পানছড়ি গুচ্ছগ্রামের গম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

পানছড়ি উপজেলায়  গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বাঙালি পরিবারসমূহের জন্য রেশন হিসেবে বিতরণের জন্য বরাদ্ধকৃত খাদ্যশস্য চাল এবং গম গুদামে না এনে অন্যত্র পাচার করে বিক্রয়ের অভিযোগ উঠেছে।পানছড়ি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট এ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন অনেকেই। সাম্প্রতিক অভিযোগ, বরাদ্ধকৃত চাল কার্ডধারীদের মাঝে বিতরণ করা হলেও কোনপ্রকার গম বিতরণ করা হয়না। বরাদ্ধের কোন গম গুদামেও আসেনা। গুচ্ছগ্রামের এসব হতদরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্ধকৃত গম বিক্রি করে দেয়া হয় চট্টগ্রামের বাজারে। এছাড়া চাল বিতরণেও অনিয়মের অভিযোগ কম নেই। ওজনে কম দেয়া, চালের বদলে টাকা নিতে বাধ্য করা ইত্যাদি।

পানছড়ি উপজেলার ১২টি গুচ্ছগ্রামে বাঙালি রেশনকার্ডধারীর সংখ্যা ৪ হাজার ১’শ ৩৪ জন। সরকারীভাবে প্রতিজন কার্ডধারীর জন্য মাসে ৩৫.৯৫ কেজি চাল ও ৪৯.১০ কেজি গম বরাদ্ধ দেয়া হয়। আর এসব খাদ্যশস্য বিরতণ করা হয় তিন মাস অন্তর অন্তর। বিশেষ করে গম বিতরণ না করে জোরপূর্বক বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে ১১-১৪ টাকা করে গমের টাকা দেওয়া হয়।   ইতিমধ্যে বিভিন্ন দফতরে গম পাচারের অভিযোগ করে পানছড়ি সচেতন নাগরিক সমাজের নামে কয়েকজন লিখিত অভিযোগ পত্র পাঠিয়েছেন।

পানছড়ি উপজেলার আলী নগরের বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম জানিয়েছেন, গম চাইলে দু’তিন বছর আগের পুড়ানো খাবার অনুপযোগী কিছু গম আছে  সে গুলো নিতে বলে তাই বাধ্য হয়েই তাদের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়।

মধ্যনগর এলাকার আমজাদ হোসেন জানান, রেশন বিতরণকারীদের কাছে গম চাইলে গুদামে নাই বলে, বাধ্যহয়ে কয়েকজন রেশন ব্যবসায়ী রয়েছে তাদের কাছে বিক্রি করতে হয়।

পানছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. বাহার মিয়া অভিযোগ করে বলেন, সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে মোটা অংকের বাণিজ্য করছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বারবার অভিযোগ করেও কোন সুরাহা হয়নি। এদিকে পুনরায় রেশন বিতরণের সময় ঘনিয়ে এসেছে, অথচ এখন পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী গুদামে কোনপ্রকার গম মজুদ করতেও চোখে পড়েনি। ধারণা করা হচ্ছে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এ মাসের রেশনেও কোন গম পাবেনা কার্ডধারীরা।

অভিযোগের সূত্র ধরে বুধবার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তা প্রমিত কুমার চাকমাকে পাওয়া যায়নি। কথা হয় উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক অনিমা চাকমার সাথে। তবে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্যই তিনি দিতে পারেন নি। জানালেন পানছড়ির এলএসডি একেএম মঈনুল খাইর তেমন কোন তথ্য উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যলয়ে প্রেরণ করেন না। এখানে কেবল খাদ্যশস্য চাহিদার পরিমাণ ছাড়া তেমন আর কিছুই নেই।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেশন হিসেবে বিতরণের জন্য বরাদ্ধকৃত খাদ্যশস্য ৬০৮ মে. টন গম বিতরণ দেখিয়েছে উপজেলা খাদ্য গুদাম। অথচ সরেজমিন খাদ্য গুদামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে  পাওয়া যায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট চারটি গমের চালানপত্র।  প্রত্যেক চালানপত্রে ১১ মেট্রিকটন করে গম এসেছে ৪৪ মেট্রিকটন অথচ বিতরণ দেখিয়েছে ৬০৮ মেট্রিকটন।

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত বরাদ্ধকৃত ৬০৮ মেট্রিকটন গম গুদামে এসেছে এবং তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রত্যায়ন পত্র পেয়ে বিতরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন পানছড়ি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম মঈনুল খাইর (এলএসডি)। রেজিস্টার দেখতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দোহাই দিলেন তিনি। এছাড়া অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গুদামে মজুদকৃত গমের চালানপত্র অর্থাৎ ‘ইনভয়েস’ দেখতে চাইলে তিনি কেবল চার ট্রাক গমের চালানপত্রই দেখাতে পেরেছিলেন। বাকি চালানপত্র গুলো কোথায় জানতে চাইলে চালানপত্র দেখাতে এক সপ্তাহ সময় চান তিনি। এ সময় তিনি আরও জানান, জেলার অন্যসব গুদাম যে ভাবে চলে একই ভাবে পানছড়ি খাদ্য গুদামও চলছে। বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগের বিষয়টি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে জানান।

খাদ্যশস্য বিতরণ নিয়মাবলীতে বরাদ্ধকৃত সম্পূর্ণ খাদ্যশস্য বিতরণ কেন্দ্রে মজুদ করার পর সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিদর্শন করে প্রত্যয়ন করার কথা উল্লেখ রয়েছে তাহলে কি ভাবে প্রত্যয়ন পত্র দিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এমন প্রশ্নও উঠেছে।

এদিকে পানছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, গম না দিয়ে অন্যত্র বিক্রয়ের বিষয়ে কয়েকদিন আগে লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। বাদীকে নোটিশ করেছেন কিন্তু দেখাপাননি। ব্যাপারটি আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখবার জন্য খাদ্য বিভাগকে অনুরোধ করবো।

এ বিষয়ে কথা বলতে পরপর দু’দিন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে গিয়েও দেখা মেলেনি। কার্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা জানালেন দাপ্তরিক কাজে জেলার বাইরে আছেন তিনি। পরে মুঠোফোনে কথা হয় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আশরাফুল আলমের সাথে। জানালেন, অভিযোগের বিষয়টি শুনেছেন এবং তদন্ত করে প্রাশাসনিক ব্যবস্থা নেবেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন