রাখাইন পরিস্থিতির অবনতি, বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে ‘হাজার হাজার’ রোহিঙ্গা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমারের পক্ষ থেকে গত সেপ্টেম্বরেই ক্লিয়ারেন্স অপারেশন সমাপ্তির ঘোষণা দেওয়া হলেও রাখাইনের আগুন এখনও থামেনি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদকেরা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের এপার থেকে সোমবার (৯ অক্টোবর) ‘হাজার হাজার’ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে দেখেছেন। পালিয়ে আসা সেইসব মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা।

আগের দফায় সংঘাত কবলিত এলাকাগুলোর বাইরে এখন রাখাইনের মধ্যাঞ্চলে নতুন করে শুদ্ধি অভিযান শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিরাজ করছে।

রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবশিষ্ট মানুষেরা আরও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়েছেন। সহিংসতার ভীতি আর ক্ষুধা-রোগ নিয়ে দিনযাপন করছে তারা।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের বাংলাদেশ অংশের পালং খালিতে অবস্থানরত রয়টার্সের প্রতিবেদকেরা দেখেছেন, ঝোঁপঝাড় আর বন্যাকবলিত মাঠের ভেতরে হাজার হাজার মানুষ।

৪৬ বছরের একজন রোহিঙ্গা সৈয়দ আজিন। ৮০ বছরের মাকে একটি ঝুড়িতে নিয়ে তিনি আটদিন হেঁটেছেন। তিনি বলেন, ‘সেনাসদস্য ও বৌদ্ধরা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমার গ্রামের অর্ধেক পুড়ে গেছে। আমি নিজেই তাদের দেখেছি। আমি সবকিছু রেখে এসেছি। আত্মীয়স্বজন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। আর সহ্য হচ্ছে না।’ পালিয়ে আসা নতুন অনেক মানুষই জানিয়েছেন সীমান্তের দিকে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর বৌদ্ধরা হামলা চালিয়েছে।

মিয়ানমারের সরকার দাবি করেছিল, সেপ্টেম্বরের শুরুতেই সেনাবাহিনীর ‘শুদ্ধি অভিযান’ শেষ হয়েছে। ফলে মানুষের পালানোর মতো কোনও কারণ নেই। কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারই জানিয়েছে, আরও অনেক রোহিঙ্গা পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটি এলাকা থেকেই ১৭ হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন। সরকার বলছে, খাদ্য ও নিরাপত্তার অভাবে কারণে মানুষ পালাচ্ছে।

রাখাইনের অনেক গ্রামের মানুষ জানিয়েছে, খাদ্য সংকটের কারণ হচ্ছে জমি চাষ করার জন্য প্রস্তুত নয়। রাজ্য সরকার স্থানীয় বাজার বন্ধ করে দিয়েছে। তারা খাদ্য পরিবহনে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে সরকারের দাবি, আরসা সদস্যদের সরবরাহ বন্ধ করতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বুথিয়াডাউং জেলার এক গ্রামের বাসিন্দা জানায়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আমাদের খাবার নেই এবং নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক মানুষই পালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন সহিংস অভিযান চালাচ্ছে তখন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা খাদ্য সংকটের কারণে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিয়াউ সার তুন খাবারের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। উল্টো তিনি রয়টার্সের প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করেছেন, বুথিয়াডাউংয়ে খাবারের অভাবে কারও মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছেন আপনি?

রাখাইনে সহিংসতা কবলিত অঞ্চলে খাদ্য সংকটের বিভিন্ন খবরের পর ওই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার দাবি জোরদার হচ্ছে।

এ পর্যন্ত সহিংসতামুক্ত থাকা রাখাইনের মধ্যাঞ্চলেও নতুন করে শুদ্ধি অভিযানের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রয়টার্সের পৃথক একটি প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মালম্বী রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা রাখাইনের মধ্যাঞ্চলে বাস করে। এ অঞ্চলে প্রায় আড়াই লাখ মুসলমানের বাস। মুসলমান ও রাখাইন গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা কয়েক বছর ধরেই চলছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দুই শতাধিক নিহত ও প্রায় ১৪ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। ২৫ আগস্টের পর এখানকার বেশ কয়েকটি জেলায় রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির কাজ হচ্ছে, মুসলিমদের সঙ্গে লেনদেন বা যোগাযোগ করার কারণে গ্রামের বৌদ্ধদের প্রকাশ্যে মারধর ও সমাজচ্যুত করার মতো শাস্তি দেওয়া।

রাখাইনের মধ্যাঞ্চলীয় বৌদ্ধ অধ্যুষিত একটি শহর মিয়াবিনে আরসা’র হামলার চারদিন পর রোহিঙ্গাবিরোধী একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই শহরের একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু অশিন সারোমানি। তার ভাষায়, ‘এই পরিস্থিতিতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের একসঙ্গে বাস করা সম্ভব নয়। সরকার তাদের একীভূত করতে পারবে না। এজন্যই আমরা মুসলিমদের সঙ্গে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করেছি, যাতে করে সংঘাত এড়ানো যায়।’

রাখাইন রাজ্য সরকারের মুখপাত্র মিন অং জানান, মুসলিমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বৌদ্ধদের শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তার মতে, আন্তঃসম্প্রদায় কমিটির মাধ্যমেই উত্তেজনা দূর করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য রাজ্য ও অঞ্চলে আন্তঃসম্প্রদায় কমিটি শান্তির জন্য কাজ করছে। রাখাইনে এখনও এ ধরনের কোনও কমিটি গঠন করা হয়নি।’

আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে রিকশায় মাইক লাগিয়ে মিয়াবিন শহরজুড়ে মুসলিমদের সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ না করার আহ্বান জানাচ্ছে রাখাইনের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। সয়ে চায় নামে ৩৫ বছরের এক রাখাইন নারী এই ঘোষণা অমান্য করেছিলেন। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর মুসলিমদের কাছে পণ্য বিক্রির অভিযোগে স্থানীয় একদল বৌদ্ধ তাকে নির্যাতন করে। তারা ওই নারীকে মারধর ও চুল কেটে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করায়। এ সময় ওই নারীর গলায় একটি প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’। শহরটির বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের দাবি, শুধু সরকারই ত্রাণ দিতে পারবে এবং তা অবশ্যই বৌদ্ধরা যাচাই করবে।

এ বিষয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু অশিন সারোমানি বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা যদি যাচাই না করি তাহলে ত্রাণের বহরে এনজিওগুলো বাঙালিদের অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে।’ ত্রাণকর্মীদের মতে, রাখাইনের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরনের বিধিনিষেধ কার্যকর রয়েছে।

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে মিয়ানমারের অনেক স্থানেই মুসলিমবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১০ সেপ্টেম্বর মাগউই বিভাগে মুসলিমদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হলে পুলিশ দুর্বৃত্তদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পূর্বাঞ্চলের কায়িন এলাকায় গত মাসে মুসলমানদের বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কারণে গ্রামের বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। সহিংসতাকবলিত অঞ্চলের কাছাকাছি রাথেউডাউং শহরের মুসলমানরা জানিয়েছেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।

মিয়াবিন ক্যাম্পের মুসলিমরা জানিয়েছেন, তারা ক্যাম্প থেকে পালাতে চান। এক মুসলিম বাসিন্দা চো চো বলেন, ‘আমাদের পক্ষে মিয়াবনশহরে ফিরে গিয়ে একত্রে বাস করা কঠিন। যেসব রাখাইন আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙেছে, তারা ভয়ে আছে। তাদের আশঙ্কা মুসলিমরা তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে।’

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে যে সহিংসতা বিরাজ করছে তা সহজেই রাজ্যটির অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে যেতে পারে। এক ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘পরিকল্পিত সহিংসতা বন্ধ না করায় তা রাখাইনের মধ্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেখানে প্রায় আড়াই লাখ মুসলমান বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। ওই এলাকায় রাখাইন সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক কম। ফলে অনেক রাখাইন মুসলিম প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন