বর্বরতা ও পাশবিকতার পরিবর্তে অহিংসা ও আত্মসংযম চর্চার আহ্বানের মধ্য দিয়ে শেষ হলো রাজবন বিহারের কঠিন চীবরদান
স্টাফ রিপোর্টার :
বর্বরতা ও পাশবিকতার পরিবর্তে অহিংসা ও আত্মসংযম চর্চার আহ্বানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার সম্পন্ন হলো রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান। পুণ্যার্থীদের সাধু, সাধু, সাধু ধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে রাজবন বিহারে দুই দিনব্যাপী ৪২তম কঠিন চীবর দানোৎসব।
নানা আচার অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবে রাঙামাটি রাজবন বিহারে এই দিন বসে লাখো মানুষের মিলনমেলা। ৩২ একর বিস্তৃত বিহার এলাকা পরিণত হয় লোকারণ্যে। এ পুণ্যানুষ্ঠানে সদ্ধর্মানুরাগী অগণিত পুণ্যার্থীর পাশাপাশি ঢল নামে হাজারো দর্শনার্থীর। সব ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক নারী-পুরুষের মিলনে গোটা রাজবন বিহার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
সদ্ধর্ম দেশনাকালে বৌদ্ধ আর্যপুরুষ মহাসাধক পরমপূজ্য শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের হিতোপদেশ উদ্ধৃতি দিয়ে তার অনুগত শীষ্যমন্ডলী হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, ক্ষমতার গর্ব, বর্বরতা ও পাশবিকতার বিপরীতে বুদ্ধের প্রেম, সাম্য, মৈত্রী, ক্ষমা, ত্যাগ, অহিংসা, আত্মসংযম ও করুণার বশবর্তী হয়ে বিশ্বমানবের সুখ-শান্তি ও কল্যাণে ব্রত থাকার পরামর্শ দেন।
বেলা ২টায় রাজবন বিহার মঠে আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে দেশনা দেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরসহ শীর্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, রাঙামাটি ২৯৯ আসনের সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার এমপি, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন, রাঙামাটি সেনা জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মালেক উদ্দীন মো. সামস, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, জেলা পুলিশ সুপার মো. সাঈদ তারিকুল হাসান, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, রাঙামাটি পৌরসভা মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টোসহ স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা।
পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন রাঙামাটি চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। স্বাগত বক্তব্য দেন, চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েন ও রাঙামাটি রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান।
এসময় বিশেষ প্রার্থনা পাঠ করা হয়। অনুষ্ঠানে পরিনির্বাণগত বনভান্তের উদ্দেশে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৈরি চীবরটি ভিক্ষুসংঘের হাতে তুলে দেন চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়। পরে সমবেত পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে সর্বজনপূজ্য মহাসাধক শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের হিতোপদেশ উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির সব গণমানুষকে সব সময় সৎ ও ন্যায়নীতির পথ অবলম্বন করার পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে, এ ধর্মীয় মহোৎসব শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এ আগে ২৪ ঘন্টায় তৈরি কঠিন চীবরটি মহাপরিনির্বাণে বৌদ্ধ আর্যপুরুষ বনভান্তের উদ্দেশে শোভাযাত্রাসহকারে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়াও সকাল থেকে উদযাপিত হয় ভিক্ষুসংঘের পিন্ডদান, বুদ্ধপূজা, কল্পতরু শোভাযাত্রা, পঞ্চশীল প্রার্থনা, চীবর উৎসর্গ, সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, ধর্মসভা, ধর্মীয় দেশনাসহ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি।
প্রসঙ্গত, আড়াই হাজার বছরেরও আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় তার প্রধান সেবিকা মহাপুণ্যবতী বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বের করে বেইনে (কোমর তাঁত) চীবর তৈরি করে দানকার্য সম্পাদন করেন। বিশাখা প্রবর্তিত ওই নিয়মে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে ১৯৭৩ সালে প্রথম কঠিন চীবর দানোৎসব আয়োজন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবার অনুষ্ঠিত হল ৪২তম কঠিন চীবর দানোৎসব।