তাইন্দংয়ে পাহাড়ী-বাঙালিদের দিন কাটছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়

pahar 1

বেলায়েত হোসেন, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে:

(এক)
চুক্তির ১৫ বছরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির পাহাড়ে। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ের পাঁচ গ্রামের ৩৮ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুরসহ ব্যাপক সহিংসতার পর থেকে পাহাড়ী বাঙালিদের দিন কাটছে সীমাহীন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক কামাল হোসেনের কথিত অপহরণের সূত্রে দুর্বৃত্তরা গত ৩ আগস্ট মাটিরাঙার তাইন্দংয়ে হেডম্যানপাড়া, বগাপাড়া, পোমাংপাড়া, তানাক্কাপাড়া ও ৩নং কলিন্দ্র কারবারিপাড়ায় বসবাসরত  উপজাতীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩৮টি ঘরে  অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাটসহ ব্যাপক তা-ব চালায় দুর্বৃত্তরা। এসময় বাঙালিদের তিনটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে আতঙ্কিত কয়েকশো পাহাড়ি পরিবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড  এবং গহিন জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে সংঘটিত নারকীয় এই সহিংস ঘটনার পর থেকে পাহাড়ী বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পাহাড়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঝুঁকিতে উদ্বিগ্ন উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, তারা চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাইন্দংয়ের পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের ভেতর সম্প্রীতি বজায় রাখতে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে নেপথ্য কুশিলবদের শাস্তি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

দুর্বৃত্ত সেটেলাররা একের পর এক ৩৮টি পাহাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে ছাই করেছে, ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে। হামলাকারী দুর্বৃত্তরা পাহাড়িদের ধর্মীয় স্থান প্রার্থনা ঘর ‘খিয়াং’-এ বৌদ্ধ মূর্তিতে আঘাত করে তার হাত ভেঙে দিয়েছে। পাহাড়ি ঘরে আগুন দেয়াকে ব্যালেন্স করতে দুর্বৃত্ত বাঙালি সেটেলাররা নিজেদের ৩টা পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন দিয়েছে বলে দাবি করেছেন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নেতারা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক  কথিত অপহরণের গুজব ছড়িয়ে তাইন্দং বান্দরশিং পাড়া ক্রসিং পয়েন্ট থেকে উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে। এর আগে ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত পাহাড়ী সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার গুজব ছড়িয়ে কে বা কারা এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এতে পাহাড়ী অধিবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে বিজিবিসহ প্রশাসনের শরণাপন্ন হন। আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তাদের নিরাপত্তা  দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বগাপাড়া, সর্বেশ্বরপাড়া এবং বান্দর শিংপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা জানান, কে বা কারা ঘটনার আগে স্থানীয় মসজিদের মাইক ব্যবহার করে কামাল হোসেনের অপহরণ এবং বাঙালিদের ওপর পাহাড়ী আদিবাসীদের হামলার আশংকার গুজব ছড়িয়ে আতংকাবস্থা সৃষ্টি করে। তবে ঘোষণাকারী  বা বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা, অগ্নি সংযোগ এবং লুটে জড়িতদের তারা চিনতে পারেননি।

দুর্বত্তের আগুনে সর্বস্ব হারা তাইন্দংয়ের ষাটোর্ধ্ব আতশী মার্মা আক্ষেপ করে বলেন, পাহাড়ী বাঙালি সম্প্রদায় বেশ কয়েক পুরুষ ধরে শান্তিতে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তের দুরভিসন্ধিতে শান্তিপূর্ণ এ অঞ্চলে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তিনি জানান, গত ৩১ জুলাই রাত ১১টায় ‘সন্ত্রাসী আসছে, সন্ত্রাসী আসছে’ বলে আনুমানিক ২৭টি মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়। বলা হয়, ‘বাঙালি ভাইয়েরা যা কিছু আছে তাই নিয়ে চাকমাদের উপর হামলা কর’। এরপর কয়েকশ অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা রাত ১টায় তাইন্দং বাজারে ‘চাকমার ঘরে আগুন জ্বালো’ বলে স্লোগান দেয়। ফলে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের নিরাপত্তায় প্রায় ২৫০টি পরিবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেয়। ১ আগস্ট ১২৭টি পরিবার ফিরে এলেও ১৩০টি পরিবার সীমান্তে থেকে যায়। তাইন্দং ইউনিয়নে বর্তমানে বাঙালিদের বসতি জনসংখ্যা ১৫ হাজার ও পাহাড়িদের ৩ হাজার।

এই ঘটনা তদন্তে সাংবাদিক-আইনজীবী-মানবাধিকার কর্মী-পেশাজীবী-রাজনীতিক সমন্বয়ে নয় সদস্যের একটি একটি প্রতিনিধি দল ১৬ ও ১৭ আগস্ট খাগড়াছড়ির এ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি জনগণ, স্থানীয় বিজিবি’র অপারেশনাল অফিসার, বাঙালি সেটেলার, মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং খাগড়াছড়ি জেলা নাগরিকবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন। তাইন্দংয়ের ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিনিধি দলকে জানান, বিজিবি, প্রশাসন এবং স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল বলে তারা মন্তব্য করেন। এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান সামছুল হক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মাহে আলম এবং ইউ,পি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম এ জন্য ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) কে দায়ী করলেও ঘটনার একদিন পর থেকে তাদের মুখে বেজছে ভিন্ন সুর। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে অপরাধ থেকে নিজেদের আড়াল করার দুরভিসন্ধির অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এই নেতাদের বিরুদ্ধে। আওয়ামীলীগের স্থানীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভাড়ায় চালিত  মোটর সাইকেল চালক কামাল হোসেনের কথিত অপহরণ এবং বাঙালী প্রভাবিত এ গ্রামগুলোতে পাহাড়ীদের হামলার আশঙ্কার গুজব ছড়িয়ে অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতাকে উসকে দিয়ে লাভবান হয়েছে মহল বিশেষ। তিনি বলেন, একঢিলে দুইপাখি মেরেছেন স্থানীয় ইউ. পি চেয়ারম্যান। তার প্রভাবে এ মামলায় ৩১ জনের নামোল্লেখসহ আসামী করা হয়েছে প্রায় দু’শ জনকে। এর মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মী ১৭ জন এবং আওয়ামীলীগের ১৪ জন। সাবেক ইউ,পি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম এবং নিজ দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিতদের এ মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান আগামী নির্বাচনে পথের কাটা অপসারণ করেছেন। তাছাড়া পাহাড়ীদের জমির ওপর তার লোলুপ দৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। তারই ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তার আলীর বিরুদ্ধে  জমি দখলের অভিযোগ তুলেছে পাহাড়িরা। মুক্তার আলী স্বীকার করে ছেন যে, একজন পাহাড়ির ৫ একর জমি তিনি ৭ হাজার টাকায় কিনেছেন।

স্থানীয় পাহাড়ীরা জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মাটিরাঙা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মাহে আলমের উপস্থিতিতে মাটিরাঙা উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি সামছুল হক এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করে বলেন, তাদের উস্কানিমূলক তৎপরতার কারণে এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। একই অভিযোগ করেন তাইন্দং ইউ. পি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম। এর কিছুক্ষণ পরেই কথিত অপহৃত কামাল উদ্দিন জনসমক্ষে আসে। ঘটনার একদিন পরেই তাজুল ইসলাম সুর পাল্টে এ ঘটনাকে সরকার বিরোধীদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেছেন।

ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় নেতা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা জানান, ইউপি চেয়ার ম্যানের বক্তব্য উদ্দেশ্যমুলক । পাহাড়ী বাঙালী দাঙ্গা বাধিয়ে উর্বর জমি হাতিয়ে নেয়ার দুরভিসন্ধিকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ী বাঙালী তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। তিনি জানান, চেয়ারম্যানের অনুসারী স্থানীয় আওয়ামীল নেতা মুক্তার  হোসেনের বিরুদ্ধে পাহাড়ীদের জমি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জনৈক পাহাড়ীর চার একর জমি ৪০ হাজার টাকায় কিনেছেন মুক্তার। তিনি  ৭ হাজার টাকা পরিশোধের কথা স্বীকার করেছেন। এব্যাপারে চেয়ারম্যান বলেন, তার বিরুদ্ধে মহলবিশেষ অপপ্রচার করছে।

উল্লিখিত ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া। তিনি বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধনের অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া সামনে রেখে এ ধরনের সহিংসার নেপথ্যে সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের ষড়যন্ত্র অমুলক নয়। তিনি বলেন, আলোচ্য ভূমি আইনের ১৩ টি ধারার যে কোন একটি বাস্তবায়িত হলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে।

বিডিআরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে, ঘটনার আগেই পার্শ¦বর্তী একটি দেশের সীমান্তে আগেভাগেই নবাগত শরণার্থীদের জন্য তাবু এবং প্রয়োজনীয় খাবার সংরক্ষিত ছিল। তিনি বলেন, হামলার ঘটনা দুঃখজনক। কিন্তু দলবেঁধে পাশের দেশের সীমান্তে যেভাবে জড়ো করা হয়েছিল তাতে বোঝা যায় এর পেছনে অন্য খেলা ছিল।

পুলিশ সুপার শেখ মো: মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। জেলা প্রশাসক মাসুদ করিম দাবি করেছেন, সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের যথা সময়ে জানানো হয়েছিল।

♦ বেলায়েত হোসেন- সিটি এডিটর, দৈনিক স্বাধীনমত

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন