তিনলক্ষ টন লবণ মজুদ তবুও আমদানির পাঁয়তারা: ধ্বংসের মুখে দেশীয় শিল্প

চকরিয়া প্রতিনিধি:

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিক একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এবারও লবণ আমদানি করার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেটটি আবার সব পারমিট ভাগিয়ে নিতেও অপতৎপরতা শুরু করেছে। লবণ আমদানীর খবর শুনে চাষীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি সভাও করেছেন। তিনি বলেছিলেন, দেশীয় লবণ শিল্প রক্ষা এবং শিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবনমানের নিশ্চয়তাকল্পে সরকার বিদেশ থেকে লবণ আমদানীর মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে যাবেনা। মন্ত্রীর এমন আশ্বাসে সভায় উপস্থিত সবার মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটে।

অবশ্য ওইদিনের সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু কক্সবাজার বিসিকের কাছে জানতে চান বর্তমানে কত পরিমাণ লবণ চাষীর মোকামে আছে তা নিশ্চিত করতে। এ জন্য মন্ত্রীর নির্দেশে পাঁচ সদস্যদের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে গঠিত কমিটি মাঠ পর্যায়ে জরিপ শেষে শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের কর্মকর্তা (রসায়নবিদ) মো. নুরুল আলম ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি কক্সবাজার অঞ্চলের লবণ উৎপাদন এলাকার মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে বর্তমানে তিন লাখ টন লবণ মজুদ থাকার তথ্য পেয়েছেন। ইতোমধ্যে গঠিত কমিটি জরিপ শেষে মাঠ পর্যায়ে তিনলাখ টন লবণ মজুদ থাকার বিষয়টি লিখিতভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আগামী নভেম্বরে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ বছরের লবণ উৎপাদন মৌসুম শুরু হচ্ছে। সে কারণে মজুদ থাকা লবণ ব্যবহার শেষ হওয়ার আগেই মৌসুমের নতুন লবণ বাজারে আসবে। ফলে মৌসুমের নতুন লবণে দেশের চাহিদা মেটানো সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সালে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার আংশিক এলাকার ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে প্রাকৃতিকভাবে লবণ চাষ হয়।

প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এসব জমিতে লবণ উৎপাদন চলে। চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন উপকূলের ৪৫ হাজার চাষি। ২০১৭ সালে উল্লিখিত পরিমাণ জমিতে বিসিক লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ লাখ ২১ টন নির্ধারণ করেন। মৌসুমের শেষ পর্যায়ে লবণ উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। তবে মাঠ পর্যায়ে চাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মিল মালিকদের দাবি, গত বছর বিসিকের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে অতিরিক্ত পরিমাণ লবণ দেশে উৎপাদন হয়েছে। যার কারণে সারা বছরের চাহিদা মেটানোর পরও এখনও মাঠ পর্যায়ে তিনলাখ টন লবণ মজুদ রয়েছে। যা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপির নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন। ফলে বর্তমান পটভূমিতে দেশে লবণ আমদানির কোন প্রয়োজন নেই।

চকরিয়া উপজেলার দরবেশকাটা এলাকার লবণচাষি মোহাম্মদ এখলাছ উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগ সভনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন বর্তমান সরকার দেশীয় লবণের দাম অনেক বাড়িয়েছে। চাষীরা মাঠ পর্যায়ে লবণ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হলে আমরা ভালো মূল্য পাব না।

একই উপজেলার বদরখালীর লবণচাষি নুর-উন নবী বলেন, গত বছর উৎপাদিত লবণ এখনও আমার মোকামে মজুদ আছে। আমার মতো আরও অনেকে লবণ মজুদ রয়েছে। তারপরও কেন এবং কাদের স্বার্থে বিদেশ থেকে লবণ আনা হবে।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু কিছু অসাধু মিল মালিক মাঠ পর্যায়ে তদারকি না করে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এবং বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে ভুল তথ্য দিয়ে ঘাটতি দেখিয়ে লবণ আমদানির অপচেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চকরিয়া উপজেলার বৃহত্তম লবণ চাষি দরবেশকাটা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ আট উপজেলায় লবণ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন ৪৫ হাজার চাষি। আবার এই শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছেন অন্তত ৫ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী। প্রতিবছর এখানকার প্রায় ৬৫-৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ করে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা পুরণ করে আসছে।

তিনি বলেন, দেশে লবণের ঘাটতি নেই, এ পেক্ষাপটে মজুদ থাকার পরও কতিপয় মহলের চক্রান্তে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করলে দেশীয় লবণশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে। এতে চাষের আগ্রহ হারাবে এখানকার চাষীরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সুবিধাভোগী কতিপয় মহলের পক্ষ নিলে দেশীয় লবণ শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। এতে কর্মসংস্থান হারাবে লবণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৫ লক্ষাধিক মানুষ। তাই দেশীয় লবণ শিল্প রক্ষা ও জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির মতো আত্মঘাতী পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে।

মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, গত মাসে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপির দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেশীয় লবণ শিল্পকে রক্ষাকল্পে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি না করতে অনুরোধ করেছি। এখানকার চাষিদের দুঃখ দুদর্শা মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছি। চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না নেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টির আলোকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনাও করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন