টেকনাফে ইয়াবা রোধে প্রশাসনের অভিযানে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারকারীরা আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছে
মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ:
মায়ানমার থেকে প্রতিদিন কেবল বাংলাদেশেই প্রায় ৩০ লাখ পিস ইয়াবা পাচার হয়। আর এ জন্য মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে মায়ানমারের আটটি সংগঠন গড়ে তুলেছে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা। মুখোশধারী চোরাচালানিদের হাত দিয়ে এসব মাদক পৌঁছে যাচ্ছে দেশের অলিতে গলিতে। যার ফলে ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ। বাড়ছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। ইয়াবা সংক্রান্ত ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের জের ধরে ও ঐশী কর্তৃক মা-বাবা হত্যার পর থেকে প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিশেষ টিমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ দল। অভিযানের অংশ হিসেবে গত শনিবার থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৬৫ জনের একটি বিশেষ দল টেকনাফ অবস্থান নিয়েছেন। তারা ৫টি দলে ভাগ হয়ে এ অভিযান পরিচালনা করছেন।
একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অভিযানের তালিকায় থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এ ৫দিনে অন্তত ১৩ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি তল্লাশি ছাড়াও বিভিন্ন স্পটে চলছে অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযান এক হাজারের বেশি ইয়াবাসহ ৭ জনকে আটক করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাওয়া গেছে ইয়াবা তৈরির উপকরণ এমফিথামিড পাউডার। অভিযানে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে- এরপর ইয়াবা পাচার রোধে মাঠ পর্যায়ের পরামর্শ করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল কক্সবাজার আসেন গত বুধবার। সোমবার ইয়াবা রোধে টেকনাফে অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজার জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির বিশেষ সভা। এর মধ্যে টেকনাফে শুরু হয়েছে বিশেষ অভিযান। আর এ অভিযানকে সংবাদে অ্যাকশন বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন। টেকনাফ থেকে বিভিন্ন লোকজন এর জন্য অভিনন্দন জানিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি তুলেছেন। তারা জানিয়েছেন, অভিযান দল ইতোমধ্যে ইয়াবার তালিকায় থাকা লোকজনের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়েছে অনেক গডফাদার টেকনাফ ছেড়ে কক্সবাজার- চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চলে গেছেন। এতে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করতে শুরু হয়েছে। টেকনাফের অলিতে গলিতে ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তার টানা একযুগ সময় ধরে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নানা অজানা তথ্য। ‘হালাল টাকা দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করি। এটা আবার অবৈধ হয় কেমনে? আমরা হারাম খাই না, নিজের টাকা খাটাইয়া হান্ডেড পার্সেন্ট হালাল রুজি করি’। এই বক্তব্য টেকনাফের একজন উলে¬খযোগ্য ইয়াবা ব্যবসায়ীর। কেবল এই ব্যক্তিই নন। টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারের অধিকাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী ইয়াবা আমদানি, পাচার ও এর ব্যবসাকে অবৈধ ব্যবসা হিসেবে দেখেন না। এবং প্রায় সবারই এ বিষয়ে বক্তব্য এক ও অভিন্ন। একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাপের জমি বেচা টাকা দিয়ে এ ব্যবসা করি। শতভাগ হালাল টাকার ব্যবসা। বর্মাইয়া দালালরা মংডু থেকে নিয়ে আসে। আর টেকনাফে আমরা তাদের থেকে টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়ে ব্যবসা করি। এটা আমার কাছে অবৈধ মনে হয় না। এই দানার ব্যবসা কইরা আমরা বেকারত্ব দূর করছি। বাড়িতে ভালো ঘর করছি। দামি বাইক কিনছি। ভাইরে বিদেশে পাঠাইছি’। ওই ব্যবসায়ী বলেন, মায়ানমার থেকে এসব ইয়াবা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকানো হয়। তবে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। টেকনাফে পৌঁছানোর পর টেকনাফ থেকে কক্সবাজার হয়ে সারা দেশে বিশেষ কৌশলে ছড়িয়ে পড়ছে এই ইয়াবা। তার মতে, সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে এই ইয়াবার ক্রয়-বিক্রয়, গ্রাহক ও চাহিদা। অতি অল্প সময়ে অনেক টাকার মালিক হওয়া যায়। আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারিতে পড়লেও সমঝোতার মাধ্যমে সহজে ছাড়া পাওয়া যায়।
কিভাবে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন সায়েন্সের যুগ। একবার হ্যালো করলেই তো হয়ে যায়। মোবাইল ফোনে সহজে কথা বলে আন্ডার গ্রাউন্ডের ব্যবসায়ীদের রকমভেদে দাম নির্ধারণ করা হয়। দাম-দর ঠিক হলে পাচারকারীর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু করি। ইয়াবা কখন পৌঁছাবে, এখন কোন জায়গায়, কোন সমস্যা হয়েছে কি না ইত্যাদির বিষয়ে মোবাইলে কথা বলে নিই। তবে এক নাম্বার আমরা বেশি দিন রাখি না। বার বার ফোন নাম্বার চেঞ্জ করি। অনেক সময় মোবাইলে রুপক অর্থ ব্যবহার করেন বলে জানান এই ইয়াবা ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, কথা বলার সময় যদি অপরিচিত মানুষের সামনে পড়ে যাই তখন ইয়াবাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করি। অনেক সময় বিভিন্ন সংকেতও ব্যবহার করি। যেমন ইয়াবার দাম ও আকার নির্ধারণ করতে বলি বড় ভাই কতো, ছোট ভাই কতো বলে।
তিনি বলেন, টেকনাফে ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেককেই পুলিশ, বিজিবি. কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে টাকা দিতে হয়। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের এজেন্টরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। এরপরও আমাদেরকে অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী বলা হয় বলে তিনি আক্ষেপ করেন। অন্য এক ব্যবসায়ী বলেন, ইয়াবা ব্যবসা অবৈধ হলে এতো ইয়াবা আসে কেন? তাছাড়া যেসব ইয়াবা ধরা পড়ে সেগুলোইবা কি ভাবে আবার ব্যবসায়ীরা পান? স্কুল শিক্ষক আব্দুল মোতালেব বলেন, এই ব্যবসা একটি ঘৃণিত ব্যবসা হলেও এখানকার ব্যবসায়ীদের কেউ এটাকে খারাপ ব্যবসা হিসেবেই দেখতে চান না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রশাসনের দুর্নীতি ও জেগে জেগে ঘুমানোর কারণে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এটা খারাপ ব্যবসা হলে প্রশাসন টাকার বিনিময়ে ছাড় দিতো না।তাই অনেকে এই হারাম ব্যবসা কে হালাল করার জন্য আয়কর সার্টফিকেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বানিজ্যের কাগজপত্র তৈরী করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।