মং সার্কেলের অজানা ইতিহাস: প্রসঙ্গ – ত্রিপুরারা কেন সার্কেল পায়নি?

fec-image

বর্তমান মং সার্কেলের পূর্ব নাম ছিল – মান সার্কেল। এই মান সার্কেলের ইতিহাস প্রায় সকলের কাছে অজানা বললেই চলে। বেশির ভাগ ত্রিপুরারা দাবী করে যে, এটি আসলে “ত্রিপুরা সার্কেল” হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন মত দিয়ে থাকেন, যার বেশির ভাগই জনশ্রুতি বলা চলে। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত জনশ্রুতি হচ্ছে – “ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাদের জন্য স্বতন্ত্র সার্কেল দিতে চায়নি। কারণ, পাশেই রয়েছে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য, যা ইংরেজদের জন্য ছিল বিপরীত শক্তি। কাজেই, পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি ত্রিপুরাদের স্বতন্ত্র সার্কেল দেওয়া হয়, তাহলে সেই সার্কেল হয়তো পরবর্তীতে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।

কথা হচ্ছে, যদি তাই হতো, তাহলে মান সার্কেলের প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল না। এমনকি “ত্রিপুরা সার্কেল” হওয়ার কথা ছিল – এরূপ ধারণা ত্রিপুরাদের মধ্যে আজও প্রচলিত থাকতো না। কাজেই, অনেকটা ধরে নেওয়া যায় যে, ইংরেজরা ত্রিপুরাদের জন্য স্বতন্ত্র সার্কেল প্রতিষ্ঠা করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন সেটা হয়নি? এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের অন্যতম মানস-সম্পদ খ্যাত লেখক ও সমাজসেবক শ্রী বরেন ত্রিপুরার লেখা আত্মজীবনী – “নঙ-কাচাকছার জীবন মোর্চা” গ্রন্থে।

উল্লেখ্য যে, শ্রী বরেন ত্রিপুরা (স্বর্গীয়) হচ্ছেন বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত চেয়ারম্যান শ্রী নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা (প্রাক্তন এআইজিপি, বাংলাদেশ পুলিশ এবং প্রাক্তন সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়)-এর পিতা। একইসাথে, মাতৃবংশের সূত্রে শ্রী বরেন ত্রিপুরার পরিবারের সাথে মং সার্কেল চীফ পরিবারের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়তা রয়েছে। সেই কারণে, মং সার্কেলের অজানা ইতিহাসটির বিষয়ে তিনি তাঁর জীবনীগ্রন্থে সাবলীল ভাষায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

এই বিষয়ে লেখক শ্রী বরেন ত্রিপুরা তাঁর গ্রন্থের কয়েকটি অংশে বিচ্ছিন্নভাবে আলোকপাত করেছিলেন। তবে, সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন গ্রন্থের ৩১ ও ৩২ পৃষ্ঠায়। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে, বিশেষ করে ত্রিপুরাদের জানানোর স্বার্থে সেই অজানা ইতিহাসটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলঃ-

“১৮৬০ ইং খ্রিস্টাব্দে চাকমা-চীফ বা রাজা কালিন্দী রানীর সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধির মনোমালিন্যের কারণে চীফের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার চাকমা সার্কেলের উত্তর অংশ – তদসঙ্গে ত্রিপুরার করদমিত্র রাজ্যের সামান্য অংশ যোগ করে সর্বমোট ৬৭৩ বর্গমাইল জমি নিয়ে ত্রিপুরাদেরকেও একটি সার্কেল দেয়ার কথা চিন্তা করে সার্কেলটি সৃষ্টি করা হয়; তখনকার সময়ে উক্ত প্রস্তাবিত সার্কেলের জনসংখ্যা ছিল নিম্নরূপঃ-

ত্রিপুরা= ১৮,৫১২, প্লাইছা মগ= ৬,৭০৬ ও চাকমা=৬,১৮০।

সঙ্গত কারণে, ত্রিপুরাদের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ৯৫ মহালের মহালদার বৃদ্ধ আনিদরামের কথা প্রথমে আসে। কাজেই, ব্রিটিশ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি জেলার সুপারিন্টেনডেন্ট ক্যাপ্টেন লুইন আনিদরাম ও তদপুত্র খিদলমনিকে রামগড়ে ডেকে পাঠান এবং নিজেও রামগড়ের পথে রওনা দেন। কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট জলপ্লাবনের হেতুতে সুপারিন্টেনডেন্টকে পথিমধ্যে মানিকছড়িতে আরাকান থেকে আগত ব্রিটিশের আশ্রয়ে অবস্থানরত (১৭৮২ ইংরাজীতে) প্লাইছা মগ সর্দার (২ মহালের মহালদার) কুংজাই (কুঞ্জ ধামাই মানে পরিচিত) ধামাইর ঘরে প্রায় দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থান করতে বাধ্য হন।

সেখানে নাকি তিনি কুঞ্জধামাইর পুত্র ক্যজসাইন ধামাইর স্ত্রী ত্রিপুরা মহিলা শান্তি রুং ও তাঁর সহোদরা অবিবাহিত বোন দয়ারুং থেকে খুবই আন্তরিক অভ্যর্থনা পেয়ে তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং আনিদরামের দলকে বাদ দিয়ে কুঞ্জ ধামাইর দলকে চীফ-শীপের অধিকার দিতে মনস্থ করেন। এই শান্তি রুং ও দয়ারুং এর মাধ্যমে কুঞ্জ ধামাই বৃহত্তম দল ত্রিপুরাদের সমর্থন আদায় করেন। কাজেই সার্কেল ও চীফ-শীপ ত্রিপুরারাও মান (ত্রিপুরা শব্দ অর্থ মান্য) করে বলে মান সার্কেল ও চীফও মান-চীফ তথা মানরাজা বনে যান।

এইরূপে ত্রিপুরার স্বজাতির Internecine আত্মকলহে সার্কেল ও চীফ-শীপ হারান। উল্লেখ্য যে, সে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে ত্রিপুরাদের ৩৬ দফা ত্রিপুরাদের মধ্যে মাত্র ১ নাইতং দফার লোকেরাই আনিদরামের দলের পক্ষে ছিল – বাকি সব দফার ত্রিপুরারা কুঞ্জ ধামাইর (প্লাইছা মগের) পক্ষে চলে গিয়েছিল বলে শুনি। আরও দুর্ভাগ্য ছিল যে, নাইতং দফার মামলাবাজ ত্রিপুরা কালাগঙ্গা – যাকে আনিদরামের দলেরা মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল, সে নিজেই পক্ষের নারানদের প্রতারণা করে ধামাইর পক্ষ গ্রহণ করে পোমাং উপাধি নিয়ে লুইন সাহেবের সাহায্যে ৩১নং বোয়ালখালী মৌজার হেডম্যান পদসহ বহু দ্রোণ জমির মালিক বনে যান।

সেই পোমাংদের পরবর্তী বংশের অন্য এক হেডম্যান ত্রিপুরা রাজ্যের স্বদেশী আন্দোলনের এই ত্রিপুরা সমাজের পুরোধা সাধু রত্নমনি মহারাজকে বন্দী করে দিয়েছিলেন। অতীব দুঃখের সহিত বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ২ ভদ্র মহিলা শান্তিরুং (মগদের কাছে সাদেরুং) ও দয়ারুং (মারমাদের কাছে দৈরং) উভয়েই আমার (লেখকের) মাতৃদেবীর বংশের পূর্ব-পুরুষ-মহিলা আর যে হেডম্যান (ময়ুধ্বজ পোমাং) সাধু মহারাজকে বন্দি করে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনিও আমার (লেখকের) মায়ের পিতার ছোট ভাইয়ের পৌত্রীর জামাতা। তারা বর্তমানে বেঁচে নেই।

যা হোক ক্যজসাইন ধামাই পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীর সহোদরা দয়ারুংকেও বিয়ে করতে বাধ্য হন এবং এই দুই সহোধরার গর্ভে যথাক্রমে হরচন্দ্র (নরবদি) ও রাজচন্দ্রের জন্ম হয়। এই হরচন্দ্র (নরবদি) এর জামাতা নিপ্রুসাইন চৌধুরী (যিনি ভগ্নি-পুত্রও হন) পরে দীর্ঘ তেত্রিশ বছর আনিদরামদের সঙ্গে মামলার পর নিষ্পত্তি হয়ে ১৮৯৩ ইং খ্রিস্টাব্দে মান সার্কেলের প্রকৃত চীফ হিসাবে আসীন হন।”

[শ্রী বরেন ত্রিপুরার আত্মজীবনী “নঙ-কাচাকছার জীবন মোর্চা” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে।]

সূত্র: (লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)

___________________________________________________________

* মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার বক্তব্য, তথ্য, সূত্র একান্তই পাঠকের। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন