নুহাশ হুমায়ূনের বিজ্ঞাপন ও মুক্তমনা চেতনাবাজদের উষ্কানীর জবাব

fec-image

একটি বিজ্ঞাপন এবং এটা নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কতো বিচিত্র। উদ্দেশ্য যদি অসৎ হয় তবে কাজের ভালো দিকটা উহ্য করে তার ত্রুটি আবিস্কার করা খুব সহজ। আপনার অন্তরে সাম্প্রদায়িকতা, আপনি চাইছেন দিতে ধর্মীয় উসকানি। বস্তুতঃ এই কারণেই সামান্য একটা বিজ্ঞাপনকে আপনি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। বলছি পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা নুহাশ হুমায়ন পরিচালিত ইনোভেটিভ স্মার্টফোন ব্র্যান্ড TECNO এর শর্ট ফিল্মটি সম্পর্কে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা পর্যালোচনা দেখে অধীর আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞাপনটি দেখলাম। যারা বিজ্ঞাপনটির সমালোচনা করেছেন তাদের সমালোচনার থিম একত্রিত করলে যা পাই তা হলো “রাফি” মুসলিম নাম। একজন উপজাতিকে বিজ্ঞাপনে মুসলিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

রাফি কেন দৌড়ে গিয়ে সেহরী, ইফতারের সময় বলে দিচ্ছে? পাহাড়ে যেখানে ৩জি পেরিয়ে ৪জি নেট চালু হচ্ছে সেখানে এমন দৌড় নেহাত বেমানান।

সমালোচকদের মতে, পাহাড়ে এমন কোন দূর্গম জনপদ নেই যেখানে বাড়ি বাড়ি দৌঁড়ে গিয়ে সেহরী, ইফতারের সময় বলে দিতে হবে। পাহাড়ের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা সম্পুর্ণ মিথ্যাচারে ভরপুর বিজ্ঞাপন।

বিজ্ঞাপনে যে মুসলিম পরিবারের ভদ্র লোককে দেখানো হয়েছে তিনি জাতিতে বাঙ্গালী। আর বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী মাচাং কিংবা টং করা ঘরে বসবাস করেন না। এমন এমন আরও কতো সমালোচনা।

উল্লেখিত সমালোচনার বিপরীতে আমি বেশি কিছু বলতে চাইছি না। কারণ, পূর্বে আমি বলেছি যাদের অন্তর দৃষ্টি সাম্প্রদায়িক, যাদের উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় উসকানি দেওয়া তাদের কাছ থেকে এমন সমালোচনা পাওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে হাঁ, আমি নিজে পাহাড়ের সন্তান। তাই বলতে পারি এই সমস্ত সমালোচনা যারা করছেন তারা পাহাড়ের বাস্তবতা সম্পর্কে সম্পুর্ণ অজ্ঞ, তা তাদের সমালোচনার মাঝে ফুটে উঠেছে।

আপনি কিভাবে মন্তব্য করেন যে, পাহাড়ে এমন দূর্গম অঞ্চল নেই? আপনি পাহাড়ের কোথায় কোথায় বিচরণ করেছেন? পাহাড়ি সন্তান হিসেবে আমি বলতে পারি পাহাড়ে এখনো অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে মসজিদ নেই, পাঁচ ওয়াক্ত আযানের ধ্বনি পৌঁছায় না মুসল্লীদের কানে। শুধু দূর্গম বান্দরবান নয়, রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলা, লংগদু উপজেলা, নানিয়ারচর উপজেলা এবং খাগড়াছড়ি জেলার দিঘিনালা উপজেলাসহ সকলের পরিচিত সাজেক আসলেই বুঝতে পারবেন পাহাড়ে মসজিদ পর্যাপ্ত কিনা!

এমন অসংখ্য পাড়া মহল্লা রয়েছে যেখানে মসজিদের আযান পৌঁছাতে পারে না। এছাড়া নেই পর্যাপ্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফ্রি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অনেকেই আযান ছাড়া সেহরী, ইফতার করে থাকেন। সুতরাং বিজ্ঞাপনে দূর্গম পাহাড়ের বাস্তব চিত্রটাই তুলে ধরেছেন।

এবার যদি বলি বাঙ্গালীদের টং ঘর নিয়ে তবে বলতে হয় বিজ্ঞাপনে মুসলিম যে বাঙ্গালী চাচাকে দেখানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষ্যে তিনি পাহাড়ের কেউ নন। আমার দৃষ্টিতে বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত এই বিজ্ঞাপনটিতে চাচা চরিত্রটি মনে হয়েছে দূর্গম পাহাড়ে চাকরি করতে আসা সমতলের কোন বাঙ্গালীর। বিশেষ করে বন বিভাগের কোন কর্মকর্তার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। পাহাড়ের বন বিভাগের প্রায় রেষ্ট হাউজ কিংবা বসবাসের কোয়ার্টারগুলোর দিকে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে এগুলো মাচাং কিংবা কথিত টং করা ঘর। সুতরাং যারা বলছেন পাহাড়ে বাঙ্গালীরা টং ঘরে বসবাস করেনা তারা নিতান্তই পাহাড় সম্পর্কে অজ্ঞ।

এখানে আরও একটি তথ্য দিয়ে রাখি পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্ত এলাকায় বন্য হাতির উপদ্রব্য রয়েছে সেই সমস্ত এলাকার উপজাতি -বাঙ্গালী প্রায় সকলেই একটা সময় টং করা ঘরে বসবাস করে থাকে। তাই বাঙ্গালী চরিত্রে টং ঘরে বসবাস দেখে আশ্চার্যাণ্বিত হওয়ার কিছু নেই।

পাহাড়ের উপজাতি অধ্যুষিত কোন অঞ্চলে সমতলের কোন মুসলিম চাকরিজীবির বদলী হলো। যেই এলাকায় নেই কোন সমজিদ। সেই এলাকায় সেহরী, ইফতারের সময় জানাতে এক রাফির জন্ম নেওয়া কি অসম্ভব? একমাত্র মহৎ হৃদয় থাকলেইতো এমনটা সম্ভব।

এবার বলি স্পর্ষকাতর “রাফি” নামটি সম্পর্কে। বিজ্ঞাপনে প্রধান চরিত্র হলো রাফি। উপজাতি ছেলেটার আসল নাম আমার জানা নেই। তবে তার আসল নাম রাফি মারমা, রাফি চাকমা হলেও কিন্তু আমদের অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিলাইছড়ি উপজেলার প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতার নাম রাসেল মারমা। এখন তাকে যদি রাসেল নামে সম্বোধন করা হয় তবে কি তিনি মুসলিম হয়ে যাবেন? কখনোই না। পাহাড়ে অনেক উপজাতিরই বাঙালি বা বাঙালি মুসলিমের অনুরূপ নাম রয়েছে।

সুতরাং রাফি নাম নিয়ে বিচলিত যারা হচ্ছেন তারা হয়তো পাহাড়ি নাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারপরেও যদি যুক্তিতে আসি তবে বলতে হয়, একজন উপজাতির মুসলিম হওয়া কি অপরাধ? পাহাড়ের সকল উপজাতি বৌদ্ধ হবেন এটা কিন্তু নয়। বর্তমানে হাজার হাজার উপজাতি হতে খৃষ্টান, হিন্দু সহ নানা ধর্মাবলম্বী রয়েছেন। এতে যদি অপরাধ না হয় তবে মুসলিম হলে কেন অপরাধ হবে?

যদিও বিজ্ঞাপনে সর্বশেষ রাফিকে মুসলিম হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। তুলে ধরা হয়েছে একজন সাধারন অসাম্প্রদায়িক পাহাড়ি যুবক হিসেবে।

এখন একজন পাহাড়ি যুবক কেন মুসলমানদের জন্য কাজ করবে? সম্ভবত আমাদের রাষ্ট্রের কথিত সুশিল সম্প্রদায়ের রচিত সংবিধানে পাহাড়ি যুবকের মুসলিম প্রীতির কথা উল্লেখ নেই। নচেৎ এমনতো হওয়ার কথা নয়? ভারতের মতো একটি রাষ্ট্র যেখানে হিন্দু কয়েদিরা জেলে বসে আনন্দ নিয়ে ইফতার করছে, বিভিন্ন ধর্ম যাজকরা মুসলিমদের সাথে ইফতার ভাগাভাগি করছে সেখানেতো কোন দোষ খোঁজা হয় না?

ও আচ্ছা ভারতের উদাহরণ দিবো কেন? পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর, রাঙ্গামাটির সাংসদ দীপংকর তালুকদার জীবনে কতোবার যে ইফতার করেছেন, ইফতার পার্টিতে প্রধান অতিথি হয়েছেন তার হিসাব নেই। কই তাদের বিষয়েতো কোন সমালোচনা হয় না?

তবে কেন সামান্য রাফি চরিত্র নিয়ে আপনাদের এতো চুলকানি হবে? এদেশের কথিত সুশিল সমাজের সংবিধানে আছে “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।” তবে পবিত্র রমজানে রাফি চরিত্রে একজন উপজাতি যুবক মানবিক আচরণ প্রদর্শন দ্বারা কি এমন অশুভ কাজ করে ফেলেছে? সুতরাং যারা সমালোচনা করছেন তাদের নীতিগত আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সমালোচনা নয় আমি যদি বিজ্ঞাপনটি নিয়ে পজেটিভ চিন্তা করি তবে এটি একটি অস্বাধারণ বিজ্ঞাপন হয়েছে। যার সমস্ত প্রশংসার দাবিদার নুহাশ হুমায়ন এবং টেকনো স্মার্ট ফোন কোম্পানী। আমরা চাই জাতি- ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক পাহাড়। অসাম্প্রদায়িক পাহাড় গড়তে এমন ছোট্ট চলচ্চিত্র নয় শুধু, বড় বড় চলচ্চিত্র তৈরী করতে হবে।

তবে হাঁ, সেখানে খেয়াল রাখতে হবে যাতে ধর্মীয় অবমাননা না হয়ে মানুষের প্রতি মানুষের সম্পৃতির বন্ধন ফুটে ওঠে। আর এটা সমসাময়িক পাহাড়ের জন্য অতীব জরুরী। নুহাশ হুমায়নের নিকট একজন পাহাড়ের সন্তান হিসেবে এমন অসাম্প্রদায়িক চলচ্চিত্র ভবিষ্যতে আরও প্রত্যাশা করছি। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি একজন জলন্ত কিংবদন্তী হুমায়ন আহমেদ এর পুত্রের পক্ষেই কেমন এমন দুঃসাহসিক চলচ্চিত্র নির্মান সম্ভব।

পরিশেষে এইটুকু বলে রাখি, একটি পক্ষ চাননা পাহাড় অসাম্প্রদায়িক হোক। পাহাড় অসাম্প্রদায়িক হলে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে একটি পক্ষের ধান্দাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে। আজ যারা নুহাশ হুমায়নের সমালোচনা করছেন তারা হচ্ছেন সেই সমস্ত ধান্দাবাঁজ। পাহাড়ে নিয়ে যে কোন ভালো কাজের সমালোচনা করে পাহাড়ের সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে জাগিয়ে তোলার মাঝেই যেন এদের স্বার্থকতা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: নুহাশের বিজ্ঞাপন, সাম্প্রদায়িক উষ্কানী
Facebook Comment

2 Replies to “নুহাশ হুমায়ূনের বিজ্ঞাপন ও মুক্তমনা চেতনাবাজদের উষ্কানীর জবাব”

  1. ভাল লেগেছে।
    সমাজের সবাই একই দৃষ্টি ভংগী নিয়ে চলে না। সবাই সব ভালো খুজেও পায় না।

  2. আসলেই বাস্তবিক ছিল ।
    বিজ্ঞাপনের নির্মাতা পরিচালক প্রশংসার দাবি রাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন