৪৩ বছরেও পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে ওঠেনি টেকনাফ সেন্টমার্টিন

teknaf sanmatiom

টেকনাফ প্রতিনিধি:

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনায় ভরপুর সাগর-নদী-পাহাড় ঘেরা সীমান্ত শহর টেকনাফ এবং দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন স্বাধীনতার পর ৪৩ বছরেও আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে ওঠেনি। অথচ পরিকল্পিত উপায়ে আধুনিক পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে তোলা হলে তা শুধু দেশে নয়, গোটা দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি পেতে পারতো।

 

 

কারণ সাগর-নদী-পাহাড়-সমুদ্র সৈকত- প্রবালদ্বীপ ও অপার সম্ভাবনা আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সব কিছুর সমন্বয়ে এমন পর্যটন অঞ্চল বিশ্বে কমই আছে। তবে দেরিতে হলেও সরকার পরিকল্পিত পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।

জানা গেছে,প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যান কিছুটা কাটছাঁট করে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এদিকে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শুরুর পর থেকেই দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা কক্সবাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিগ্রহণ করেছিলেন। যতদিন পর্যন্ত মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদিত হবে না, ততদিন তারা ঝুঁকি নিতে চাননি। মাস্টারপ্ল্যানে কোথায় কী হবে, কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না- এমন সব বাধ্যবাধকতার কারণেই মূলত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এসব বিনিয়োগকারীরা রাজধানীর ‘ড্যাব’-এর মতো জটিলতায় পড়তে চাননি। কিন্তু এখন মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে স্থানীয় প্রশাসন এবং দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার ও দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটন শিল্পের প্রসার শুরু হয় মূলত কয়েক যুগ আগে থেকেই। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে দেখা দেয় আবাসন, বিনোদনসহ নানা সংকট। আর এই সুযোগে পর্যটকদের সুবিধা দিতে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে শত শত বহুতল ভবন।

গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে কক্সবাজারের সাগরকে হোটেল-মোটেল জোন ঘোষণা করে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক অট্টালিকা। হোটেল-মোটেল জোনের পূর্ব পাশে এখন শতাধিক গেস্ট হাউস বাণিজ্যিকভাবে হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর পরিধি বেড়ে কক্সবাজার শহর ছেড়ে বিস্তীর্ণ সৈকত হয়ে ঠেকেছে দেশের শেষ সীমানা সেন্টমার্টিন পর্যন্ত। পর্যটন শিল্পের অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে শত শত অট্টালিকা।

রাজধানী ঢাকায় যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঁচ তারকামানের হোটেল নেই, সেখানে কক্সবাজারেই গড়ে উঠেছে প্রায় এক ডজন পাঁচ তারকামানের হোটেল। নির্মিত হচ্ছে আরো বেশ কয়েকটি। এছাড়া স্টুডিও টাইপ তিন তারকা ও পাঁচ তারকামানের অ্যাপার্টমেন্টও রয়েছে অর্ধশতাধিক। এসব নির্মাণে কক্সবাজারে বর্তমানে অর্ধশতাধিক ডেভেলপার কোম্পানি কাজ করছে বলে জানা গেছে। এসব প্রকল্পে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ফলে কক্সবাজার একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে।

কিন্তু সরকারিভাবে কোন ধরনের মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পুরো কক্সবাজারই অপরিকল্পিত নগরায়নে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে কক্সবাজারবাসী ও বিনিয়োগকারীদের দাবী ছিল পুরো কক্সবাজারকে একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় আনা। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের পক্ষে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংস্থা শেলটেক কনসালট্যান্ট যৌথভাবে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর কাজ করার পর ২০১১ সালের ১১ মে নগর উন্নয়ন অধিদফতর মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া প্রকাশ করে। ‘প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান অব কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি-বিচ আপ টু টেকনাফ’ নামক প্রকল্পের আওতায় এই খসড়া পরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) তৈরী করা হয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী পৌরসভা ও আদিনাথ মন্দির এলাকা থেকে শুরু করে কক্সবাজার পৌরসভা, কক্সবাজার সদর উপজেলার একাংশ, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে টেকনাফ সৈকত পর্যন্ত এলাকা, রামু ও উখিয়া উপজেলার একাংশ, টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং ইউনিয়নের একাংশ এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ প্রায় ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভা ও সদর উপজেলার একাংশে হোটেল-মোটেল জোন, খেলার মাঠ, সরকারি অফিস-আদালত, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, পিকনিক স্পট, এডুকেশন জোন, বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক জোন, সিটি পার্ক, ন্যাচারাল পার্ক, প্রাকৃতিক বনসহ ইকোট্যুরিজম, রেল স্টেশন, চাইন্দায় শিল্প এলাকা, ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিং জোন, খুরুশকুলে প্রাকৃতিক বন, পার্ক, মৎস্য জোন, ন্যাশনাল পার্ক, মহেশখালীতে পার্ক, ইকোট্যুরিজম, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, টেকনাফে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, সেন্টমার্টিনে ইকোট্যুরিজম সহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া প্রকাশের দীর্ঘ দুই বছর পর সম্প্রতি তা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার।

দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের সাগরের তলদেশে রয়েছে মনোমুগ্ধকর বিচিত্র্য প্রাণী ও হরেক রকম জীব। রয়েছে নানান আকারের পাথরের স্তুপ, দুর্লভ প্রবাল, পাথরের ফুল। সাগরের জলরাশি ও সৌন্দর্যে ভরা বিচিত্র জীব-প্রাণী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের। সাগরের তলদেশে এসব বিচিত্র জীব অবাক হওয়ার মত, দেখলে মনে হবে সাগরের তলদেশে রয়েছে  শ্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যময় এক জগত।

গবেষকদের মতে- সেন্টমার্টিনের উপরের অংশে যে সৌন্দর্য্য রয়েছে তার বহুগুণ মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য পড়ে রয়েছে সাগর তলদেশে। উপরে সাগরের সুনীল জলরাশি আর নারিকেল গাছের ছায়ায় ঢাকা বিস্তীর্ণ সাদা বালুকাবেলার চেয়েও সুন্দর এক জগত পড়ে আছে পানির নিচে। এখানে রয়েছে কোরালের পাশাপাশি ছোট ছোট জীব, যা সাগরের তলদেশে তৈরি করে বিচিত্র ধরনের বাসা। কোমর পানির নিচে ডুব দিলে দেখা মেলে বিচিত্র কোরাল ও নানা ধরনের মাছ ও শৈবালের। এছাড়া সাগরের গভীরে রয়েছে বিশাল বিশাল বিচিত্র পাথর ও প্রবালের স্তুপ।

সেন্টমার্টিনের ছেড়াদ্বিয়া (স্থানীয় ভাষায়-চিরাদিয়া) ভ্রমণ করে এসব সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন যে কোন পর্যটক। দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রতি বছর ভ্রমনে আসেন দেশী-বিদেশী কয়েক লাখ পর্যটক। কিন্তু পর্যটকরা নানান কারণে দ্বীপের এই সৌন্দর্য না দেখে ফিরে যান। সেন্টমার্টিনের এসব সাগর রতœ না দেখে ফিরে যাওয়াকে দুর্ভাগ্য বলেই অনেকে মনে করেন।এসব সাগর রতœ দেখতে হলে অবশ্যই সেন্টমার্টিনে থাকতে হবে। এখানে পর্যটকদের থাকার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে অনেক।

বর্তমানে মানসম্মত হোটেল-মোটেল আর কটেজের সংখ্যাও বাড়ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেল এবং কটেজ হচ্ছে- প্রিন্স হেভেন, আল বাহার, প্রাসাদ প্যারাডাইজ, কক্স বাংলা, রোজ মেরি, ব্লু মেরিন রিসোর্ট, ডলফিন, সি আইল্যান্ড, সি ব্লু, ব্লু সি,  ব্লু মুন, সীমানা পেরিয়ে, অবকাশ, ড্রীম নাইট, সিটিবি, ডায়মন্ড, আইল্যান্ড প্রাসাদ, প্রিন্স আলবাহার, ঊশান ভিউ, সমুদ্র বিলাস, স্বপ্নপুরী, স্বপ্ন বিলাশ, সাগর বিলাস, জলপরী, নীল দিগন্ত, নাবিবা বিলাস, পান্না রিসোর্ট, কোরাল ভিউ, সেন্ট রিসোর্ট, রেহানা কর্টেজ, ময়নামতি, দেওয়ান কটেজ, গ্রিনল্যান্ড, মুজিব কটেজ, শাহজালাল কটেজ, রেজা কটেজ, রিয়াদ রেস্ট হাউস, বে অব বেঙ্গল ইত্যাদি। পর্যটকদের সেবা দিতে টেকনাফ পৌর শহরেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল- দ্বীপপ্লাজা, স্কাইভিউ, নাফ, নিরিবিলি, সম্রাট, রাজমহল, আল-আব্বাছ, নাফ কুইন, নাফ সীমান্ত, আল-করম, গ্রীন গার্ডেন, মিল্কি রিসোর্ট, বড়হাজী হোটেল, প্লেজার-ইন্, হিলটপ ইত্যাদি।

তাছাড়া রয়েছে পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল নেটং, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, বনবিভাগ ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের রেস্টহাউস সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা তাহেরা বেগম জানান, দ্বীপের মানুষ পর্যটকদের বরণ করতে সদাপ্রস্তুত।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুরুল আমিন জানান, দ্বীপের মানুষ সবসময় পর্যটকবান্ধব। পর্যটন মৌসুমে যাতে দেশী-বিদেশী পর্যটক শিক্ষার্থীরা নিরাপদে দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারেন সেজন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবপ্রস্তুতি নেয়া হয়। পর্যটক আগমনকে ঘিরে অপরূপ সাজে সাজানো হয় সমুদ্র সৈকত, জেটি ও দ্বীপের বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্পটগুলো। তিনি আরো বলেন, “অপূর্ব সুন্দর স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপ, স্বচ্ছ নীল পানিতে ঘেরা এই দ্বীপের মানুষও অসম্ভব ভালো। চুরি ডাকাতির রেকর্ড নেই। সারারাত ঘুরতে পারা যায় নির্ভয়ে-নির্জনে। বিশেষত চাঁদনী রাতে দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য কেবল উপভোগ, অবলোকন ও হৃদয়াঙ্গম করা যায় যা লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, টেকনাফ সেন্টমার্টিন, পর্যটন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন