Notice: Trying to get property 'post_excerpt' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 53

Notice: Trying to get property 'guid' of non-object in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme-parbattanews/single.php on line 55

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীরা ৫০০ বছর ধরে বসবাস করছে

মেজর জেনারেল অব. আ ল ম ফজলুর রহমান

আমি ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পঁচিশটি পর্ব লিখেছি। এই পর্বসমুহে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার সামরিক কর্ত্যবের মুল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেছি।

এবারের লেখায় আমার মুখ্য বিষয় হবেঃ
১। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি।
২। প্রাকৃতিক পরিবেশ।
৩। জীববৈচিত্র।
৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষ।
৫। ইতিহাস।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস অনেকে লিখেছেন। আমিও লিখবো আমার মতো করে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে।

আমার লেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামের, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষেদের, তাদের কৃষ্ঠি এবং সংষ্কৃতির পরিবর্তন হবে না সত্য তবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হবে বলা যায়।

ইতিহাসের সব গতিবিধি বাঁক পরিবর্তন করে বিশেষ বিশেষ সময়ে। এই বিশেষ সময়ের প্রভাব ইতিহাসের সব পর্বে সমভাবে প্রভাব ফেলে না । এর কারণ বহুবিধ হতে পারে যেমনঃ
১। সময়ের ব্যাপ্তি।
২। শাসনের প্রকৃতি।
৩। শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি।

আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের সময়কালের পর্ব বিবেচনায় নিলে দেখবো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন হয়েছে যেমনঃ

১। ১৬০০ খৃস্টাব্দে দুর এবং নিকটের অনেক অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্হাপনের সূচনা করে।

২। মুঘল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সুদুর দিল্লী থেকে শাসিত হয়। ঐ সময়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক বিদ্রোহ সংঘটিত হতে দেখি। এই সব বিদ্রোহ দমনে ঢাকায় নিযুক্ত মুঘল সুবেদারদের স্বসৈন্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে দেখি।

৩। ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃটিশ শাসনে আসে। ঐসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহের আধিক্য কমে আসে। ইংরেজ শাসনের সময় আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্হানীয় শাসনের ক্ষেত্রে কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখি যার প্রায় সবটাই এখনো বিদ্যমান। এদিক থেকে ইংরেজ শাসনের প্রভাব অন্য সব শাসন থেকে বেশী প্রভাব ফেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

৪। এরপরে ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের অবসান হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অধীনে আসে। এই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একধরনের স্হিতাবস্হা বিদ্যমান থাকে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি পুর্ব পাকিস্তানের সাথে মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের শাসন পরিচালনা করে। ইংরেজ আমলে জারি করা ১৯০০ সালের হিলট্রাক্ট ম্যানুয়াল অপরিবর্তিত রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক ধরনের সাতন্ত্র বজায় রাখার প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি।

৫। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে পুর্ব পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অঙ্গিভুত হয়। এই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়। বিদেশী মদদে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামময় বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত হয়।

১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপরে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়। ইউপিডিএফ এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামকে এখনো অশান্ত করে রেখেছে।

এই অঞ্চলের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম দেওয়া হয় ১৮৬০ সালে যখন এ্যাক্ট- XX11 এর অধিনে। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ পূর্বে অবস্হিত ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়- পর্বত ঘেরা দুর্গম এলাকাকে বৃটিশ রেগুলেশন ডিস্ট্রিক্টের আওতাভুক্ত সিভিল, ক্রিমিনাল ও রেভিন্যু কোর্টের আওতামুক্ত করে পাহাড়ী উপজাতিদের দেখভালের জন্য নিয়োজিত সুপারিন্ট্যান্ড্যান্টের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট এলাকা হলো প্রায় ১৩১৮৪ বর্গ কিলোমিটার। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান ২১০ 2৫’ এবং ২৩০ ৪৫’ নর্থ লেটিচ্যুড, ৯১০৫৪’ ও ৯২০ ৫০’ ইষ্ট লঙ্গিচ্যুডের মধ্যে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পুর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য উওরে ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী অঞ্চল। ঘন বন – জঙ্গলে ঢাকা। অতীতে এই বনাঞ্চল গহীন থাকলেও এখন নাই। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাঁশ এবং কাঠ সংগ্রহ করা যেমন হচ্ছে তেমনি বন ধ্বংস করে সেখানে শাল, সেগুন, গামারী এবং জারুল বন পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসালং রিজার্ভ ফরেষ্ট ছাড়া আর কোথাও তেমন গভীর জঙ্গলের সন্ধান মেলে না । পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় সাধারণত উত্তর – দক্ষিণে প্রলম্বিত। উপরের রিজ প্রশস্তে কম। এর উপর দিয়ে বন্য হাতি চলাচল করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তর ও দক্ষিণে চলাচল সহজ। একবার রিজ লাইনে উঠলে সহজে দুরের পথ পাড়ি দেওয়া যায়। পুর্ব থেকে পশ্চিমে গমনাগমন কঠিন। প্রতি ক্ষেত্রে সুউচ্চ গভীর জঙ্গলে ঢাকা আরোহনে কঠিন কষ্টসাধ্য পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়। পাহাড়ীদের জন্য এই কাজ তেমন কঠিন নয়। যারা সামরিক বাহিনীর সদস্য পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত তাদের পাহাড়ে ওঠার জন্য কাফ মাসেল ডেভেলপ হতে প্রায় ৩ মাস সময় লেগে যায়। এই কাফ মাসেল ডেভেলপ হলে পাহাড়ে সহজে ওঠা নামা করা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের উচ্চতার তারতম্য আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমুদ্র লেভেল থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উপরে অবস্হিত। পাহাড়ের উচ্চতা ৬০০ মিটার থেকে ১০০০ মিটারের মধ্যে। সাকা হাফং সর্বোচ্চ পিক যার উচ্চতা ৩৪৮৮ ফুট।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৭৫ টি পাহাড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে সুউচ্চ পিক হিসাবে। এর মধ্যে আছেঃ
১। সাকা হাফং।
২। জাও ত্লাং।
৩। ডুমলং।
৪। কেওরাডং।
৫। মাইথাজামা হাফং।
৬। থিংদাওত্লাৎ ত্লাং।
৭। মুখরাথুথাই হাফং।
৮। কেরিকুং থুং।
৯। সিপ্পি আরসুয়াং।
১০। তাউং পারি।
১১। তিন মুখ পিলার পিক।

১৯৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৩ টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলাগুলি হলোঃ
১ । খাগড়াছড়ি ।
২ । রাঙ্গামাটি।
৩। বান্দরবান।
এই জেলাগুলি ৪ টি উপত্যকায় বিভক্ত। অতীতে এই উপত্যকাগুলি ছিল গভীর জঙ্গলে ঢাকা। ঐসময় এই ভ্যালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য ছোট বড় ছড়া এবং জলাভূমি।

সেসময়ে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষেরা মিলে ধীরে ধীরে পাহাড়ী জঙ্গল পরিষ্কার করে পাহাড়ে আবাদী জমির সৃষ্টি করে এবং চাষাবাদের আরম্ভ হয়। এভাবেই পাহাড়ে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে।

যদিও তার অনেক পুর্বে থেকে বাঙালিরা পাহাড়ে বসবাস করছিল। অর্থাৎ ১৬০০ খৃ. অনেক আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসবাস ছিল। পরে ধীরে ধীরে বাঙালি কিছু পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক গভীরে বসতী গড়তে আসে । আমি নিজে রাঙ্গামাটির ছোট কাটতলীতে একটি পরিবারের সন্ধান পাই যারা গত ৫০০ শত বছর ধরে ওখানে বংশানুক্রমে বসবাস করছে।

যেমন কাপ্তাই উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাঙ্গাল+হালিয়া=বাঙ্গালহালিয়া । অর্থাৎ বাঙালী হাল চাষিরা চাষের জন্য তাদের লাঙ্গল জোয়াল এবং হালের বলদ এবং পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ে বসতী গড়ে তোলে পাহাড়ের অতি উর্বর জমিতে চাষাবাদ আরম্ভ করে।

পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষেরা এই বাঙালিদের বাঙালহালিয়া বলতো। এতে আরও প্রমাণ হয় জুম চাষের বাইরে গরু টানা লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের কোনো ধারণা পাহাড়ীদের ছিল না। তদুপরি পাহাড়ীদের মধ্যে হালিয়া সম্প্রদায় না থাকা প্রমাণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষেদের হালচাষের জ্ঞান ছিল না।
এই বাঙালহালিয়ারা আবাদী জমির সম্প্রসারণ ঘটায় ধীরে ধীরে পুর্বে রাজস্হলীর দিকে। এই এলাকায় তেমন কোনো পাহাড় না থাকার কারণে জমি ছিল সমতল। এই সমতল জমিতে বাঙালীরা এতো ফসল বিশেষ করে ধান উৎপাদন করতো যে এই এলাকা পরিচিতি পায় রাজার ফসলের থলি বা রাজার ধানের থলি বা রাইস বাওল বলে। সেই থেকে এই এলাকার নাম হয় রাজস্হলি। যা আজও বিদ্যমান।

যেমনটি উপরে উল্লেখ করেছি পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলা ৪টি উপত্যকায় বা ভ্যালিতে বিভক্ত। এই বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে ৪টা প্রধান নদী এবং এর শাখা নদীর দ্বারা। এই প্রধান নদীগুলি হলোঃ
১ । ফেনী নদী।
২। কর্ণফুলি নদী।
৩ । সাংগু নদী।
৪। মাতামুহুরী নদী।

এই নদীগুলি যেসব পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই পাহাড়গুলি উত্তর পশ্চিম থেকে ও দক্ষিণ পুর্ব দিকে সম্প্রসারিত। সাংগু ও মাতামুহুরী নদী সমান্তরালভাবে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমতলে প্রবেশ করার ফলে ২টি উপত্যকার সৃষ্টি করেছে।

কর্ণফুলি এবং ফেনী নদী ও তার শাখানদীসমুহ অন্তঃমুখী হয়ে পাহাড়ের রেখা সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে বেশ কিছু উপত্যকার জন্ম দিয়েছে। অবশেষে কর্ণফুলি নদী সমতলে প্রবেশ করে তার প্রবাহিত পথে।

কর্ণফুলি নদীকে পাহাড়ের মানুষ কিনসা খিয়াং বলে জানে। এই নদীর সংষ্কৃত নাম কর্ণ আর ফুলি মানে ফুল। প্রবাদ আছে চট্টগ্রামের মুঘল শাসকের কন্যা কোনো এক প্রমোদ ভ্রমণের সময় তার কানের দুল এই নদীতে কান থেকে খুলে পড়ে যায়। সেই থেকে এই নদীর নাম হয় কর্ণফুলি।

কর্ণফুলি নদী উৎপন্ন হয়েছে উত্তরে লুংলেহ পাহাড়ে লুসাই পাহাড়ী জেলাতে। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭০ মাইল। উচু নীচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলি নদী চন্দ্রঘোনাতে সমতলে আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর চট্টগ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

কর্ণফুলি নদীর যাত্রাপথের সৌন্দর্য মোহনীয় ও মনোরম। উঁচু পাহাড়ের গহীন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত এই নদী সৃষ্টি করেছে অসংখ্য মনোরম জলাভূমি, লেক, শাখা নদী, জলাধার এবং ছাড়ার সমারোহ। এইসব স্হানে কোথাও নদী প্রমত্তা, কোথাও শান্ত স্রোতস্বীনী। জীববৈচিত্র ও মাছের আঁধার এই নদী যেন প্রকৃতির অপার দান।

কর্ণফুলি নদীর গুরুত্বপূর্ণ স্রোতধারার মধ্যে আছেঃ
১। কাপ্তাই। বর্তমানে লেকে পরিবর্তিত হয়েছে ১৯৬২ সালে।
২। রেংখিয়াং। এই রেংখিয়াং স্রোতধারা কাপ্তাই লেক থেকে উৎসারিত হয়ে দক্ষিণ পুর্বে ফারুয়াতে এসে অনেকটা ক্ষীণকায় হয়ে আরো দক্ষিণ পুর্বে সম্প্রসারিত হয়েছে।
৮০ দশকে রেংখিয়াং খাল মাছের বৃহৎ আঁধার ছিল। এর পাড়ে গড়ে উঠেছে জনবসতির মধ্যে বিখ্যাত লুসাই পাড়া, তক্তানালা। এই তকতানালা ইউনিয়ন সদর। এখানে আমি হাতি ধরে তাকে পোষ মানাবার শিক্ষাকেন্দ্র দেখেছি।

এর পরে ফুলেশ্বর হেডম্যানপাড়া, তেজেন্দ্র কুমার তঞ্চঙ্গা হেডম্যানপাড়া। এই রেংখিয়াং খালের পাড়ে গড়ে উঠেছে ফারুয়া বাজার। ফারুয়া বাজার এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ বাজার যেখানে আবাসিক হোটেল পর্যন্ত আছে।

এই রেংখিয়াং খালের পাড়ে শুক্কুরছড়ি ফরেষ্ট ডাকবাংলোতে আমি থেকেছি। এই ডাকবাংলো একটি রিএন্ট্রেটের মধ্যে অর্থাৎ উভয় পাশে উঁচু পাহাড় আর মধ্যস্হলে দিগন্ত বিস্তৃত নীচু ভূমি হবার কারণে দিনে গরমের ফলে বাতাস হালকা হয়ে উপরে উড়ে যায়। রাত ১০টার পরে আবহাওয়া একটু শীতল হলে বাইরের বাতাস হু হু করে ঐ রিএন্ট্রেটে প্রবেশ করার ফলে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। রাতভর ঝড় মনে হয় সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলবে। ভোর ৪ টার সময় হঠাৎ করে ঝড় থেমে যায়। শক্কুর ছড়ির উল্টো পাড়ে বোম পাড়া। পাশে টিপরাদের বসতী।
২ । সুভলং।
৩ । থেগা।
৪। চেংরী।
৫। কাসালং।
৬। হরিণা।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে সেনাবাহিনীর অস্হায়ী ক্যাম্পসমুহ সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলে ঐ শুন্যস্হান পুরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বিডিআর ক্যাম্প স্হাপন এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

একটি ফুলপ্রুফ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে থেগাখালের পাড়ে বিডিআর ক্যাম্প স্হাপনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমি হেলিকপ্টারে উত্তর থেকে দক্ষিণে থেগা খালের সম্পুর্ণ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করি। থেগাখালে আমি পানি ভর্তি দেখতে পাই। তবে এর প্রশস্ততা রেংখিয়াং খালের বেশি নয়। আজ এ পর্যন্ত ।

ফেনী নদী দক্ষিণ ত্রিপুরায় উৎসারিত হয়ে সামরুম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। মহুরী নদী যা ছোট ফেনী নামেও পরিচিত নোয়াখালীতে ফেনী নদীর সাথে এসে সংযুক্ত হয়েছে। ফেনী নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১১৬ কিলোমিটার। রামগড় ৮০ কিলোমিটার উজানে অবস্হিত।

ফেনী নদীতে মাঝারি আকারের নৌকা চলাচল করতে পারে। সম্প্রতি ২০১০ সালে বাংলাদেশের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফেনী নদীতে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেন।
এই সেতু ২০২০ সালে নির্মিত হলে এটাই হবে বাংলাদেশ ও স্হল বেষ্টিত ত্রিপুরার মধ্যে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। এই সেতুর ভারত ও বাংলাদেশের অংশের যোগাযোগ সড়ক ভারত নিজ অর্থায়নে নির্মাণ করবে।

ফেনী নদীর সীমানা নির্ধারণ ও এর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয় ১৯৫৮ সালে। উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলে। একই বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় জওহরলাল নেহরু ও ফিরোজ খান নূন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করেন।

এই চুক্তি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য প্রেরিত হলে ভারতে সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে ভারতের সংবিধান সংশোধন করে চুক্তি রেটিফাই করার পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬০ সালে ভারত সংবিধান সংশোধন করে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ছিট মহল বিনিময়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্ভবত ১৯৭১ সালের মে/জুন মাসে।

এদিকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেন। কিন্তু আঞ্চলিক ভোটে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

শুরু হয় ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী শাসকদের টালবাহানা। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। আসে স্বাধীনতার ঘোষণা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

ফলে ১৯৫৮ সালের পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত নেহরু-নূন ট্রিটি আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় স্হগিত হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করেন ১৯৫৮ সালের নেহরু-নূন চুক্তির আদলে।

এই চুক্তি উভয় দেশ ডিসেম্বর মাসে রেটিফাই করবে এমন শর্ত ছিল। বাংলাদেশ সময়ের আগে পার্লামেন্টে ইন্দিরা মুজিব ট্রিটি রেটিফাই করে। ডিসেম্বর ৭৪ সালে ভারত প্রস্তাব করে will retify এর স্হলে as soon as possible শব্দ সংযোজন করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ সরল বিশ্বাসে ভারতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে চুক্তির শর্তে will retify এর স্হলে as soon as possible শব্দ সংযোজনে আনাপত্তি জ্ঞ্যাপন করে।

ভারত as soon as possible শব্দের অন্যায় সুযোগ গ্রহণ করে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা মুজিব ট্রিটির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় স্হগিত করে রাখে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পদুয়া ও রৌমারির যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ভারতের টনক নড়ে। অবশেষে ২০১৫ সালে ভারত বাংলাদেশের সাথে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন করে।

১৯৭৪ সালের ১৬ মে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা মুজিব চুক্তির আওতায় চাকলা – রওশনাবাদ ম্যাপ অনুসরণ করে ফেনী নদীর ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। এই চাকলা-রওশনাবাদ ম্যাপ কেবল ফেনী নদীর ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছিল। এতে যা ছিলঃ
১। ফেনী নদীতে ভারত ও বাংলাদেশ কেউ নদী শাসনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
২ । ফেনী নদীতে বাংলাদেশ এবং ভারত ড্যাম, গ্রোয়েন এবং স্পার নির্মাণ করতে পারবে না।
৩।ফেনী নদীর পানি উভয় দেশ অন্যায়ভাবে উত্তোলন করতে পারবেনা।
৪। ফেনী নদীর মধ্যস্রোত হবে এই নদীর ফিক্সড বা অনড় স্হায়ী বাউন্ডারী ১৯৭৪ সালের ১৬ মে যেখানে ছিল।

দেখা গেল ভারত ইন্দিরা মুজিব চুক্তি লঙ্ঘন করে ফেনী নদীতে ডজন ডজন গ্রোয়েন এবং স্পার নির্মাণ করে ফেনী নদীর মধ্য স্রোতকে বাংলাদেশের দিকে অন্যায়ভাবে ঠেলে দিয়ে ভারতের দিকে চর সৃষ্টি করে। এবং তাতে স্হানীয় জনগনকে দিয়ে অন্যায়ভাবে পানি সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে থাকে।

বিডিআরের মহা পরিচালক হলে আমি ভারতের দিল্লিতে সীমান্ত কনফারেন্সে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করি। এবং অবিলম্বে ফেনী নদীর চরে চাষাবাদ বন্ধের কথা বলি।
আমি এও বলি যে যেহেতু ১৯৫৮ সালের নেহরু-নূন ট্রিটির ক্ষেত্রে ভারতে সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে চুক্তির পক্ষে এবং ভারত সংবিধান সংশোধন করেছে তাই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের জন্য ভারতকে নতুন করে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নাই। কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একই ছিটমহল বিনিময় হবে ইন্দিরা মুজিব চুক্তির আওতায় নেহরু নূন ট্রিটির আদলে।

আমি বিডিআরের মহাপরিচালক থাকাবস্হায় ভারতের পক্ষে ফেনী নদীতে নামা এবং চরে ধান চাষ করা সম্ভব হয়নাই।

ফেনী নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের উওরের সীমান্ত বিভাজন করে রামগড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেনী নদী তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতির নির্দেশ করে না। দক্ষিণের সাংগু নদী মগদের কাছে সাবোক খিয়াং নামে পরিচিত। বান্দরবানে এর নাম রিগরেখিয়াং। সমতলে এই নদী সাংগু নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

সাংগু শব্দের অর্থের উৎপত্তি সঙ্খ থেকে যার চুড়ি আমরা বিবাহিত হিন্দু রমণীদের হাতে পরতে দেখি। পূজাতে, পার্বনে ও শুভানুষ্ঠানে হিন্দুরা সংঙ্খধ্বনী করে। আজ এ পর্যন্ত ।

…. চলবে।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীরা ৫০০ বছর ধরে বসবাস করছে”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন