ময়না-নুরবানুর আত্মহননের জন্য আমাদের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী
ফারুক হোসাইন :
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারগুলোতে এখনো কন্যা শিশু জন্ম নেয়াকে অশুভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সে কন্যার গায়ের রং যদি হয় কালো তাহলে তো কথাই নেই,অতি আদরের শিশুটিও পরিবারে অভিশাপ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে।
পরিবার, আত্মীয়, সমাজ সব পরিবেশে তাকে বিশেষ অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। পরিবারের সদস্যরা ও প্রতিবেশীরা প্রায়ই তাদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, প্রায়ই তারা সমাজে ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হয়।আর এসব কন্যা শিশু নিজেদেরকে সবসময় অন্যদের চেয়ে আলাদা মনে করে, হীনমন্যতায় ভোগে।
বয়স বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে সামাজিক প্রবঞ্চনার মাত্রাও। এভাবে চারপাশের পরিবেশ থেকে নিষ্পেশিত হতে হতে এক সময় তারা নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে করে।চারপাশ পাওয়া বঞ্চনা আর হীনমন্যতায় তারা নিজেদের তদেরকে সবার কাছ থেকেই লুকিয়ে রাখতে চায়, পালাতে চায় চেনাজানা পরিবেশ থেকে। তারা ভাবতে শিখে, এ পৃথিবী এ সংসার তাদের জন্য নয়। এ পরিস্হিতিতে অনেকেই নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিতে আত্মহননের পথটিই বেছে নেয়।
দুঃখজনকভাবে সত্যি যে, গত ৮ মার্চ নারী দিবসে রাংগামাটি জেলার লংগদু উপজেলার চাইল্যাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া দুই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রেও অনেকটা এমনই হয়েছে।
কৃষক ও দিনমজুর পরিবারের এ মেয়ে শিশু দুটির গায়ের রং কালো ছিল বলে তারা সবসময় হীনমন্যতায় ভোগতো। তারা দুজন ঘনিষ্ট বান্ধবী থাকলেও সহপাঠী কিংবা পাড়ার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে সহজে মিশতে চাইতো না।সবসময় তারা আলাদা থাকতে পছন্দ করতো।
তবে দুই বন্ধবী ছিল পরস্পরের আত্মার আত্মা। এক সাথে স্কুলে যেত-আসতো, গোসল করতো, গল্প করতো, সময় কাটাতো। তারা নিজেদের জীবন নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতো।
৯ মার্চ সকালে সরেজমিনে ঘটনা জানতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া ময়নার মায়ের কাছে জানতে পারলাম, কদিন আগে ময়না ও নুরবানু দুই বান্ধবী মিলে অষ্টম শ্রেণি পাশের পর গার্মেন্টেসে চাকুরিতে চলে যাওয়ার কথা বলেছিল, আশা ছিল এতে অন্তত তাদের বিয়ে দেয়ার খরচাটা বেঁচে যাবে।
না তাদেরকে আর গার্মেন্টসে চাকরি করতে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হয়নি, এ সমাজ ও সংসারের প্রতি এক পাহাড় ধিক্কার জানিয়ে তারা এক আম্রপালি গাছের দুই ঢালে আশ্রয় নিয়ে দুই বান্ধবী পরপারেই পারি জমিয়েছেন।
স্কুল শিক্ষক, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ছিল অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের, কারো সাথে কখনোই ঝগড়া করতো না। এমনকি কোন ছেলেদের সাথেও কোনো প্রকার সম্পর্কের ঘটনা ছিল না।
অনেক অনুসন্ধানেও তাদের আত্মহত্যার অন্য কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং এ কথা বলাই যায়, সামাজিক বঞ্চনা ও মেয়েদের ব্যাপারে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কারই তাদেরকে আত্মহননের পথে পরিচালিত করেছে।