পাহাড়ের প্রাণের উৎসব বৈসাবি

10001534_701272029910814_747302139382997291_n

নিজস্ব প্রতিবেদক:
পাহাড়-হ্রদ আর অরণ্যের শহর রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি আর বান্দরবানে শুরু হয়েছে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের মহান উৎসব, পাহাড়িদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। চাকমাদের ভাষায় এ উৎসবকে বিজু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক ও মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাই, তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় বিষু, অহমিয়াদের ভাষায় বিহু নামে আখ্যায়িত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১৩টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধান তিন সম্প্রদায়ের প্রাণের এই উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই তাই এই মহান উৎসবকে অনেকেই ‘বৈসাবি’ নামে অভিহিত করে থাকে। তবে প্রতিটি সম্প্রদায়ই নিজ নিজ নামে অভিহিত করে নিজস্ব উৎসবকে।

তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ আর তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পেজ্যা দিন’ বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিবুইসুক’, দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ ও তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ নামে অভিহিত করে থাকে।

বৈসুক                                                                                                                                        ত্রিপুরাদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধানতম উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিসহ মোট তিন দিন ধরে পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনটিকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ আর শেষ দিনটিকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনটিকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’। উৎসবের প্রথম দিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণীকে খুব ভোরে ছেড়ে দেয়। পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরে ছেলেমেয়েরা গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরাইয়া’ নৃত্য দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য করে। এই আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরাইয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে থাকে। এই নৃত্য ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। এই নৃত্য দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। যদি কোনো ঘরের উঠোনে এই শূলটি বসানো হয়, তবে ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়।

এভাবে প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য শেষে শিল্পীদের মদ, মুরগির বাচ্চা, চালের বিনিময়ে শিল্পীরা সুর করে সেই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। নৃত্যশেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাঁকে তিন বছর পর পর এই নৃত্যে অংশ নিতে হয়, নতুবা তাঁর অমঙ্গল এমনকি মৃত্যু হয় বলে ‘ত্রিপুরা মিথ’ আছে। এই লোকনৃত্যটিতে ১৬ থেকে ১০০-১৫০ এমনকি ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় নৃত্যটি দেখার জন্য প্রতি বৈসুকে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন।

সাংগ্রাই                                                                                                                                            বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ আদ্যাক্ষরটি পাহাড়ের অন্যতম নৃত্যগাষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাই। মারমারা সাধারণত চান্দ্রমাস অনুসারে এ দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন- এ তিন দিন পালিত হয় এই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব উদ্যাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চালের গুঁড়া প্রস্তুত করে। এ সময় ‘পানিখেলা’ হয়। এই খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক-যুবতীরা একে অন্যের দিকে পানি ছুড়ে মারে। স্নিগ্ধতায়, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে। এ ছাড়া এ দিন মারমারা বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শ্রবণ করে। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাই উৎসব পালন করা হয় বলে ধারণা করা হয়। সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈসাবি উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো মারমা তরুণ-তরুণীদের পানিখেলা বা জলকেলী। মারমা সংস্কৃতি সংসদ প্রতিবছর মারমা অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই পানি উৎসব পালন করে থাকে। এ বছর এই পানিখেলা ১৫ এপ্রিল বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কাপ্তায়ে।

বিজু                                                                                                                                           পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় নৃগোষ্ঠী হলো চাকমা। বিজু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনুভূতি আর মোহনীয় আবেশের দ্যোতনা। এই উৎসবের সঙ্গে তাই যেন দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুলবিঝু’। এ দিন বিজুর ফুল তুলে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিনান্তে ভাসিয়ে দেয় নদীতে। বিজুর সময় ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সালাম করে এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান-চাল খাওয়ায়। এ সময় ঘরে ঘরে রান্না করা হয় ‘পাজোন’ নামের এক বিখ্যাত খাবার। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা গিলাখেলা, গুদু (হাডুডু) খেলায় মেতে ওঠে আর আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায় মহানন্দে। বয়স্করা মদ ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ পান করে। নববর্ষের দিন মাছ-মাংসসহ মজার মজার খাবারের থাকে আয়োজন। কেননা এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছর ধরে ভালো খাবার জুটবে বলে তারা বিশ্বাস করে।

প্রতিবছরই ঘুরেফিরে আসে বিজু, বিষু, বিহু, বিষু, সাংগ্রাই উৎসব। পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের আবেশ। নব-আনন্দে জাগে পাহাড়ের প্রাণ। পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে শুরু হয় এক মহামিলনের মেলা। বৈসাবি উৎসব হয়ে ওঠে তাই পাহাড়ের প্রাণের উৎসব।          

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষাবরণ, বিজু, বৈসাবী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন