বড়পিলাক ট্রাজেডি: দীর্ঘ চার বছরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ: হত্যাকারীরা চলাফেরা করছে দিব্যি

17=4 copy

এম. সাইফুর রহমান, খাগড়াছড়ি:
দীর্ঘ চার বছরেও বিচার পায়নি খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বড়পিলাক কচুবাউন্তী এলাকার উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া তিন বাঙালী শ্রমিকের স্বজনরা। ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা দারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করে।

এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় সুনিল সরকার, আইয়ুব আলী, নোয়াব আলী নামে তিন বাঙালী শ্রমিক। এঘটনায় উত্তেজিত জনতা পাহাড়ি-বাঙালী উভয় পক্ষের শতাধিক বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে  আহত হয় অন্তত ত্রিশ জন। ২০১১ সালের ১৭ই এপ্রিল ঘটনাটি ঘটেছে। নিহত পরিবারে এখনো শোকের ছায়া বইছে।

ফলোআপ

কেমন আছেন নিহতদের পরিবার 

বর্তমানে নিহতদের পরিবারে সুখ নেই। আছে শোকের মাতম। চারটি বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার হয়নি খুনি-সন্ত্রাসীদের। জামিনে বেরিয়ে এসে আবার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে। তারা অভিযোগ করেন, ঘটনার পরপর তাৎক্ষণিক কিছু সহযোগিতা পেলেও দীর্ঘ ৪ বছরের মধ্যে খোঁজ নেয়নি কেউ। কিভাবে তাদের পরিবার চলছে তার খবরও রাখেনি কেউ।

নিহত সুনিল সরকারের স্ত্রী সীমা সরকার ও তার ৫বছরের শিশু সন্তান জয় সরকার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীকে যারা হত্যা করল তারা দিব্যি চলাফেরা করছে। আজও খুনিদের কারো বিচার হয় নি। স্বামী নেই, ছোট এই সন্তানকে লেখা-পড়া করানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। সন্তান বাবাকে খুঁজে কিন্তু তার বাবাতো আর ফিরবে না।

সুনিলের মা-বাবার চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু, পুত্র শোকে মাতুম তারা আর কোন দিন খুঁজে পাবেনা বুকের ধনকে। উপজাতীয় সন্ত্রাসী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাঠিয়ে দিয়েছে না ফেরার দেশে। মা বলে কথা, বুকফাটা আর্তনাদ বলে দিচ্ছে ছেলে হারিয়ে কতটা যন্ত্রণায় ভোগছেন তারা।

এদিকে চার বছর পার হয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নিহত সুনিলের পরিবার।

এমন অভিযোগ নিহত আইয়ুব আলীর স্ত্রী বেলিনুর জানান, ‘আমার চারটি সন্তান নিয়ে এখন অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছি। গত বছর কালবৈশাখী ঝড়ে আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল ঘর ভেঙে যায়। সিন্দুকছড়ি জোন থেকে টিন দিলেও টাকার অভাবে ঘরের বেড়া দিতে পারছিনা। জরাজীর্ণ অবস্থায় ঘরটিতে ঝড়-বৃষ্টিতে চারটি সন্তান নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জিবন-যাপন করতে হচ্ছে।’ নিহত নোয়াব আলীর স্ত্রী মোছাঃ রহিমা বেগম একই প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন সাংবাদিকদের কাছে।

বিচার বিলম্বিত হওয়ায় ক্ষোভ: অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মম হত্যা কাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবী করেছেন, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কমিশনসহ বাঙালীদের বিভিন্ন সংগঠন। স্থানীয়ভাবে দিনটির স্বরণে কালো পতাকা, কালো ব্যাচ ধারণ ও দোয়ার মাাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত 

১৭ এপ্রিল রবিবার দুপুর ২টা। কচুবাউন্তি এলাকায় বাঙালীদের জমিতে আদা হলুদ লাগানোর জন্য শ্রমিকরা কাজ করছে। বাঙালীরা তাদের নিজস্ব জমিতে ২৫/৩০বছর যাবত এখানে বসবাস করে আসছে। কিন্তু উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ দীর্ঘদিন যাবত সে জমি থেকে তাদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ ১০/১২জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী একটি গ্রুপ তাদের উপর অতর্কিত হামলা করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে তিন বাঙালী শ্রমীককে হত্যা করে। এতে বদিউজ্জামান, আ: মোমিন, ইনতিয়াজ, সফিকুল, সালেহ মুছাসহ গুরুতর আহত হয় ত্রিশজন। এ ঘটনা সহিংসতায় রুপ নিলে উভয় পক্ষের শতাধিক বাড়ীঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। এঘটনায় ৩ উপজেলায় ১৪৪ধারা জারী করে স্থানীয় প্রশাসন। হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করে। হত্যা মামলায় ৫জনকে চিহিৃত করে অজ্ঞাত দুই/আড়াইশ উপজাতীয় সন্ত্রাসীকে আসামী করে মামলা করা হয়। মামলা নং-১ তাং-১৮-৪-২০১১। এ মামলায় খেচু মারামা নামে এক সন্ত্রাসী (এজহারভুক্তসহ) অপর দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তারা জামিনে বের হয়ে আসে। অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনায় অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামী করে অপর একটি মামলা করে পুলিশ। যার নং২/তাং১৯-৪-২০১১।

বড় পিলাক হত্যাকাণ্ড

দীর্ঘ প্রায় এক বছর মামলার বাদী এস.আই মঞ্জুরুল আবছার তদন্ত করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদী হওয়ায় এস.আই মুঞ্জুরুল আবছারের পরিবর্তে এস.আই ঠাকুর দাস মন্ডলকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা ঠাকুর দাস মন্ডল মাত্র ১৫ দিনের তদন্তে দায়সারাভাবে মামলার চূড়ান্ত চার্জসিট প্রদান করে ১১-০৮-১২ ইং তারিখে।

তার তদন্তে হত্যা মামলায় ৩১জন উপজাতী এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮ জন বাঙালীকে চিহিৃত করে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আসামী করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮ জন বাঙালী আসামী ৯/১০/১২/১৩ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনিয়র চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজেস্ট্রেটের আদালতে বিভক্তভাবে হাজির হয়ে জামিন চাইলে তাদেরকে জামিনে মুক্তি দেয় আদালত।

বর্তমানে এ মামলাটি আদালতের বিচারাধীন। তিন বাঙালী শ্রমীক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৩১জন উপজাতীয় আসামীর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে আদালত। দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে পুরিশ রহস্যজনক কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করছে না। অথচ আসামীরা সশরীরে পুলিশের সামনে দিয়ে চলাফেরা করছে বীরদর্পে। অতিতে উপজাতীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক প্রায় ত্রিশ হাজার বাঙালীকে হত্যাসহ নারী নির্যতন, অপহরণসহ নানা অপকর্মের বিচার হয়নি আজো। অথচ যাদের নির্দেশে এসব হত্যা, গুম, লুটতরাজ, চাঁদাবাজীসহ বাঙালীদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুরতার মতো আচরণ করেছে সেই উপজাতীয় সন্ত্রাসীদেরকে পুরস্কৃত করেছে সরকার।

এব্যাপারে জানতে চাইলে গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি ইউসুফ মিয়া বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলা দুটি বর্তমানে আদালতের বিচারাধীন। আসামীদের বিরুদ্ধে কোন গ্রেফতারী পরোয়ানা তার হাতে নেই বলেও জানান তিনি। হাতে পেলে খুব দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অচিরেই এর ফলাফল দেখতে পাবেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন