পাহাড়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফের অস্ত্র ভাণ্ডার

পাহাড়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফের অস্ত্র ভাণ্ডার

এস বাসু দাশ, বান্দরবান: পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিকে আরও ব্যাপকভাবে অস্ত্র নির্ভর করে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নতুন মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি  (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টসহ (ইউপিডিএফ) বিবদমান সংগঠনগুলো। ফলে পাহাড়ে শান্তির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কার্যত তা ব্যর্থ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে শান্তির জন্য পাহাড়ে নাগরিক কমিঠি নামে একটি গ্রুপ দুই বছর আগে কাজ শুরু করে। তাদের ডাকে সাড়া ইউপিডিএফ সাড়া দিলেও জেএসএস এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। ২০মে (সোমবার) পার্বত্য ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) দুই যুগপূর্তী অনুষ্ঠানে উভয় দলের নেতারা একে অপরকে যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়।

এদিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতারা দলের কর্মীদের উজ্জিবিত করতে ফের প্রকাশ্যে আসার কারণে সামনের দিনগুলোতে পাহাড় আরও অশান্ত হয়ে ওঠার পূর্বাভাস হিসাবে দেখছে স্থানীয়রা।

খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা বলেন, “আন্দোলনের সামনে দিনগুলো হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, আসতে পারে মনুষ্য সৃষ্ট বাধা, সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে।”

অন্যদিকে রাঙামাটিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) `চুক্তিবিরোধী শক্তি` উল্লেখ করে তাদের নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সোজা আঙুল বাঁকা করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সন্তু লারমা সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নেতারা।

সংঘাতের শুরু যেভাবে:
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি এবং পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে জাতীয় পরিচয়ের প্রতিবাদে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। অধিকার আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলন করার পর সংগঠনটি ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে।

ওই চুক্তিতে আদিবাসীদের মুক্তি মিলবে না এবং একে কালো চুক্তি উল্লেখ করে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকে মূলত চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে আধিপত্য ধরে রাখতে একে অপরকে ঘায়েল করতে মাঠে নামে সংগঠন দুটি।

শান্তির আহ্বানে সাড়া নেই:  
তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসীদের নিয়ে গড়া নাগরিক কমিটি জেএসএস ও ইউপিডিএফের সংঘাত বন্ধ করে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে উভয় সংগঠনকে শান্তির পথে আসার জন্য আহ্বান জানালে ইউপিডিএফ একে স্বাগত জানালেও জেএসএসের কোনো জবাব মেলেনি।

বান্দরবান নাগরিক কমিঠির আহ্বায়ক রাজপুত্র নু শৈই প্রু বাংলানিউজকে বলেন, “সংঘাতময় কর্মকাণ্ড পার্বত্য জেলাসহ দেশের জন্য ভালো নয়, দেশের শান্তি প্রিয় মানুষজন পাহাড়ে শান্তি চায়। সহিংসতা কেউ পছন্দ করেনা, আমার বিশ্বাস তারা বিষয়টি অনুধাবন করে গনতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনবে।”

পাহাড়ে অপহরণের রেকর্ড:
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির লংগদু থেকে ৫২ আদিবাসীকে অপহরণ করা হয়। এ অপহরণের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলে তারা তা অস্বীকার করে। অন্যদিকে তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ না থাকা এবং উভয় দলের নমনীয়তা অভাবের কারণে অপহৃতরা বেঁচে আছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছে পার্বত্যবাসী। গত ৯ ফেব্রুয়ারি একই জেলার কুতুকছড়ি এলাকা থেকে গ্রামীণফোনের একজন প্রকৌশলীসহ দুই কর্মচারী অপহৃত হন ইউপিডিএফ সমর্থিত সন্ত্রাসীদের হাতে। এরপর গ্রামীনফোন তিন জেলায় তাদের অফিস গুটিয়ে নেয়। গত সোমবার (২০ মে) খাগড়াছড়ির পানছড়ির ধুধুকছড়ায় সন্ত্রাসীরা প্রায় ৪০ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।  পরে অনেক চেষ্ঠা তদবিরের পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

চুক্তির পর হত্যা-অপহরণ:
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে জেএসএসের ৩ শতাধিক, ইউপিডিএফের ২৪৭, ও জেএসএস- এমএন লারমার গ্রুপের ২৪ জন নিহত এবং অপহরণ হয়েছে ১ হাজারেরও বেশি। পরস্পর সংঘাতে প্রাণ গেছে মূলত আদিবাসীদেরই।

পাহাড়ে শান্তির ডাক প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বান্দরবান জেলা সভাপতি মিল্টন ত্রিপুরা বাংলানিউজকে জানান, “নাগরিক কমিটি জেএসএসকে শান্তির জন্য কোনো আহ্বান জানায়নি, তাদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট।”

অস্ত্র ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে সংগঠনগুলো:
ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে তা বন্ধে সাড়া দিচ্ছে না দলগুলো। সংঘাত বন্ধে দুটি দলের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগও বার বার ভেঙে যাচ্ছে। পাহাড়ে প্রতিদিন অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন, গুমের ঘটনা ঘটছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উভয় গ্রুপই ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, সমৃদ্ধ করছে অস্ত্র ভাণ্ডার।
ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ অন্য দৈনিকগুলো তাদের খবরে জানায়, গত ৮ মার্চ মিজোরামের লেংপুই বিমানবন্দরের কাছের খামারবাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছে মিজোরাম পুলিশ ও আসাম রাইফেলস। অভিযানে ৩১টি একে-৪৭ রাইফেল, একটি এলএমজি, একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৮০৯টি গুলি ও ৩৩টি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, এ অস্ত্র চালানের গন্তব্য ছিল পার্বত্য জেলা।

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের চেয়ে তারা একে অপরকে ঘায়েল করতেই সংঘাত বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে মরছে মানুষ, নি:স্ব হচ্ছে আদিবাসীরা।

আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা প্রসিত প্রকাশ্যে:
প্রসিত বিকাশ খিসা এক যুগ আত্মগোপনে থেকে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেন। যাকে সরাসরি দেখা দূরে থাক, ফোনে কথা বলাটায় যেন ঢাকা ও পাহাড়ের সাংবাদিকদের জন্য দুস্কর ছিলো। পাহাড়ের এ অন্তরালের রাজনীতিবীদ ইউপিডিএফের কর্ণধারকে ২০০১ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রকাশ্যে দেখা গেলেও দীর্ঘ এক যুগ পর বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) প্রতিষ্ঠার দুই যুগপূর্তি উপলক্ষে গত সোমবার খাগড়াছড়িতে বক্তব্য রেখে প্রকাশ্যে আসেন।

আত্মগোপনে থাকা পাহাড়ের এ নেতা ফের প্রকাশ্যে আসার কারণে অনেকে মনে করছেন, নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে ও নিজেদের শক্তির জানান দিতেই তার এ প্রকাশ্যে আসা।
 
এদিকে স্থানীয় আদিবাসীরাই মনে করছে, পাহাড়ের আদিবাসীদের স্বাধীকার আন্দোলনের কথা বলেই আন্দোলন করতে যাওয়া সংগঠনগুলোর এ সংঘাতে ক্ষোধ আদিবাসীরাই আজ অসহায়, এর থেকে মুক্তি মিলবে কখন? এর উত্তর জানা নেই কারো কাছ।

সৌজন্যে বাংলা নিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন