রাজপ্রথা দুর্বল হয়ে পড়েছে

রাজপ্রথা দুর্বল হয়ে পড়েছে বাংলানিউজকে বোমাং রাজকন্যা
বোমাং রাজপরিবারের সর্বশেষ রাজা বাবা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী এবং রাজমাতা দএসাং ও দুই বোনের সঙ্গে ডনাই প্রু নেলী।

 

বাংলানিউজ: আপনার পরিবার, রাজপরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলুন।

নেলী: মা-নানীদের কাছে শোনা,  আমার দাদু বোমাংগ্রী ক্যজসাইন ছিলেন রাজার মতো রাজা। তিনি ছিলেন আমাদের বংশের ১৩তম রাজা। তার সৈন্য ছিল, কারাগার ছিল। তিনি শাসন করতেন, বিচার করতেন। ডিসি-কমিশনার কখনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোন কাজে বাধ্য করতে পারে নি।

তার বোমাং সার্কেল নিজের ইচ্ছামাফিক সাজানোর সব ক্ষমতাই হাতে রাখতেন তিনি। সে যুগে যখন কোনো রাস্তা-ঘাট ছিল না, তখনো বৃটিশ কুইনদের সঙ্গে, জাপান কিংদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার।

দাদু মারা যাওয়া পরে তার কাজিন মংশৈ প্রু রাজা হন। আইয়ুব খানের আমলে তিনি ছিলেন মিনিস্টার। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের আমলেও মিনিস্টার হয়েছিলেন। এ আমলকে আমি পেয়েছি। ওই আমলেও আমি দেখেছি যে তার অনেক পাওয়ার ছিল। সরকারকে সঙ্গে রেখেই তিনি তার মতো করে চলতে পারতেন।

দাদুর পরে ১৫তম রাজা হন আমার মামা অগাতা অংশু প্রু বোমাংগ্রী। তার সময় থেকে দেখেছি অনেক পাওয়ার লেস হয়ে যাচ্ছে। এখন ডিসির যতখানি পাওয়ার, ততখানি পাওয়ারও রাজার নেই। নামে রাজা, কিন্তু তার ইনকাম সোর্স নেই, নিজস্ব সৈন্য নেই, স্বাধীন অফিসও নেই। নামে মাত্র যে অফিস আছে সেই অফিস ও অফিস সহকারীর বেতনও সরকার টানে না।

রাজপুণ্যাহের সময় ৪০ হাজার টাকাও খাজনা ওঠে না। কিন্তু রাজপুণ্যাহের তিনদিন অনুষ্ঠান চালাতে রাজাকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। অথচ অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছাড়া একজন রাজা তো রাজার মতো কাজ করতে পারেন না। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে গেলে পুরো পরিবারের একতাবদ্ধ থাকা দরকার।

বাংলানিউজ: তাহলে কি রাজপরিবারের একতা নেই বা কমে গেছে বলে মনে করেন?

নেলী: অনেক কমে গেছে। আগে প্রজারা রাজার কথা মতো চলেছে। তার এলাকার পাহাড়ি-বাঙালি কেউই রাজার সার্টিফিকেট ছাড়া কোথাও ভর্তি হতে পারতো না। এখন কিন্তু সেটা নেই। এখন তাদের ডিসি অফিস, আঞ্চলিক পরিষদ কতো দিকে দৌড়াতে হয়! এমন পরিস্থিতিতে তাই যাদের কোনো ক্ষমতা নেই তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। কিন্তু যখন রাজপ্রথা ছিল তখন ভালো ছিল তারা। তখন মানুষ জানতো রাজার দুয়ারে গেলে একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে।

সুন্দর একটা সিস্টেম রয়েছে রাজপ্রথায়। পাড়ার প্রধান কারবারি যখন কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারেন না,  তখন হেডম্যানের কাছে যান। হেডম্যান না পারলে যান রাজার কাছে।  

বাংলানিউজ: আপনিই তো এখন বোমাং রাজপরিবারের উত্তরাধিকারি ….নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।

নেলী: বাবা রাজা থাকা অবস্থায় খুব কাছাকাছি থেকেছি, তার অধিকাংশ কাজ করেছি। অথচ আমার নাম কিন্তু বেশি জায়গায় খুঁজে পাবেন না। কারণ আমি একজন মেয়ে। আমাদের পরিবারে ছেলেদের গুরুত্ব বেশি।

বাংলানিউজ: আপনার বাবার মৃত্যুর পর রাজপরিবারের এখন কি অবস্থা?

নেলী: বোমাং সার্কেলের চিফ নিয়োগ দেয় কিন্তু সরকার। প্রথমে ফ্যামিলি, তারপর সরকার স্বীকৃতি দেবে। সবকিছু বিবেচনা করে ১৯৯৬ সালে সরকার কিন্তু আমার বাবাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিছুদিন আগে বাবার কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনের কপি পেয়েছি। বাবার শুধু অভিষেক অনুষ্ঠানটা হয়নি। তড়িঘড়ি করে অভিষেক অনুষ্ঠান করেন নি তিনি। বাবা বলতেন- রাজা হবো তো রাজার মতো হবো।

আমি শুনেছি, বাবা সাত বছর পর্যন্ত মাটিতে পা রাখেন নি। কাঁধে চড়ে বেরুতেন, বেড়াতেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে জঙ্গলে ঘুরতেন। কচ্ছপ গাড়ি চালাতেন। এসব আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।

আমার বাবা একটু সময় নিচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝ থেকে আমার মামা অংশৈপ্রু চৌধুরী ঢুকে গেলেন। দুই পরিবার অনেকটা আলাদা হয়ে গেল। একদল বিএনপি, একদল আওয়ামী লীগ। আমার মামা বিএনপি করতেন। তারপর কেস শুরু হলো। উনি কেস ঠুকে দিলেন ঠিক বাবার অভিষেকের আগে। কেস চলতে থাকলো।

আমাদের পক্ষে তো ড. কামাল হোসেন ছিলেন। তখন আমি আর আমার ছোট ভাই এটা নিয়ে ফাইট করছিলাম। দু’তিন বছর পর দেখলাম বাংলাদেশের প্রশাসন, রাজার ইস্যুটাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ে নিলো। আমাদের উত্তরাধিকারের মামলা পরিণত হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াইয়ে। আমাদের মধ্যে বিভাজন বাড়লো। আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আমার বাবা সবসময়ই সেক্রিফাইস করতেন।  এক সময় তিনি বললেন- ঠিক আছে, আমি আর কেস চালাবো না, দাদাই রাজা হোক।

আমার বাবা কেস স্টপ করেছিলেন বলেই মামা তের বছর রাজত্ব করতে পেরেছেন। বাবা উল্টো কেস ঠুকলে মামা কিন্তু রাজা হতে পারতেন না। কেস চললে রাজপরিবার রাজাবিহীন থাকতো। কিন্তু বাবা রাজপরিবারের কথা চিন্তা করে, জনসাধারণের কথা চিন্তা করে বৃহত্তর স্বার্থে সেক্রিফাইস করেছেন।

আমার বাবারা ৩২ ভাইবোন। পাঁচ মা। আমার দাদুর রূপকথার মতো পাঁচ রানী ছিল। প্রত্যেক রানির পেছনেই ছিল নির্দিষ্ট সংখ্যক দাসী-বান্দি। আমার বাবা তিন নম্বর রানীর ছেলে। বাবারা তিন ভাইবোন। আমার বাবার জন্মের সময় দাদু নাকি খুশিতে কামান দিয়ে তোপধ্বনি করেছিলেন। আর কোনো সন্তানের সময় নাকি এরকম হয়নি। দাদু নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে নাকি সৈন্য সামন্তদের বলেছিলেন- এই তোপধ্বনি কর, আমার ছেলে হয়েছে।

বাংলানিউজ: এটার কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল?

নেলী: আমার দাদী ছিলেন দাদুর খুব প্রিয়। আমার বাবার জন্মটা নাকি খুব লাকি ছিল দাদুর জন্য। বাবা যখন ছোট থেকে বড় হচ্ছিলেন বাবাকে দাদু সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। পড়াশুনায় ভালো, কথা শুনতেন, দেখতে রাজপুত্রের মতো। সবকিছু মিলিয়ে বাবাকে খুব পছন্দ করতেন দাদু।

তখন মানুষ কষ্টি গণনায় বিশ্বাস করতো। গণক দাদাকে নাকি বলেছিল- এই ছেলে তোমার জায়গায় বসবে, মানে রাজা হবে। এ জন্য আমি জন্মের পর থেকে শুনছি আমার বাবা রাজা হবে। আমিও জানতাম আমার বাবা যদি রাজা হন আমি প্রিন্সেস হবো। এটা ভাগ্যেও ব্যাপার। এই বিশ্বাসটাই কিন্তু সৃষ্টকর্তা দেখিয়ে দিলেন। রাজা হওয়ার পর বাবা পাঁচমাস বেঁচে ছিলেন। এখন মনে হয় বাবা শুধু রাজা হবার জন্যই বেঁচে ছিলেন। তিনি খুব শান্তিতে মারা গেছেন। দেশের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেতেন বাবা।

বাবার কথা বলতে বলতে জলের বান ডাকে রাজকন্যার দু’চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন-আমার বিদ্রোহটা অন্যরকম। মামা রাজা হওয়ার পর টানা তিনটা বছর বান্দরবানে থাকিনি। রাজপুণ্যাহর আওয়াজটা সহ্য হতো না। রাজা তো আমার বাবার হওয়ার কথা ছিল।

বাবার যেদিন অভিষেক হবে, সেদিন সব রেডি। কমিশনার রওয়ানা দিয়েছেন চিটাগাং থেকে। রোজার মাস ছিল। আমরা ইফতারির আয়োজন করেছি। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি। বাবা রাজার পোশাক পরেছেন …. এটা আসলে অনেক কষ্টকর।

ফের কান্নার তোড়ে কথা ভেসে যায় রাজকন্যার। কান্নার দমক সামলে ফের হাতড়ান স্মৃতির পাতা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আউড়ান-আমি ছিলাম বাবার পাশে ১৪ বছর আগে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি তখন। ও ফিট হয়ে পড়ে গেলো। আমি তখন বাবাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম- বাবা আজ তোমার অভিষেক হয়নি কাল হবে। বাবা বললেন- লোকজনকে কীভাবে সামলাবি।

তারপর আমরা মানুষকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভেতরে কষ্ট চেপে রেখে আপ্যায়ন করেছি। এরপর তের বছর আমি কখনো ভালোভাবে মন থেকে রাজপুণ্যাহ উদযাপন করতে পারি নি।

মামা তো মারা গেলেন বাবা মারা যাওয়ার পাঁচ মাস আগে। তো মারা যাওয়ার আগে মামা বাবাকে ডেকে পাঠালেন। এতো কিছুর পরও বাবা যখন রেডি হয়ে বের হচ্ছেন তখন মা বললেন- কোথায় যাচ্ছ? বাবা বললেন- দাদা আমাকে ডেকেছে। এক দৌড়ে উনি চলে গেলেন। আমরা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

বাংলানিউজ: পরবর্তী রাজা কে হবেন?

নেলী: আসলে আমার বাবা সব কিছু শান্তিতে করে গেছেন।  বাবার পর রাজা হওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বাবা সব কিছু ঠিক করে গেছেন। বাবার পর নয়জন পর্যন্ত রাজা পর্যায়ক্রমে কে কে হবে তা সব ঠিক করা আছে।

বাংলানিউজ: এরা সবাই কি আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার?

নেলী: এরা সবাই রাজ পরিবারের। সবাই রয়েল ব্লু ব্লাড। পর্যায়ক্রমে সবাই রাজা হবেন। আমার বাবা খুব দুর্ভাগা যে তাকে রাজা হওয়ার জন্য ১৩ বছর ফাইট করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে অনেক প্রেসার গেছে। শুধু তলোয়ারটা হাতে নেওয়ার জন্য, অভিষেকের জন্য আমার বাবাকে ১৩টা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু বাবার পরে ৯ জন পর্যায়ক্রমে রাজা হবেন।

ওদিক দিয়ে আমার বাবার বড় ভাইয়ের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার উ চ প্রু রাজা হবেন। তিনি আমাদের পরিবারের পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, অনেক এডুকেটেড।

উত্তরসূরীদের গল্প বলার ফাঁকে হঠাৎ করেই ফের বাবার স্মৃতিচারণে ফিরে যান নেলী।

বাবার মৃত্যুর পর আমি ১৬ দিন তার তলোয়ারটা পাহারা দিয়েছি। হাত দিয়ে ধরে অনুভব করেছি আমাদের পরিবারের তিনশ’ বছরের ঐতিহ্য। ৩শ’ বছর আগে আমাদের পরিবারে এ তলোয়ারটা এসেছে। অথচ তলোয়ারটা কিন্তু আহামরি কিছু না। এ তলোয়ারটা হাতে নিতে পারেন নি বলে কিন্তু বাবা ১৩ বছর সাফার করেছেন।

কমিশনার এ তলোয়ারটা হ্যান্ডওভার করেন। দাদার ক্ষেত্রে তা অনেক ইজি। শেখ হাসিনা বাবার উইলে সিগনেচার করেছেন ৫ মাসও হয়নি।

বাংলানিউজ: আপনাদের এই রাজ প্রথা কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন?

নেলী: আসলে রাজপ্রথা এখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে বা একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি কখনো চাই না রাজপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাক। এখন অন্তত একটা জমি কিনতে গেলে রাজার সার্টিফিকেট লাগে। স্কুল কলেজ, ভার্সিটিতে পড়তে গেলে রাজার সার্টিফিকেট লাগে। তবে প্রথাটা ধরে রাখাও খুব টাফ। এজন্য আমাদের রয়েল ফ্যামিলিকে একজোট থাকতে হবে। আর পাঁচমাস বাবার পাশে থেকে বুঝেছি রাজা হতে গেলে এখন অনেক টাকা লাগে।

বাংলানিউজ: বোমাং রাজপরিবারের আয়ের উৎস আসলে কি?

নেলী: রাজাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। শুনতে হাস্যকর লাগে- যে খাজনাটা আমরা পাই তা ১ লাখের উপর যায় না। কিন্তু আমার বাবার অভিষেক আর রাজপুণ্যাহতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

বাংলানিউজ: রাজা হওয়ার পর কি আপনার দাদা সঙ্গে আপনি থাকবেন? যেহেতু আপনি আপনার বাবার কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন?

নেলী: হ্যাঁ। দাদা যদি চান, আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করবো। অলরেডি সচিবালয়ে কিভাবে কাগজপত্র পাঠাতে হয়, সব ক্ষেত্রে দাদাকে সহযোগিতা করেছি। আমি তাদের বলেছি বাবার সময় তো আমি দৌড়েছি, এখন আমার দাদা রাজা হবেন।

বাংলানিউজ: রাজবাড়িটা বোধহয় ১৯৩৪ সালের দিকে নির্মিত, এর আগে রাজবাড়ি কোথায় ছিলো?

নেলী: আপনারা এমন সময় এসেছেন যে আমি আপনাদের রাজবাড়িটা দেখাতে পারবো না, কারণ রাজবাড়িটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।

বাংলানিউজ: কেন ভেঙে ফেলা হলো?

নেলী: এটা আসলে অনেক কষ্টের কথা। আমার দাদুর মোট ৩২ জন ছেলে মেয়ে ছিলো। এর মধ্যে বেঁচে ছিলেন আমার বাবা, আর বার্মায় কয়েকজন আছেন। তো সম্পত্তি ভাগাভাগির বিষয়টাতো আসেই। তাছাড়া অনেক পুরানো হয়েছিলো, এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যেতো।

বাংলানিউজ: কত দিন হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে?

নেলী: সাত মাস।

বাংলানিউজ: কিন্তু এটাতো একটা ঐতিহ্য?

নেলী: আসলে আমরাও চেয়েছিলাম দাদুর বাড়িটা থাকুক। আমার দাদুর যদি ১ রানী হতো তাহলে ছেলে-মেয়ে একমুঠো হতো। আমার দাদুর ছিলো ৫ রানী, এদের ৩২ জন ছেলে-মেয়ে। বাড়িটা যদি বাবার নামে থাকত তাহলে আমাদের ইচ্ছা ছিলো মিউজিয়াম বানানোর। বাবার ভাগে পড়েছিলো বারান্দাটা। সেটাতো আর রেখে দেওয়া যায় না। আমার বাবা, আমি অনেক কেঁদেছি এজন্য।

বাংলানিউজ: তাহলে এর পর কোনটা রাজবাড়ি হবে? আবার কি নতুন করে তৈরি করা হবে?

নেলী: আসলে এর পর আর কোনো রাজবাড়ি নেই । এর পর যে রাজা হবে তার বাড়িই রাজবাড়ি। আমাদের বোমাং সার্কেলের একটা প্রথা আমি অনার করি, বাট…। রাজা দেবাশিষ জানেন, তার পর তার ছেলে রাজা হবে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তেমন নয়। তাই রাজবাড়ি দেখার কিছু নেই। আমরা একটা প্রাসাদ উঠাচ্ছিলাম এটাই হতো রাজবাড়ি। কিন্তু শেষ করতে পারি নি। এর মধ্যে বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।

বাবা চলে যাবেন বলেই বোধ হয়, রাজপুণ্যাহ হওয়ার ২ দিন আগে বাবাকে রাজকীয় ড্রেস পরিয়ে মডেল করে ছবি তুলেছি। দাদুর ছবি দেখে সেই ড্রেসের মতো সে ধরনের গহনার মতো গহনা আমরা তৈরি করেছি। বাবার কোমরের বেল্টটা ছিলো দাদুর, তলোয়ারটাও দাদুর।

বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন। বাবা একেবারেই শান্তিতে মারা গেছেন। বাবা মারা যান ভোর সাড়ে তিনটার দিকে। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাকে ডেকে বললেন, আমাকে তো ছবি দেখালি না। আমি বললাম বাবা আমিতো দেখিয়েছি। বললেন আমাকে ছবি ওয়াশ করিয়ে দাও। অনেক জায়গায় আমার ছবি দিতে হবে। এখন বুঝি বাবা আমাকে আসলে ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন। অনেক জায়গায় বাবার ছবি টাঙিয়ে দিতে হয়। বাবার স্কুল, বাবার আশ্রম অনেক জায়গায়।

বাংলানিউজ: প্রয়াত রাজার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?

নেলী: বাবার একটা বৌদ্ধ অনাথালয় আছে। বাবার নিজ হাতে গড়া। সেখানে ১২০ জন বাচ্চা আছে। আগে তো বাবা দেখতেন। আমি জানি না যে এখন এ অনাথালয় আমি কীভাবে চালাবো। ১২০ জন বাচ্চার থাকা, খাওয়া, তাদের পড়াশুনা ….। তবে আমি ভাঙতে দেব না।

বাবা মরে যাওয়ার আগে একদিন আমাকে বলেন, মা রে অনাথালয়ের এ ১২০ জন বাচ্চাকে তোর দেখতে হবে। এ বাচ্চাগুলোকে তুই কখনো না খাইযে রাখবি না। বাবা কিন্তু আমাকে আগে থেকেই ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন।
বাবা মারা যাওয়ায় বাচ্চাগুলো অনেক অসহায় হয়ে গেছে। ওরা ভাবছে যে কোনো সময় এটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাট আমি বন্ধ হতে দেব না। আমি ওদের দেখবো।

বাংলানিউজ: আপনার নিজের পরিবার থেকে কি কেউ রাজা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?

নেলী: আসলে আমার ছোট ভাইরা অনেক ছোট? যেহেতু রাজা হওয়াটা বয়স এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। যদি রাজপ্রশাসন থাকে তাহলে আমার সবার ছোটোভাই রাজা হবে।

বোমাং ‍রাজপরিবারের ইতিহাস সংক্ষেপ
১৭২৭ সালে বোমাংগ্রী (মহাসেনাপতি) কাংহ্লাপ্রু তার অনুসারীদের নিয়ে সাঙ্গুনদীর তীরবর্তী বান্দরবানে বসতি গড়ে তোলেন। ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে শাসন পরিচালনা করেন পাঁচজন বোমাংগ্রী। ১৯০০ সালে বোমাংগ্রী সানাইঞোর আমল ‘চিটাগাং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে ডেপুটি কমিশনারের পাশাপাশি সার্কেল চিফ, মৌজা হেডম্যান, কারবারি, রোয়াজা ইত্যাদি পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সার্কেল চিফকে দেওয়া হয়।

বান্দরবান ও রাঙামাটির কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল, রাঙামাটিতে চাকমা সার্কেল এবং খাগড়াছড়ি জেলায় মং সার্কেল গঠন করা হয়। তখন থেকে সার্কেল চিফরা রাজা হিসেবে পরিচিত। রাজারা নিজ এলাকার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি।

২০১৩ সাল পর্যন্ত বোমাং সার্কেলে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৬ জন রাজা। সর্বশেষ রাজা ছিলেন সদ্যপ্রয়াত ক্য সাইন প্রু চৌধুরী। রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী মারা যাওয়ার পর ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী দায়িত্ব নেন বান্দরবান বোমাং সার্কেলের ১৬তম রাজা হিসেবে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে ১৬তম এ রাজা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

বোমাং সার্কেল এখন ১৭তম রাজার অভিষেকের অপেক্ষায়। ১৬তম এবং সর্বশেষ বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা ডনাই প্রু নেলীর চাচাত ভাই ইঞ্জিনিয়ার উ চ প্রু-র অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে  আগামী ২৪ এপ্রিল।

বান্দরবান থেকে ফিরে: ডনাই প্রু নেলী। বোমাং রাজপরিবারের সর্বশেষ (১৬তম) রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা। সম্প্রতি ভাগ্য বিড়ম্বিত এই রাজকন্যার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

টানা তিন ঘণ্টার কথোপকথনে উঠে আসে বোমাং রাজ পরিবারের তিনশ’ বছরের ইতিহাস। জানা যায় ঐতিহ্য, সংস্কৃতির নানা দিক। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি আর সমষ্টিগত স্বার্থ চিন্তার অনেক সুচিন্তিত বিশ্লেষণও উঠে আসে রাজকন্যার সহজ-সরল-সাবলীল বক্তব্যে। বাদ যায় না উত্তরাধিকার নিয়ে পারিবারিক জটিলতাজনিত হতাশা-হাহাকার-আক্ষেপও। অপ্রাপ্তি আর ভাগ্য বিড়ম্বনার বেদনা কখনো জলের ধারা হয়ে নামে বোমাং রাজজন্যার চোখে। পরক্ষণেই অশ্রুর বেগজয়ী চোখে ফুটে ওঠে রাজপরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়। ফাঁকে ফাঁকে রাজপরিবারের জনহিতৈষী কাজের নাতিদীর্ঘ ফিরিশতিও তুলে ধরেন তিনি।

বাংলানিউজের পক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি নেন নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। ছবি তোলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।

পাঠকদের সুবিধার জন্য দীর্ঘ সাক্ষাতকারটির প্রথম পর্ব ছাপা হলো শুক্রবার। 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন