বুধ ও বৃহস্পতিবারের হরতাল নিয়ে বিভক্ত পার্বত্য বাঙালী সংগঠনগুলো
পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:
বিতর্কিত পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনী পাশের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলার ডাকা বুধ ও বৃহস্পতিবারের হরতাল নিয়ে বিভ্রান্তি ও ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও কেন্দ্রীয়ভাবে তা অস্বীকার করে হরতাল অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
এদিকে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের পরস্পর বিরোধী ভূমিকা, রেষারেষি, দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতার কারণে বিভ্রান্তিতে পড়েছে বাঙালী সংগঠনগুলোর সাধারণ নেতাকর্মী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণ।
৫ বাঙালী সংগঠন বুধবার রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় এবং বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে।
এদিকে হরতাল প্রতাহারের ঘোষণা দিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরে মাইকিং করেছে খাগড়াছড়ি পৌর কর্তৃপক্ষ। তবে হরতাল বহাল আছে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বাঙ্গালী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। একই দিন সন্ধ্যায় রাঙামাটি জেলার ৫ সংগঠনের তরফে ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মুহম্মদ ইব্রাহীম, গণ পরিষদের জেলা সভাপতি আবদুল খালেক ও সমঅধিকার আন্দোলনের সহ সভাপতি মোহাম্মদ ইউনুসের যৌথ সাক্ষরে রাঙামাটি জেলা থেকে বুধবারের হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে গণ মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে বাঙালী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সাব্বির আহমেদের মোবাইলে ফোন করলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা আলকাস আল মামুন ভুঁইয়া জানায়, ইব্রাহীম বাঙালী ছাত্র পরিষদের রাঙামাটির কেউ নন। বাঙামাটির সভাপতি আলমগীর।
এদিকে বুধবারের হরতালের সমর্থনে মঙ্গলবার বান্দরবার শহরে লিফলেট বিতরণ করেছে ৫ বাঙালী সংগঠন।
এদিকে হরতাল প্রত্যাহারের সত্যতা জানতে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার নেতাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি পৌর কাউন্সিলর আব্দুল মজিদ হরতাল প্রত্যাহারের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। তবে ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর মাসুম রানা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে হরতাল প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছে।
এদিকে খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র রফিকুল আলম বলেন, গত রাতে পৌরসভায় বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ, পৌর কর্মকর্তা এবং বাজার ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে বৈঠক হয়েছে। এতে বাজার ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে সকলের সিদ্ধান্তে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে সদর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির দফতর সম্পাদক মো. জামালউদ্দীন পার্বত্যনিউজকে জানিয়েছেন, সোমবার সন্ধ্যায় পৌরসভায় মেয়রের নেতৃত্বে একটি মিটিং হয়। সেখানে বাঙালী ছাত্র পরিষদ নেতা ও কাউন্সিলর আবদুল মজিদ, কাউন্সিলর মাসুম রানা, ছাত্র পরিষদ নেতা আসাদ, মাইনুদ্দীনসহ খাগড়াছড়ি জেলা বাঙালী ছাত্র পরিষদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মিটিং এ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে আমরা তাদের কাছে জানতে চাই, রাঙামাটি ও বান্দরবান বুধবারে হরতাল হলে খাগড়াছড়িতে বৃহস্পতিবার কেন? তারা এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তখন আমরা খাগড়াছড়িতেও বুধবার হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলি এতে আমরা সমর্থন দেবো। কিন্তু তারা তা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না থাকায় কিছু বলতে পারেন নি।
তখন আমরা বৃহস্পতিবার হরতাল প্রত্যাহার করার আহ্বান জানালে তারা এতে সম্মতি জানান। পরে সবাই মিলে মেয়রকে মাইকিং করার অনুরোধ করলে তিনি তা করবেন বলে জানান।
তবে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন পার্বত্য ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল-মামুন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, হরতাল ঘোষণা দিয়েছে পাঁচটি বাঙ্গালী সংগঠন। অন্য কেউ সেই হরতাল কিভাবে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছেন তা বোধগম্য নয়। হরতাল কর্মসূচী বহাল আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কিছু দালাল শ্রেণীর লোক বাঙ্গালীদের চলমান আন্দোলনকে নষ্ট করে দিতেই এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে বাঙ্গালীরা আরও বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে ৫ বাঙালী সংগঠনের পক্ষে পার্বত্য গণ পরিষদের মহাসচিবের পক্ষে পাঠানো এ বিবৃবিতে বলা হয়েছে, ১৯ অক্টোবর রোজ বুধবার রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, আর ২০ অক্টোবর রোজ বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচীতে কোন হের ফের করা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ সন্তু লারমা সরকারী প্রটোকল ব্যাবহার করে বাঙালিদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে এবং কিছু দালাল মাঠে নামিয়েছে।বাঙালি নাম ধারী দালালদেরকে চিহ্নিত করুন । আন্দোলন থেকে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদ কখনো পিছে হটবে না । পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের কোন নেতা এখানে জড়িত প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
এদিকে কেন্দ্রীয় এ বিবৃতির ঘন্টা খানেক পরে রাঙামাটি জেলার ৫ সংগঠনের তরফে ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মুহম্মদ ইব্রাহীম, গণ পরিষদের জেলা সভাপতি আবদুল খালেক ও সমঅধিকার আন্দোলনের সহ সভাপতি মোহাম্মদ ইউনুসের যৌথ সাক্ষরে রাঙামাটি জেলা থেকে বুধবারের হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে গণ মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে ছাত্র পরিষদের মো. ইব্রাহীমের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কিছু অসুবিধা আছে তাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। কি অসুবিধা জানতে চাইলে তিনি জানান, চাপের মধ্যে আছি।
কারা চাপ দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমবার তাদের ডেকে বুধবারের হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। বুধবার তাদের সাংগঠনিক কর্মসূচী আছে জানিয়ে পরবর্তী বুধবার হরতাল পালনের অনুরোধ করে তারা ২৬ তারিখ হরতাল পালনের আহ্বান জানায়।
এ প্রেক্ষিতে তারা আগামীকাল বুধবারের পরিবর্তে ২৬ তারিখ বুধবার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। প্রেস রিলিজে তেমন কথা নেই কেন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বিষয়টি তারা কেন্দ্রীয়ভাবে মিটমাট না করে স্থানীয়ভাবে কেন করছেন, প্রশ্ন করলে তিনি জানান, বিষয়টি মামুন ভাই ভাল বলতে পারবেন। তবে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাব্বির আহমেদ ওই মিটিংএ উপস্থিত ছিলেন। তিনি এতে সম্মতি জানিয়েছেন। তাছাড়া সম অধিকারের জাহাঙ্গীর কামাল ও গণপরিষদের পারভেজ তালুকদারকেও জানানো হয়েছে, তারাও এতে সম্মতি দিয়েছেন।
জানতে চাইলে গণপরিষদের এড. পারভেজ তালুকদার পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমরা হরতাল ডেকেছি, এটা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। কেউ পালন করলে করবে, কেউ না করলে না করবে। কিন্তু হরতাল হবে।
তার সংগঠনের রাঙামাটি জেলার সভাপতি আবদুল খালেকের সাক্ষরের বিষেয়ে জানতে চাইলে তিনি খোঁজ নিয়ে বলেন, আমার সংগঠনের কেউ কোনো মিটিংএ যায়নি এবং আবদুল খালেকও কোনো হরতাল প্রত্যাহার বিজ্ঞপ্তিতে সাক্ষর করেনি এটা আমি নিশ্চিত করছি। এটা ইউনুস কমিশনারের কাজ।
উল্লেখ্য, গত ১৬ অক্টোবর রবিবার বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ৫ বাঙালী সংগঠন তাদের হরতাল কর্মসূচী প্রত্যাহার করে নতুন এই কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল।