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন