বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ড: সন্দেহের তীর ইউপিডিএফের দিকে

চট্টগ্রাম ব্যুরো:

রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে ব্রাশফায়ারে হতাহতের ঘটনায় ‘কিলার গ্রুপটিকে’ এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলটি পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ইউপিডিএফ এই ঘটনা ঘটাতে পারে বলে সন্দেহ নিয়েই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তবে পাহাড়ের আরেকটি বড় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সম্পৃক্ততা আছে কি-না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বাঘাইছড়িতে এই হত্যাকাণ্ডের পর রাঙ্গামাটি ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকা জুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে যৌথবাহিনী। পুলিশ এবং বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত কমিটিও তাদের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। বুধবার (২০ মার্চ) ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকের সভাপতিত্বে রেঞ্জের বিশেষ অপরাধ সভায়ও উঠে এসেছে রাঙ্গামাটিতে এই হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক পরিস্থিতি। কিন্তু তদন্ত এবং অভিযানে দৃশ্যমান কোনো সাফল্য আসেনি।

এখনো বলার মতো কোনো রেজাল্ট আসেনি

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাঘাইছড়িতে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা রেকর্ড হয়েছে। সেই মামলা তদন্তাধীন আছে। তদন্তের ক্ষেত্রে এখনো বলার মতো কোনো রেজাল্ট আসেনি। কিলার গ্রুপ যেটা আছে সেটাকে আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। তবে যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে, সেটা ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা। সুতরাং ইউপিডিএফের এই ঘটনা ঘটানোর সম্ভাবনা বেশি।’

দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গত সোমবার (১৮ মার্চ) রাঙ্গামাটিতে ভোটগ্রহণ হয়। ভোটগ্রহণ শেষে সোমবার সন্ধ্যায় রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় তাদের বহনকারী চাঁদের গাড়ির ওপর পাহাড়ের ভেতর থেকে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা ব্রাশফায়ার করে।

এতে ৭ জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- আমির হোসেন, আবু তৈয়ব, মন্টু চাকমা, মিহির কান্তি দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম।

‘দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রতিবারই তারা কেন্দ্রগুলো দখল করে’

সূত্রমতে, তদন্তে নেমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছে তার মধ্যে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্যের বিষয়টি উঠে আসছে। গত উপজেলা নির্বাচনে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন জেএসএস মূল দল অর্থাৎ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন অংশের বড়ঋষি চাকমা। এবারও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে শুরু থেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন ইউপিডিএফের মূল দল ভেঙে তৈরি গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের নেতা সুদর্শন চাকমা। এবার বাঘাইছড়িতে সুষ্ঠু নির্বাচনে কঠোর ছিল প্রশাসন। নির্বাচনে জেতেন সুদর্শন। ভোটগ্রহণ শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বড়ঋষি চাকমা। এ নিয়ে দিনভর উত্তেজনার পর সন্ধ্যার দিকে এই হামলার ঘটনা ঘটে।

ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রাথমিক যে তথ্য আছে, রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রতিবারই তারা (জেএসএস) কেন্দ্রগুলো দখল করে। সেখানে নিজেদের মতো করে ভোট করে এবং তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনে। এবার আমরা কঠোর অবস্থানে ছিলাম যে, কাউকে কেন্দ্র দখল করতে দেব না। যে ক’টা ভোট পড়ে, যে কয়জন ভোট দেয় তারাই দেবে। এটা নিয়ে একটা ক্ষোভ থাকতে পারে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের কেন্দ্র দখল করতে দেয়নি।’

ইউপিডিএফ হামলা করবে কেন?

প্রশ্ন উঠেছে, যে নির্বাচনে ইউপিডিএফ কোনো প্রার্থী দেয়নি এবং হেরেছে জেএসএস-এর প্রার্থী, সেখানে ইউপিডিএফ হামলা করবে কেন?

এর জবাবে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি যে, ইউপিডিএফ এবং জেএসএস-এর মধ্যে একটা অলিখিত সমঝোতা হয়েছে। তারা একজন আরেকজনকে ডিস্টার্ব করবে না, এমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং তাদের মধ্যে হয়েছে। ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি এবং বাঘাইছড়ি এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। আর রাঙ্গামাটির বাকি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে জেএসএস। এজন্য আমরা ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হামলায় জেএসএসও জড়িত কি-না সেটা খতিয়ে দেখছি।’

তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তি হয়। মাত্র দুইমাসের মাথায় চুক্তির বিরোধিতা করে পাহাড়ের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে জেএসএস ভেঙে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ।

২০০৭ সালে জেএসএস থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান-সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা), যা জেএসএস (সংস্কার) নামেও পরিচিত। ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) একজোট হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সন্তু লারমান নেতৃত্বাধীন জেএসএস-এর বিরোধিতার পর ২০১৭ সালে ইউপিডিএফও ভেঙ্গে যায়। গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ।

মূলত পাহাড়ের এখন সক্রিয় এই চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জেএসএস (সংস্কার) ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের মধ্যে অঘোষিত ঐক্য আছে। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতিকালে অন্তরালে এক হয়েছে দুই মূল দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ। এই ঐক্যের ফলে বাঘাইছড়িতে জেএসএস প্রার্থী দিলেও ইউপিডিএফের কোনো প্রার্থী ছিল না। বড়ঋষি চাকমাকে জেতাতে দুই দলই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু বড়ঋষি হেরে যান।

বিদেশি ভারি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রমতে, বাঘাইছড়িতে হামলায় বিদেশি ভারি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা বুলেটের খোসা দেখে এটি নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়, তার অধিকাংশেই বিদেশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বাঘাইছড়ির কিলিং মিশনেও একই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।’

ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ের চারটা আঞ্চলিক গ্রুপেই একেকটি করে সশস্ত্র উপগ্রুপ আছে। তবে কিলিং মিশনে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। বুলেটের খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। এটা সেনাবাহিনীর অস্ত্র বিশেষজ্ঞ টিমের কাছে পাঠানো হবে। তারা রিপোর্ট দিলে তখন বুঝতে পারব।’

বাঘাইছড়ি উপজেলায় বিজয়ী সুদর্শন চাকমা এই ঘটনার সঙ্গে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে দায়ী করেছিলেন। রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদারও জেএসএস মূল দলের দিকে ইঙ্গিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তবে ঘটনার পর থেকেই জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা নাকচ করে আসছে। জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা এবং ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে দাবি করেন তারা এই ঘটনায় জড়িত নন।

বাঘাইছড়ির হত্যাকাণ্ড তদন্তে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব দীপক চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা কমিটির সদস্যরা রাঙ্গামাটি এসেছি। সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আক্রান্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলব। যে সময় দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যেই আমরা রিপোর্ট দিতে পারব বলে আশা করছি।’

সূত্র সারাবাংলা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ড: সন্দেহ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন