পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালীদের সরিয়ে নিন- ড. মিজানুর রহমান

IMG_5359

স্টাফ রিপোর্টার:

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, `পার্বত্য চট্টগ্রামে জোর করে বাঙালি জনসংখ্যা বাড়িয়ে সেখানকার আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করার রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার যেসব বাঙ্গালিদের পুনর্বাসন করেছে তাদের আবারো সেখান থেকে সরিয়ে নিন।  প্রয়োজনে তাদের অন্য জায়গায় পুনর্বাসন করতে হবে’।

তিনি বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জাতিসংঘ ইউনিভার্সাল পিরিউডিক রিভিউর (ইউপিআর) সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে অগ্রগতির বর্তমান অবস্থা: আদিবাসী প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।

অ্যাকশন এইড এবং কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজক। সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম এর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত; নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবীর; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা আক্তার জাহান; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং; জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমূখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একশন এইড এর প্রেপাগ্রাম, পলিসি এন্ড ক্যাম্পেইন এর পরিচালক আসগর আলী সাবরী। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের বিনোতাময় ধামাই।

পার্বত্য এলাকায় সেনা বাহিনীর অবস্থানের সমালোচনা করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণই আপনার শক্তি। তারাই আপনাকে নিরাপত্তা দিবে। কোনো বাহিনী আপনার নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তাই জনগণকে আপনি দূরে সরিয়ে দিবেন না।’

অধ্যাপক মিজান বলেন, ‘বাংলাদেশের মত একটি রাষ্ট্রের আচরণ কখনো তার আদিবাসীদের প্রতি এমন হতে পারে না। এখন সময় এসেছে জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা। আদিবাসীদের ভোটেই তারা নির্বাচিত হবেন। আদিবাসীদের নিজ ভুমিতে পরবাসের অবস্থা দুর করতে হবে। জেরুজালেমকে আরবহীন করার যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তেমনি পার্বত্য চট্রগামের ক্ষেত্রে একই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে’।

তিনি বলেছেন, ‘জাতিসংঘ ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) সুপারিশসমূহে বাংলাদেশ সরকার বলেছিল আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করা যাবে না। কিন্ত আমরা তখন বলে ছিলাম বাংলাদেশে আদিবাসী আছে, এখনো বলছি আছে, ভবিষ্যতেও বলবো আছে। কারণ আদিবাসী ছাড়া বাংলাদেশ পূণাঙ্গ রাষ্ট্র নয়। সরকার জাতির কাছে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রতিশ্রতি দিয়েছিল তা পুরণ করতে বাধ্য’।

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র ভুল পথে চলতে পারে। তবে আমাদের কাজ হবে সঠিক পথে ফেরাতে চিৎকার করা। রাষ্ট্র আমাদের চিৎকার না শুনলে আরো জোরে চিৎকার করতে হবে। তাহলেই সরকার আমাদের চিৎকার শুনতে পারবে।’

অধ্যাপক মিজান বলেন, ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন চাই। অন্য কোনো কিছুই দরকার নেই, ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন চাই। তাইলেই পরিস্থিতির আমূল ও মৌলিক পরিবর্তন আসবে। এই শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না করলে এক সময় এদেশ থেকে পাহাড়িরা বিলুপ্তি হয়ে যাবে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মিজানুর রহমান বলেন,  `জাতির পিতাকে কোন আদিবাসী আজ পর্যন্ত অসম্মান করেনি। কেউ কোনদিন রাজাকার বলেনি। এ থেকে বোঝা যায় আদিবাসীদের আস্থা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপর আছে। কিন্তু এ আস্থা আর কতদিন থাকবে? সরকারপক্ষ বা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাবো আদিবাসীদের এই আস্থাকে সম্মান দেখাতে। এতে করে পারস্পরিক সম্প্রীতি যেমন বাড়বে তেমনি সরকারই লাভবান হবে’।

তিনি বলেন, `পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিষয়ে সরকার শুধু বিভিন্ন বিভাগ হস্তান্তরের বিষয়গুলো বলে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু আমি মনে করি সেখানকার ভূমি কমিশনকে কার্যকর করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এছাড়াও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন শৃ্খংলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভারও আঞ্চলিক পরিষদের কাছে হস্তান্তরের সুপারিশ করেন’।

আদিবাসীদের যেকোন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তিনি সকলকে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ পাঠানোর অনুরোধ জানান। সাম্প্রতিক সময়ে নানিয়াচরে আদিবাসী গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শানাক্ত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তিরও দাবি জানান তিনি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, `২০১৩ সালের ইউপিআর রিভিউ এর সময় তখনকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনির নেতৃতে যে দল অধিবেশনে গিয়েছিল সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার আগে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দটির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি প্রতিবেদনে লেখার জন্য জোর দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।

এই সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ আমরা দেখছিনা। বাধ্য হয়ে সেই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমাকে অসহযোগ আন্দোলেনের ডাক দিতে হচ্ছে। জানিনা সেই আন্দোলন শান্তিপূর্ন হবে নাকি সহিংসতাপূর্ন হবে। অনতিবিলম্বে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমি সরকারের প্রতি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ ঘোষনা করার। যাতে করে পাহাড়ী আদিবাসীরা সুস্পষ্ট ধারনা পায় কবে কখন এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হব ‘।

 সাবেক তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বলেন, ‘ইউপিআরে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার কিছু ইতিবাচত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু জায়গায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদেরকে তাই আরো বেশী এই বিষয়ে এডভোকেসি করতে হবে। এক্ষেত্রে আদিবাসী বান্ধব সাংসদ বৃদ্ধি করতে হবে’।

তিনি আরো বলেন, ‘বিজয়ের মাসে যে চুক্তি হয়েছিল এবং চুক্তির ফলে যারা অস্ত্র জমা দিয়েছিল তাদের প্রতি বর্তমান সরকার অন্যায় করতে পারেনা’। তিনি অবিলম্বে বর্তমান সরকারকে আদিবাসীদের অধিকারগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান।

 নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ‘সরকার ভোটের আগে পাহাড়িদের আদিবাসীর স্বীকৃতি দিবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। নির্বাচনে জিতে তা ভুলে গেছে’।

আদিবাসী নারীদের উপর চলমান সহিংসতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের নারীদের প্রতি যে মানসিকতা লালন করে তাদের উপর অন্যায়-অত্যাচার চালিয়েছে ঠিক যেন আমরা এখন আদিবাসী নারীদের প্রতি সেই মানসিকতায় পোষন করছি। এ জন্য আমরা দেখি আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার কোন ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন দোষী ব্যক্তিকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি’।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘ইউপিআর ২য় পর্বে সরকার আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ গ্রহণ করেছিল। সরকার যদি সেগুলো এখনো বাস্তবায়ন না করে তাহলে ২০১৭ সালের অধিবেশনে আবারো তাকে প্রশ্নে সম্মুখীন হতে  হবে। বাংলাদেশে জাতিগত সংখ্যালঘূদের অবস্থা কি। পার্বত্য চুক্তির অবস্থা কি? সরকারকে আবারো ২০১৭ সালে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে নানিয়াচরে যে হামলা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ থমকে যাওয়ার কথা। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের এ বিষয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। যা আদিবাসীদের শুধূ হতবাক করে। আদিবাসীদের অধিকার অর্জনের জন্য তিনি বাঙালি-আদিবাসী সকলকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান’।

রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘ইউপিআরে সরকার যে অঙ্গীকার করে সেটি কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটা খুবই বেশী গুরুত্বপূর্ন অর্থ বহন করে। এজন্য দেশের সুশীল সমাজ, সরকারের প্রতনিধি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও জবাবদিহিতার জায়গায় আনতে হবে’।

তিনি আরো বলেন, ‘১৯৫০ সনের প্রজাস্বত্ত আইনে যেসব আদিবাসীদের নাম আছে তাদের অনেকের নাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে আসেনি। এর ফলে বাদপড়া আদিবাসীদের শিক্ষা গ্রহণে, চাকুরী ক্ষেত্রে অনকে সমস্যা তৈরি হচ্ছে’।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পার্বত্যনিউজ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন