পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের আশঙ্কা

943109_616097695068686_373126545_n

জেএসএস ও ইউপিডিএফ মুখোমুখি ; বাংলাদেশীদের বসবাস বিপজ্জনক ; নিয়ন্ত্রণহীন এনজিও কার্যক্রম

শওকত ওসমান রচি: পাহাড়ে আধিপত্য ধরে রাখতে নতুন মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টসহ (ইউপিডিএফ) বিবদমান সংগঠনগুলো। এর ফলে পাহাড়ে শান্তির বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সবই ব্যর্থ হচ্ছে। পাহাড়ে অশান্তির নেপথ্যে অস্ত্রনির্ভর এ সংগঠনগুলো আবার নতুন করে তৎপরতা শুরু করায় পার্বত্য তিন জেলায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিবদমান এসব সংগঠনের তৎপরতায় সরকার আনেকটাই অসহায়Ñ এমন মন্তব্য করে ওই এলাকার লোকজন জানান, সরকার বিষয়টিতে গুরুত্ব না দেয়ায় পাহাড়ে বাঙালিদের বসবাস বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘নাগরিক কমিটি’ নামে একটি গ্রুপ সাম্প্রতিককালে সেখানে কাজ শুরু করে। তাদের ডাকে ইউপিডিএফ সাড়া দিলেও জেএসএস এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। উল্টো গত বছর ২০ মে (সোমবার) পার্বত্য ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) দুই যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে উভয় দলের নেতারা একে অপরকে যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা বিবদমান নেতারা এলাকায় ফিরে আসাকে সামনের দিনগুলোতে পাহাড় আরো অশান্ত হয়ে ওঠার পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।

ইতোমধ্যে রাঙামাটিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) চুক্তিবিরোধী শক্তি উল্লেখ করে তাদের নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন সন্তু লারমা সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও’র কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও তেমন কোনো কার্যক্রম নেই এ সেলের। এর ফলে নিয়ন্ত্রণহীন থাকছে সে অঞ্চলে কর্মরত এনজিও’র কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেয়ার দাবি এবং পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে জাতীয় পরিচয়ের প্রতিবাদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। অধিকার আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পর সংগঠনটি ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে। ওই চুক্তিতে আদিবাসীদের মুক্তি মিলবে না এবং একে কালো চুক্তি উল্লেখ করে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকে মূলত চুক্তির প-বিপে অবস্থানকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একে অপরকে ঘায়েল করতে মাঠে নামে সংগঠন দু’টি। তাদের সাথে যোগ দেয় পাহাড়ের অন্যান্য ুদ্র সংগঠন।

ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে যে সঙ্ঘাত চলছে, তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সঙ্ঘাত বন্ধে দু’টি দলের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উভয় গ্রুপই ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন পত্রিকা জানায়, গত ৮ মার্চ মিজোরামের লেংপুই বিমানবন্দরের কাছে এক খামারবাড়ি থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করেছে মিজোরাম পুলিশ ও আসাম রাইফেলস। অভিযানে ৩১টি একে-৪৭ রাইফেল, একটি এলএমজি, একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৮০৯টি গুলি ও ৩৩টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, এ অস্ত্র চালানের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল।

পাহাড়ে প্রায় প্রতিদিনই অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন, গুমের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিককালে রাঙামাটির লংগদু থেকে ৫২ আদিবাসীকে অপহরণ করা হয়। এ অপহরণের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলে তারা তা অস্বীকার করে। এর আগে একই জেলার কুতুকছড়ি এলাকা থেকে গ্রামীণফোনের একজন প্রকৌশলীসহ দুই কর্মচারী অপহৃত হন ইউপিডিএফ সমর্থিত সন্ত্রাসীদের হাতে। এরপর গ্রামীণফোন তিন পার্বত্য জেলা থেকে তাদের অফিস গুটিয়ে নেয়। পরে খাগড়াছড়ির পানছড়ির ধুধুকছড়ায় সন্ত্রাসীরা প্রায় ৪০ জনকে অপহরণ করে। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শান্তিচুক্তির পর থেকে জেএসএসের তিন শতাধিক, ইউপিডিএফের ২৪৭ ও জেএসএস-এমএন লারমার গ্রুপের ২৪ জন নিহত হয়েছে এবং অপহরণ হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। এসব সঙ্ঘাতে প্রাণ গেছে মূলত আদিবাসীদেরই।

পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও এর তেমন কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বর্তমানে এ এলাকায় ২৩০টিরও বেশি ছোট-বড় এনজিও কর্মরত রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। এসব সংস্থার কোনোটি যদি রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে তবে সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও সে সম্পর্কে পিসিজেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বুধবার বলেছেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ‘আন্তরিক’ নয়। অন্য দিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, চুক্তির বেশির ভাগ ধারাই সরকার বাস্তবায়ন করছে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে ইতোমধ্যে ২৩৫টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নে সরকারের প থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩১টি বিষয়ের মধ্যে ২১টিই আঞ্চলিক পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তিসহ কিছু বিষয়ের বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, ভূমির বিষয়টি একটু জটিল। এর জন্য আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে ইতোমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তারাই পরের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করবে। পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচন না হওয়া প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেন, এ নির্বাচনে ভোটাধিকার নিয়ে সমস্যা থাকায় নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আইন অনুযায়ী সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।

সৌজন্যে দৈনিক নয়াদিগন্ত

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন