মুসলিম নিধন শুরু হয়েছে আসামে: মৃত অসংখ্য

140502171145_assam_kokrajhar_killings_512x288_ap

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, পার্বত্যনিউজ:

আসামে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাকসা জেলার নারায়ণগুড়ি গ্রামে হানা দিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছে সন্দেহভাজন বোড়ো জঙ্গীরা। পুলিশ বলছে মাত্র ৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করা গেছে, তবে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে যা জানা যাচ্ছে, তাতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। উদ্ধার হওয়া মৃতদেহগুলির মধ্যে ৫জন মহিলা রয়েছেন। সকলেই মুসলমান। ৩৬টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে এই তথ্য দিয়েছেন বাকসা জেলায় অবস্থানরত পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশক আর এম সিং। তিনি বলেন, ‘এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম। সন্ধ্যার পরে ওখানে পৌঁছন প্রায় অসম্ভব। কয়েকজন গ্রামবাসী পালিয়ে এসে পুলিশকে ঘটনার খবর দিয়েছে।“

এর আগে কাল রাত থেকে ওই বাকসা আর পার্শ্ববর্তী কোকড়াঝাড় জেলায় সন্দেহভাজন বোড়ো জঙ্গীদের হামলায় নিহত হয়েছিলেন দশজন। সকলেই বাংলাভাষী মুসলমান। পুলিশ বলছে বাকসা জেলার দুর্গম গ্রাম নারায়ণগুড়িতে শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রায় চল্লিশটি বাড়িতে প্রথমে আগুন ধরিয়ে দেয় জঙ্গীরা আর তার ফলে মানুষজন যখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন জঙ্গীরা শুরু করে গুলিবর্ষণ। প্রায় ৪০ জন সদস্য ছিল ওই জঙ্গীদলে।

ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় মুসিলম নেতা ইব্রাহিম আলি ওই গ্রামে গিয়েছিলেন, তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, ”অনেকগুলি দেহ শনাক্ত করা যায় নি, আবার অনেক দেহ সম্ভবত নদীতে পড়ে ভেসে গেছে।” তিনি নিজেই ১২টি মৃতদেহ উদ্ধার হতে দেখেছেন। চারজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ আর সেনাবাহিনী পৌঁছেছে। বাকসা সহ বোড়োল্যান্ড এলাকার জেলাগুলিতে সান্ধ্য কার্ফু জারি করা হয়েছে।

140502163142_assam_kokrajhar_violence_624x351_afp

হামলা শুরু বৃহস্পতিবার

বোড়ো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় দুজন শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের দশজন । উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য আসামের পুলিশ বলছে গত ১২ ঘন্টায় সন্দেহভাজন বোড়ো জঙ্গীদের গুলিতে বাকসা আর কোকরাঝাড় জেলাগুলিতে অন্তত ১০জন নিহত হয়েছেন – যারা সকলেই মুসলমান। এদের মধ্যে দুটি শিশু আর ছয়জন মহিলা রয়েছেন। আহত হয়েছেন চারজন।

বোড়োল্যান্ড এলাকার পুলিশ আই জি এল আর বিশনোই বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “কাল সন্ধ্যায় প্রথম ঘটনাটা বাকসা জেলার নরসিংগাঁওতে ঘটেছে। তিনজন মারা গেছেন আর তিনজন আহত হয়েছেন। এরপরে প্রায় মধ্যরাতে কোকড়াঝাড় জেলার বালাপাড়াতে দ্বিতীয় হামলা হয়, যাতে সাতজন মারা গেছেন।“ তিনি আরও জানিয়েছেন যে বোড়ো জঙ্গী গোষ্ঠী – ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড বা এন ডি এফ বি-র সঙবিজিৎ গোষ্ঠীই এই হামলার জন্য দায়ী বলে পুলিশের সন্দেহ।

কোকড়াঝাড় জেলার তামুলপুরে এক বোড়ো যুবক আহত হয়েছেন, তবে এটা এখনও নিশ্চিত নয়, যে মুসলিমদের গ্রামগুলোর ওপরে হামলার প্রতিশোধ নিতেই ওই যুবকের ওপরে হামলা হয়েছে কী না। এছাড়াও কোকড়াঝাড় শহরের মধ্যেই রাতে এক স্থানীয় সাংবাদিককে পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে আহত করেছে সন্দেহভাজন জঙ্গীরা। স্থানীয় সূত্রগুলি জানাচ্ছে হত্যার দুটি ঘটনাই প্রায় একই ভাবে ঘটানো হয়েছে। মুসলিমদের বাড়িগুলি ঘিরে ধরে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।

কোকরাঝাড়ের যে বালাপাড়া গ্রামে সাতজন নিহত হয়েছেন, সেখানকার বাসিন্দা মুহম্মদ উকিল আলি টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার রাতে কী হয়েছিল। “ভোটের পর থেকেই সেনা আর পুলিশ গ্রামের ছেলেদের আটক করে হেনস্থা করছে। তাই রাতে যুবকরা কেউ বাড়িতে থাকে না, জঙ্গলে থাকে। কালও কেউ বাড়িতে ছিল না। বারোটার একটু আগে হঠাৎই বোড়ো জঙ্গীরা আক্রমণ করে। তিন চারটি বাড়ির দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলে আর গুলি চালাতে শুরু করে। বেশীরভাগই বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থাতেই মারা গেছেন – কেউ উঠতে পারেন নি। গুলি চালানোর পরে কোপানোও হয় দেহগুলির ওপরে,” বলছিলেন মি. আলি।

তিনি আরও জানান যে কাছেই একটা বিএসএফ ক্যাম্প আছে। সেখানকার রাত-পাহারাদার দল গ্রামে ঘুরছিল। কিন্তু তারা একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যাওয়ার পরেই জঙ্গীরা আক্রমণ করে। একটা পরিবারে শুধু বছর পঁচিশেকের এক যুবক বেঁচে আছেন, বাকী সকলেই মারা গেছেন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ময়না তদন্তের পরে দেহগুলি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জানাজার পরে সেগুলি কবর দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। মুসলিম নেতারা বলছেন, ২৪শে এপ্রিল ওই এলাকায় লোকসভার ভোট নেওয়া হয়, আর তারপর থেকেই ভীতিপ্রদর্শন চলছিল। অ-বোড়ো সংগঠনগুলি এবারই প্রথম জোটবদ্ধ হয়ে একজন প্রাক্তন আলফা কমান্ডার হীরা শরণিয়াকে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়েছিলেন।

“এবারের ভোটে যেহেতু অ-বোড়ো সংগঠনগুলো এক হয়ে একজন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলাম, তাই বোড়ো জঙ্গীরা বদলা নিল। ভোটের পর থেকেই গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাস চালাচ্ছিল। আর কাল রাতে এই দুটো ঘটনা হয়ে গেল,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অল বোড়োল্যান্ড মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রকিবুল ইসলাম।

বাংলাভাষী মুসলিমদের ছাত্রসংগঠন এবিএমএসইউ-র কোকড়াঝাড়ের জেলা সম্পাদক জায়দুল ইসলাম বলছিলেন, “স্থানীয় বোড়ো বিধায়ক প্রমীলা রাণী ব্রহ্মর এরকম একটা বিবৃতি ছাপা হয় বৃহস্পতিবার সকালেই। আর রাতেই এই আক্রমণ হয়।“

অন্যদিকে, বোড়ো ছাত্র ইউনিয়ন আবসুর প্রেসিডেন্ট প্রমোদ বোড়ো বলছিলেন, “নির্বাচন নিয়ে কিছু নেতা নেত্রী উস্কানি তো দিচ্ছেনই। সেটাও এই ঘটনার পেছনে একটা কারণ হয়ে থাকতে পারে। তবে অন্যদিকে আসাম সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারও দায় এড়াতে পারে না। বোড়োল্যান্ড এলাকা এতটাই উত্তেজনা প্রবণ – সেখানে কেন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক খবর জোগাড় করতে পারছে না যে আক্রমণ হতে পারে? কেন নিরাপত্তা দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না?”

তবে আসাম পুলিশের মহানির্দেশক খগেন শর্মা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন যে এনডিএফবি-র সঙবিজিৎ গোষ্ঠীর এই আক্রমণ আসলে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। মি. শর্মার কথায়, “গত দু-তিন মাসে ওই গোষ্ঠীর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে – ১৮জন মারা গেছেন, ৪০-এরও বেশী জঙ্গী আত্মসমর্পণ করেছেন। ওদের অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সেনা বা পুলিশবাহিনীর ওপরে আক্রমণ করা কঠিন। অন্য জঙ্গীগোষ্ঠীগুলিকে আক্রমণ করলে তারা পাল্টা আঘাত হানবে। তাই সবথেকে সুবিধাজনক টার্গেট নিরীহ পরিবারগুলো। রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপরে হামলা করে জানান দিতে চাইল যে তারা এখনও অভিযান করার ক্ষমতা রাখে।“ বোড়োল্যান্ড স্বশাসিত এলাকায় ৭০% মানুষই অবোড়ো – যাঁদের একটা বড় অংশ বাংলাভাষী মুসলমান।

বোড়োল্যান্ড এলাকার জেলাগুলিতে ২০১২ সাল থেকেই বোড়ো আর মুসলিমদের মধ্যে জাতি দাঙ্গা চলেছে – যাতে একশোরও বেশি মানুষ মারা গেছেন আর গৃহহীন হয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। বোড়ো সংগঠনগুলির অভিযোগ, তাঁদের জমি, জঙ্গল দখল করে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীরা। আর বাংলাভাষী মুসলমানদের কথায়, তাঁদের পূর্বপুরুষরা বহু দশক আগে থেকেই আসামে চলে এসেছিলেন কৃষিকাজ করতে।

ত্রাণ শিবির থেকে অনেকে সাহস করে গ্রামে ফিরে যেতে পারলেও এখনও বহু মানুষ অন্য এলাকায় বসবাস করছেন। ২০১২-র দাঙ্গার পরে সেনাবাহিনী ও আসাম পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে বে-আইনী অস্ত্র উদ্ধার করতে শুরু করেছিল। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে বেশীরভাগ বে-আইনী অস্ত্রই ইতিমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে।

তবে মুসলিম সংগঠনগুলির অভিযোগ, যেসব জঙ্গীগোষ্ঠী আত্মসমর্পণ করেছে অথবা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে গেছে, তাদের অস্ত্রভান্ডার সরকারের কাছে জমা দেয় নি। যৌথ অভিযানের পরেও অনেক অস্ত্র রয়ে গেছে আর সেই সব অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়েই হামলা হচ্ছে মুসলিমদের ওপরে। সূত্র: বিবিসি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন